অক্টোবর ৩০, ২০২৩, ০৯:৪৩ পিএম
অসাধু মহল ডেঙ্গুকে কেন্দ্র করে অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছে। দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট পূর্বসতর্কতা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মপরিকল্পনা থাকার পরও সরকার এতে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়নি।
মশাবাহিত এই রোগটি মোকাবিলায় ব্যর্থতার দায় অনৈতিকভাবে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব এড়ানোর কারণে সারা দেশে এ বছর সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
সোমবার (৩০ অক্টোবর) ডেঙ্গু নিয়ে এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেছে টিআইবি।
‘ডেঙ্গু সংকট প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এই গবেষণা প্রতিবেদনে ডেঙ্গু চিকিৎসায় নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ডেঙ্গুর প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক ও সরকারিভাবে পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নিজেদের মধ্যে সমন্বয় না করে যার যার মতো কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
“অন্য দেশ থেকে আমরা ভালো করছি এবং আমাদের উদ্বেগের কারণ নেই”—সংসদে এমন কথা বলে আত্মতুষ্টিমূলক প্রচারণাও চালানো হয়েছে। মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এখনও শুধুমাত্র রাসায়নিক পদ্ধতির (লার্ভিসাইড ও অ্যাডাল্টিসাইড) মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে।
কিছু কিছু এলাকায় পাবলিক প্লেসে মশার প্রজনন স্থল ধ্বংস করা হলেও এখনও ঘরে ঘরে মশার প্রজনন স্থল চিহ্নিতকরণ ও ধ্বংস করার কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। কোনো কোনো এলাকায় পাঁচ থেকে ২৭ বছর ধরে একই কীটনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে।
যদিও কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য গবেষকরা বলছেন, বছরের পর বছর একই কীটনাশক ব্যবহার করলে এর কার্যকারিতা কমে যায়।
ডেঙ্গু চিকিৎসায় সরকারের ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, ডেঙ্গু চিকিৎসা ব্যবস্থায় সক্ষমতার ঘাটতি ছিল প্রকট। বাংলাদেশে মোট ডেঙ্গু মৃত্যুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ষাটোর্ধ্ব বয়সী ব্যক্তিদের (১৯%)। ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি তথা নারী ও বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি-বিষয়ক কার্যক্রম বা চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ গ্রহণে ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে।
অন্যদিকে, জনস্বাস্থ্য সংকটকে কাজে লাগিয়ে দুর্নীতি ও অনিয়মের ঘটনা উঠে এসেছে গবেষণায়। মশা নিধনে দায়িত্বপ্রাপ্ত মাঠ কর্মীদের ১০০-৫০০ টাকা দিলে বাড়িতে গিয়ে `অধিক কার্যকর` ওষুধ দিয়ে আসার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও অনিয়ম-দুর্নীতি পরিলক্ষিত হয়েছে। বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ১০০ টাকার শিরায় দেওয়া স্যালাইন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। আবার, ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু পরীক্ষার সুবিধা অপ্রতুল ছিল।
যে কোনো দুর্যোগের মতো ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে স্বার্থান্বেষী মহল দুর্নীতি ও অনিয়মের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করেছে উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, `গবেষণায় আমরা দেখেছি, ক্রয়-প্রক্রিয়ায় উন্মুক্ত প্রক্রিয়ার নামে "সিংগেল বিডিং" বেশি হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশের যোগসাজশে অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট প্রতারণামূলকভাবে লাভবান হয়েছে। আমরা দেখেছি, একদিকে যেমন ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকার ও সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে এবং সে দায় অনৈতিকভাবে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে তেমন সেবাগ্রহণের ক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতাদের অযাচিতভাবে অধিক মূল্য প্রদান করতে হয়েছে।
ডেঙ্গু মোকাবিলায় সকল আক্রান্ত অঞ্চলে জনবল ও আর্থিক বরাদ্দের ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক অবস্থা পরিলক্ষিত হয়েছে। জবাবদিহিতার অভাবের কারণে অর্থের অপচয় হয়েছে এবং তা থেকে অসাধু মহল সুবিধা নিয়েছে।`
ডেঙ্গু প্রতিরোধে ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সুশাসন নিশ্চিত করতে ২১ দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি। উল্লেখযোগ্য সুপারিশের মধ্যে আছে—ডেঙ্গুকে জাতীয় স্বাস্থ্য সংকট হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সমন্বয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা ও মানদণ্ড অনুসরণ করে এডিস মশাসহ অন্যান্য মশা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে `ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান` প্রণয়ন করা, পরিকল্পনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাত ও প্রতিষ্ঠান এবং অংশীজনদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সুনির্দিষ্ট করে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা,পরিকল্পনা অনুসারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয়/দপ্তরের কর্মকর্তা, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, কীটতত্ত্ববিদ, এনজিও প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে `ডেঙ্গু প্রতিরোধ-বিষয়ক জাতীয় কমিটি` করা ইত্যাদি।