সকালে উঠে আয়নায় তাকিয়ে যদি হঠাৎ করে নিজেকে বেশি বয়স্ক মনে হয়, স্পষ্ট হয়ে ওঠে বার্ধক্যের ছাপ -তাহলে একে ভ্রম বা কল্পনা ভাবার সুযোগ নেই। এর পেছনে থাকতে পারে বৈজ্ঞানিক কারণ।
চিরাচরিত ধারণা এই যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বুড়িয়ে যায়। বার্ধ্যক্যে পৌঁছানো সরলরেখার মতো একটা ঘটনা। যা নির্দিষ্ট গতিতে ধীরে-ধীরে ও নীরবে ঘটে যায়। সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে ঠিক উলটো কথা।
সরলরৈখিক গতিতে, ধীরে-ধীরে মানুষ বার্ধক্যে পৌঁছায় না। বার্ধ্যক্যে পোঁছানোর পুরো প্রক্রিয়াটা ঘটে হঠাৎ করে, তাৎক্ষণিকভাবে এক লাফে। আর মানুষের সমগ্র জীবনে অন্তত দুইবার এই হঠাৎ করে লাফ দেয়ার মুহূর্ত এসে উপস্থিত হয়। প্রথম মুহূর্তটি উপস্থিত হয় মানুষের জীবনের মধ্য চল্লিশের সময়ে, নির্দিষ্ট করে বললে ৪৪ বছর বয়সে। দ্বিতীয় মুহূর্তটি আসে ষাটের কাছাকাছি সময়ে। গবেষণা বলছে, মানুষের জীবনের এই দুই গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে, মানুষের বয়স আকস্মিকভাবে -মুহূর্তেই -এক লাফে বেড়ে যায়।
নেচার এজিং জার্নালে প্রকাশিত এ গবেষণায় ১০৮ জন স্বেচ্ছায় অংশ নেন। প্রত্যেকে নিয়মিতভাবে কয়েক মাস পর পর রক্ত ও মল-মূত্রের নমুনা এবং ত্বক, মুখগহ্বর ও শ্লেষ্মা বা কফ জমা দেন। গড়ে প্রায় ৭ বছর পর্যন্ত এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তারা। গবেষণায় অংশ নেয়া প্রত্যেকের বয়স ২৫ থেকে ৭৫ বছরের মধ্যে। এরা প্রত্যেকেই ক্যালিফোর্নিয়ার অধিবাসী, সুস্থ-সবল ও বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর।
গবেষণার প্রধান লেখক ও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জিনতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মাইকেল স্নাইডার বলেন, ‘আমরা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হই না; পরিবর্তন ঘটে নাটকীয়ভাবে। মধ্য চল্লিশ ও ষাটের কাছাকাছি বয়সে এসে এই নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। মানবদেহের যে-কোন কোষের ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটতে দেখা যায়।’
গবেষকরা স্বেচ্ছাসেবকদের অন্ত্র ও ত্বক থেকে প্রায় ১,৩৫,০০০ অণু-আরএনএ, প্রোটিন ও মেটাবোলাইট এবং মাইক্রোবস- ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ছত্রাক নিয়ে বিশ্লেষণ করে পরিবর্তনের ধরণগুলি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন।
স্নাইডার ও তার সহকর্মীরা দেখেন যে, বেশিরভাগ অণু এবং মাইক্রোবসের পরিবর্তন ঘটে খুব ধীর গতিতে। এদের পরিবর্তন পর্যায়ক্রমে ঘটেনি। উল্লেখযোগ্য স্পষ্ট পরিবর্তন ঘটে দু’টি নির্দিষ্ট ধাপে- মধ্য-চল্লিশ ও ষাট বছর বয়সের কাছাকাছি সময়ে। অণু ও মাইক্রোবসের প্রায় ৮১ শতাংশের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাদের পরিবর্তন এই দুই ধাপের একটিতে বা উভয়টিতে ঘটে।
প্রথম পর্যায়ের পরিবর্তনের সময়ে ক্যাফেইন মেটাবোলাইজ বা বিপাক করার ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। বিশেষ করে মদজাতীয় পানীয়ের কারণে মেটাবোলাইজ বা বিপাক করার ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ, কার্বোহাইড্রেট বিপাক এবং কিডনি কার্যকারিতা কমে যায়। বিশেষত, ৬০ বছর বয়সের পর রোগের ঝুঁকি দ্রুত বাড়তে থাকে। এ পর্যায়ে এসে, ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সের মানুষ কার্ডিওভাসকুলার সমস্যা, কিডনি সমস্যা এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসে বেশি আক্রান্ত হয়।
স্নাইডার বলেন, অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দেখা যায়, ‘মানুষ সাধারণত ৪০ বছর বয়সে এসে পেশির ইনজুরিতে পড়ে এবং শরীরে মেদ জমতে শুরু করে, এবং ৬০ বছর বয়সে অবশ্যই সারকোপেনিয়া বা মাংসপেশি ক্ষয় হতে শুরু করে। বিষয়টি খুব তাৎপর্যপূর্ণ।’
গবেষকরা আরও লক্ষ্য করেন যে, আলঝেইমার এবং কার্ডিওভাসকুলারের মতো রোগের ঝুঁকিও সময়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে বাড়ে না। বরং একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর তা হঠাৎ করেই বেড়ে যায়। তাই তারা বয়সজনিত পরিবর্তনের জীবচিহ্নগুলোর দিকে আরও গভীরভাবে নজর দিতে চেয়েছিলেন, যাতে পরিবর্তনগুলো শনাক্ত করা যায়। এই ফলাফল থেকে ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব যে কেন কিছু নির্দিষ্ট বয়সে পেশি ও হাড়ের সমস্যা এবং হৃদরোগের মতো স্বাস্থ্য-সমস্যা বেড়ে যায়। ত্বক, পেশি এবং কার্ডিওভাসকুলার বা রক্তনালীর পরিবর্তনের ব্যাখ্যা করতেও এটি আমাদের সাহায্য করে।
মধ্য-চল্লিশে বয়সজনিত পরিবর্তনটি থেকে ধারণা করা হয়েছিল যে, নারীদের মেনোপজাল বা ঋতুস্রাব একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময়টায় এমনটি ঘটে। মেনোপজ বা রজঃনিবৃত্তি নারীদের একটি স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া। সাধারণত ৪৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সে নারীর পিরিয়ড বন্ধ হয়ে আসার ঘটনা ঘটে। এর মাধ্যমে নারীর বয়স হওয়াকে চিহ্নিত করা যায়। গবেষণায় দেখা যায় যে, এটি শুধু নারীদের ক্ষেত্রেই ঘটে না, পুরুষদের ক্ষেত্রেও একই ধরনের পরিবর্তন ঘটে।
এ বিষয়ে নানইয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির মাইক্রোবায়োম মেডিসিনের সহকারী অধ্যাপক এবং গবেষণার অন্যতম প্রধান লেখক ড. শিয়াওতাও শেন বলেন, ‘নারীদের ক্ষেত্রে, মধ্য-চল্লিশে এসে পরিবর্তনের ঘটনায় মেনোপজ বা রজঃনিবিৃত্তির একটা প্রভাব আছে, এটা ঠিক। তবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এর বাইরেও এমন কিছু কারণ আছে যা এই পরিবর্তনের জন্য দায়ী, নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে।’ ভবিষ্যতের গবেষণায় এই কারণগুলি আবিষ্কার করা এবং এ বিষয়ে আরও গভীর অধ্যায়ন করা জরুরি বলে মনে করেন ড. শেন।
আগের এক গবেষণায়, ৭৮ বছর বয়সে ‘বার্ধ্যক্যে পৌঁছানোর’ আরেকটি পর্যায়কাল দেখা যায়। সাম্প্রতিক এ গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের বয়স ২৫ থেকে ৭৫ এর মধ্যে সীমিত থাকার কারণে এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি।
গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বলছেন, রোগনির্ণয় ও প্রতিরোধে এই ধরনের প্যাটার্ন সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। কেননা ‘চিকিৎসার যথোপযুক্ত সময়’ নির্ধারণের ক্ষেত্রে এটি সাহায্য করবে। ফলে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা ও বৃদ্ধ লোকদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে আরও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া সহজ হবে।
গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করে গবেষকরা পরামর্শ দেন যে, মানুষের জীবনের ৪৪ ও ৬০ বছর বয়সের এই পর্যায়কালে সবার সতর্ক থাকা উচিত। এই পর্যায়কালে পৌঁছানোর সময়ে কম অ্যালকোহল পান করা এবং বেশি ব্যায়াম করা জরুরি। বিশেষ করে ষাটের কাছাকাছি পর্যায়কালে আসার সময়ে কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ কমানো এবং কিডনি কার্যকারিতা উন্নত করতে প্রচুর পানি পান করা দরকার। সর্বোপরি, শেনের পরামর্শ হলো, ‘জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এই দুই পর্যায়ে নিজের প্রতি আরও বেশি যত্নবান হওয়া উচিত।’
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানবদেহে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে তা আরও ভালভাবে বোঝার জন্য এই বিষয় নিয়ে ভবিষ্যতে আরও গবেষণা হওয়া জরুরি। আরও বিশদ ও বিস্তৃত পরিসরে এটি অধ্যয়নের বিষয়বস্তুতে পরিণত হতে পারে বলেও গবেষকরা মনে করেন।