করোনাভাইরাস মহামারিতে সবচেয়ে বড় বিপদ হলো এর দীর্ঘ উপসর্গগুলো। মহামারির শুরু থেকেই মানুষ শারীরিক এবং মানসিক উভয় ধরণের জটিলতার সাথে লড়াই করছে। উপসর্গের ক্রমবর্ধমান তালিকা থেকে শুরু করে নতুন রূপের আবির্ভাব পর্যন্ত করোনা-পরবর্তী জটিলতার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। যদিও দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা কমেছে, কোভিডের ফলে তাদের দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতাও বেড়েছে। সুস্থ হওয়া রোগীরাও স্বস্তি নিতে পারছে না।
লং কোভিড কী?
লং কোভিড এমন ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা যায় যারা অসুস্থতা থেকে সেরে ওঠা এবং করোনা নেগেটিভ হওয়ার পরও করোনার জটিলতাগুলো অনুভব করতে থাকে। করোনা-পরবর্তী জটিলতায় ভুগছেন এমন ব্যক্তিদের ‘লং হোলার’ বলা হয়। করোনার গুরুতর সংক্রমণের কারণে, তারা হয় তাদের ফুসফুস, হার্ট, কিডনি বা মস্তিষ্কের কিছু স্থায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হয় অথবা এই অঙ্গগুলোর কোনো শনাক্তযোগ্য ক্ষতি না হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘস্থায়ী উপসর্গগুলি থাকে।
লং কোভিডের সাধারণ লক্ষণ
করোনাভাইরাস সংক্রমিত বেশিরভাগ মানুষ উপসর্গবিহীন অথবা হালকা থেকে মাঝারি অসুস্থতার সম্মুখীন হয়। উপসর্গ শুরু হওয়ার ২-৩ সপ্তাহের মধ্যে উপসর্গগুলো হ্রাস পায়। কারও কারও ক্ষেত্রে করোনা নেগেটিভ হওয়ার পরে ৪ সপ্তাহের বেশি কিংবা তারও বেশি সময় ধরে করোনার বিভিন্ন উপসর্গে ভুগতে থাকে।
যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘থেরাপিজ ফর লং কোভিড স্ট্যাডি গ্রুপ’ লং কোভিড সম্পর্কে নির্দিষ্ট কিছু তথ্য দিয়েছে। দলটি সর্বাধিক সাধারণ লক্ষণ এবং দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকির কিছু সম্ভাব্য সূচক সম্পর্কে জানার জন্য লং কোভিড সম্পর্কে পূর্বে প্রকাশিত ২৭টি গবেষণার দিকে নজর দিয়েছে।
গবেষকদের দলটি দেখেছে যে, অসুস্থতার সময় ক্লান্তি, শ্বাস নিতে অসুবিধা, পেশী ব্যথা, জয়েন্টে ব্যথা, মাথাব্যাথা, গন্ধ এবং স্বাদের অনুভূতি নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো লক্ষণ ছিল। এছাড়াও ঘুমে সমস্যা, মস্তিষ্কে সমস্যা, স্মতিশক্তি হ্রাস ইত্যাদি সমস্যাও রয়েছে।
লং কোভিডের ঝুঁকিতে যারা
লং কোভিডের সাধারণ লক্ষণ সম্পর্কে জানার পাশাপাশি, গবেষকরা রোগীদের লং কোভিডের ঝুঁকিতে থাকার কারণ সম্পর্কেও জানতে পেরেছেন। গবেষকদের মতে, কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ রয়েছে রয়েছে যা দেখে লং কোভিডের ঝুঁকি সম্পর্কে বোঝা যেতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, করোনার হালকা সংক্রমণ দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা ঘটায় না। তবে যারা অসুস্থতার প্রথম সপ্তাহে পাঁচটির বেশি উপসর্গ অনুভব করে তাদের দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। বয়স্ক এবং নারীদের ক্ষেত্রে লং কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
লং কোভিডের প্রভাব
ল্যানসেট পত্রিকার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, করোনা থেকে সেরে ওঠার পর দুই সপ্তাহের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকগুন বশি থাকে। এসময় স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে প্রায় তিনগুন বেশি সম্ভাবনা থাকে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের।
সুইডেনের উমিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ গবেষক ওসভালদো ফনসেকা রদ্রিগেজ প্রায় ৮৬,৭৪২ জন করোনা আক্রান্তের ওপর করা গবেষণার ফলাফলে দাবি করেন, ‘করোনা পরবর্তী ১৪ দিনে হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি তিনগুন বৃদ্ধি পায়।’
ইউনিভার্সিটি মেডিসিন নিউরোসায়েন্সেস ক্লিনিকের অন্তর্গত স্ট্রোক সেন্টারের পরিচালক জেরেমি পাইন বলেন, সাধারণত বয়স্ক মানুষদের স্ট্রোক হয়, কিন্তু করোনা সংক্রমণে তরুণদেরও স্ট্রোক হতে দেখা গেছে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ৫০ বছরের কম বয়সী অনেক করোনা রোগী স্ট্রোকে মারা গেছেন।
করোনা টেস্টে পজিটিভ তরুণদের মধ্যে স্ট্রোক হতে দেখে চিকিৎসকেরা দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেছেন। দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, নিউ ইয়র্ক সিটিতে ৫০ বছরের কম বয়সি পাঁচজন করোনা রোগীর লার্জ ভেসেল স্ট্রোক (মস্তিষ্কের বড় ধমনীতে রক্ত জমাট বেঁধে সৃষ্ট স্ট্রোক) হয়েছে।
সান্টা মনিকাতে অবস্থিত প্রভিডেন্স সেন্ট জন’স হেলথ সেন্টারের অন্তর্গত প্যাসিফিক স্ট্রোক অ্যান্ড নিউরোসায়েন্সের পরিচালক ও ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজিস্ট জেসন টারপ্লি বলেন, ‘করোনাভাইরাস সম্ভবত রক্তনালীর ভেতরস্থ স্তরকে সংক্রমিত করে। এন্ডোথেলিয়াম হচ্ছে রক্তনালীর ভেতরস্থ স্তরের মসৃণ টিস্যু, যা রক্তের জমাটবদ্ধতা প্রতিরোধ করে। কিন্তু টিস্যুটি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে এমন কিছু পরিস্থিতি তৈরি হয় যাদের সমন্বয়ে রক্ত জমাট বাঁধে। এছাড়া করোনা সংক্রমণে রক্ত জমাট বাঁধাতে পারে এমন প্রোটিনের মাত্রাও বেড়ে যায়, যাকে ডি-ডাইমার বলে।’
ডা. পাইন বলেন, ‘শরীরের সর্বত্র প্রভাব বিস্তারকারী প্রদাহজনিত রোগ স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে, কারণ প্রদাহ রক্তকে জমাট বাঁধতে প্ররোচিত করে। প্রদাহে ধমনীর প্লেক সক্রিয় হয়ে আরো আঠালো ও স্থির হয়।একারণে ফ্লু সিজনে স্ট্রোকের হার বেড়ে যায়। এই একই মেকানিজম করোনা রোগীদের মধ্যেও ঘটতে পারে।’ আপনি হয়তো ইতোমধ্যে জেনেছেন যে করোনা সংক্রমণেও শরীর প্রদাহিত হয়।
মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয়
বলা হচ্ছে, করোনায় মানসিক স্বাস্থ্যের চরম বিপর্যয় হয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, করোনার প্রথম বছরেই বিষন্নতাজনিত রোগ পাঁচ গুণ এবং উৎকণ্ঠাজনিত রোগ ১০ গুণ বেড়েছে।
মানসিক অবসাদে ভুগছেন কোন বয়সের মানুষ সবচেয়ে বেশি?
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, মহামারির প্রথম বছরে বিশ্বব্যাপী হতাশা ও উদ্বেগের ঘটনা এক-চতুর্থাংশের বেশি বেড়েছে। বিশেষ করে নারী ও তরুণদের মধ্যে তা বেশি প্রভাব ফেলেছে।
কোভিডের ঝুঁকি কমায় টিকা?
করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকা নিলে তা ভাইরাস থেকে সম্পূর্ণভাবে প্রতিরোধী করে তোলে না। এটি গুরুতর অসুস্থতার ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে মাত্র। এটি অসুস্থতার বিরুদ্ধে একটি নির্দিষ্ট স্তরের সুরক্ষা প্রদান করে এবং হাসপাতালে ভর্তির ঝুঁকি হ্রাস করে। যদিও সম্ভাবনা অত্যন্ত কম তবে টিকা নিলেও লং কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
করোনা পরবর্তী যত্ন
করোনা নেগেটিভ হওয়া মানেই এই নয় যে আপনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেছেন। নেগেটিভ হওয়ার অর্থ হলো আপনি কেবল অর্ধেক যুদ্ধ জয় করেছেন। নেগেটিভ হওয়ার পরও উপসর্গগুলো দীর্ঘ সময় ধরে থেকে যেতে পারে। আগের অবস্থায় ফিরে আসার ক্ষেত্রে প্রচুর যত্ন নেওয়া প্রয়োজন।
এজন্য একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্যতালিকা মেনে চলুন। হালকা ব্যায়াম চালিয়ে যান। ক্রমাগত ক্লান্তির কারণে, আপনার পথে চলতে অসুবিধা হতে পারে, তবে চলাচলহীন জীবনযাপন করবেন না। হাইড্রেটেড থাকুন এবং পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার খান যা আপনাকে পর্যাপ্ত শক্তি প্রদান করতে পারে। আপনার লক্ষণগুলো পর্যবেক্ষণ করতে থাকুন সতর্কতার সাথে এবং সে মতে আপনার ডাক্তারের সাথেও যোগাযোগ রাখুন।
সূত্র: ডয়চে ভেলে, দ্য গার্ডিয়ান, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।