চিকিৎসার নামে রোগীকে হত্যা করেছে ল্যাবএইড! এমডিসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক

জুন ২৭, ২০২৩, ০৩:৫১ এএম

চিকিৎসার নামে রোগীকে হত্যা করেছে ল্যাবএইড! এমডিসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা

সংগৃহীত ছবি

গুরুতর অভিযোগ উঠেছে ঢাকার ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতালের বিরুদ্ধে। ওই হাসপাতালে ‘ভুল চিকিৎসায়’ এক কিশোরের মৃত্যুর অভিযোগে হাসপাতালটির ব্যাবস্থাপনা পরিচালকসহ সাতজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে আদালতের পর্যবেক্ষণ হল: “এটি চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ হিসাবে নয়, বরং সরাসরি হত্যা মামলা হিসাবে নিতে হবে।”

জানা গেছে, তাহসিন হোসেইন নামের ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরের বাবা মনির হোসেন আজ  সোমবার ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে ওই মামলাটি দায়ের করেন।

তার আইনজীবী তানভীর আহমেদ সজীব জানান, বিচারক বেগম ফারাহ দিবা ছন্দা বাদীর আর্জি শুনে ধানমণ্ডি মডেল থানার ওসিকে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গণ্য করে নিয়মিত মামলা হিসেবে গ্রহণ করার আদেশ দিয়েছেন।

ওই মামলার আসামিরা হলেন: ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতালের ব্যাবস্থাপনা পরিচালক (এম ডি) ডা. এ এম শামীম, হাসপাতালের সার্জন ডা. মো. সাইফুল্লাহ, সহকারী সার্জন ডা. মাকসুদ, ডা. সাব্বির আহমেদ, ডা. মোশাররফ, ডা. তাজরিন ভূইয়া ও হাসপাতালের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার মো. শাহজাহান।

আসামিদের ‘অসৎ, আইন অমান্যকারী, ধূর্ত, প্রতারক’ প্রকৃতির লোক হিসেবেও বর্ণনা করা হয়েছে মামলার আরজিতে।

তবে অবহেলার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ল্যাবএইড হাসপাতালের এমডি এ এম শামীম। তিনি বলেছেন, আমরা এ বিষয়ে আইনি লড়াই চালাব।

মামলার আরজিতে বলা হয়, তাহসিন কিছুদিন থেকে অসুস্থ বোধ করায় গত ২৭ মার্চ তাকে ল্যাবএইডে ডা. সাইফুল্লাহর কাছে দেখানো হয়। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরামর্শ দেন।

ডা. সাইফুল্লাহ রোগির স্বজনদের বলেন, তাহসিনের অবস্ট্রাক্টিভ স্মল গাট বা নাড়ির প্যাঁচ রয়েছে। যার কারণে তার পেটে ব্যথা, সে মল ত্যাগ করতে পারছে না। দ্রুত অস্ত্রোপচার না করলে ‘বড় ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি’ রয়েছে।

পরে গত ২৮ মার্চ অস্ত্রোপচার করে ‘মলদ্বারের অংশ অপসারণ’ করা হয়। কিন্তু তারপর তাহসিনের অবস্থার অবনতি হতে থাকে। তাহসিনের স্বজনরা এ অবস্থায় ডা. সাইফুল্লাহর সাথে দেখা করতে চাইলে তিনি সাক্ষাৎ দিতে ‘অস্বীকৃতি’ জানান।

এক পর্যায়ে ডা. মাকসুদ বলেন, তাহসিনের অস্ত্রোপচার সফল হয়নি। রোগীকে সুস্থ করতে হলে আবার অপারেশন করতে হবে।

ডা. মাকসুদের কথায় অসহায় তাহসিনের পরিবার তার দ্বিতীয় অস্ত্রোপচারের জন্য টাকা জমা দিয়ে ব্রাঞ্চ ম্যানেজার শাহজাহানকে সেই স্লিপ দেয়। ডা. সাইফুল্লাহ ৬ এপ্রিল ডা. সাব্বির, ডা. মোশাররফ এবং ডা. তাজরিনকে দ্বিতীয়বার অস্ত্রোপচার করেন।

কিন্তু দ্বিতীয়বার অপারেশনের পর মনির হোসেন ছেলের অবস্থা জানতে চাইলে ডা. মাকসুদ তাকে আশ্বস্ত করে বলেন, অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে। তাহসিনের অবস্থা স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে এবং জরুরি ভিত্তিতে তাকে রক্ত দিতে হবে। পরের সাত দিনে ডাক্তারের কথায় ১০ ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা করেন তাহসিনের বাবা মনির।  

মনিরের ভাষ্য, এক মাস পার হলেও ছেলের অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় তিনি ডা. সাইফুল্লাহ এবং ডা. মাকসুদের কাছে পরিস্থিতি জানতে চান। কিন্তু তারা কোনো ‘সদুত্তর দিতে পারেননি।’

এরপর রোগীর অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে থাকে এবং দীর্ঘ তিন মাস চিকিৎসা চলার পর গত ২৩ জুন ওই কিশোরের মৃত্যু হয়।

মামলার আর্জিতে বলা হয়, তিন মাসে তাহসিনকে ১৪৪ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসা ব্যয় হিসেবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রায় ২৭ লাখ টাকা বিল করেছে। এর মধ্যে দশ লাখ ৬৫ হাজার টাকা পরিশোধ করে হাসপাতাল থেকে সন্তানের লাশ নিয়ে দাফনের ব্যবস্থা করেন মনির হোসেন।

মনির হোসেন অভিযোগ করেন, তিন মাস ধরে তার ছেলের ‘অপচিকিৎসা’ হয়েছে। ল্যাবএইড হাসপাতালে তাহসিনের ‘সঠিক চিকিৎসা সম্ভব না জানার পরও অবৈধভাবে লাভবান হওয়ার জন্য’ আসামিরা রোগীকে হাসপাতালের আইসিইউতে ‘আটকে রেখে হত্যা করেছেন।’ যোগাযোগ করতে গেলে আসামিরা বাদীকে বারংবার ‘অপমান অপদস্ত’ করেন এবং এক পর্যায়ে ‘আপস করলে বিলের টাকা মওকুফ’ করে দেওয়ার প্রস্তাব দেন।

আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থিত সাংবাদিকদের মনির হোসেন বলেছেন, আমি ডা. সাইফুল্লাহকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি, আমার ছেলের সমস্যা কী? কিন্তু উনি সঠিক করে কিছুই বলতে পারেননি। তিনি যে আমার ছেলের ভুল চিকিৎসা করেছেন, তা একশ ভাগ নিশ্চিত। এ সময়ে আমার ছেলেকে ১৪৪ ব্যাগ রক্ত দিতে হয়েছে। আমি প্রথম অপারেশনের পর এখান থেকে রিলিজ নিয়ে ভারতে চিকিৎসা করাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষ রোগীকে ছাড়পত্রও দেয়নি।

মনির কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, চিকিৎসার নামে ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষ এবং এই চিকিৎসকরা আমার ছেলেকে তিলে তিলে হত্যা করেছে। আমি এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। আর কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়।

অভিযোগ প্রসঙ্গে ল্যাবএইড হাসপাতালের এমডি ডা. এ এম শামীম গণমাধ্যমকে বলেন, ওই রোগীর অবস্থা ক্রিটিক্যাল ছিল। আমাদের এখানে তিন মাসের বেশি সময় ধরে ভর্তি ছিল। আমরা মেডিকেল বোর্ড গঠন করে রোগীর স্বজনদের বলেছিলাম তাকে দেশের বাইরে নিতে। কারণ ওই চিকিৎসা আমাদের এখানে নেই। এক পর্যায়ে সপ্তাহখানেক আগে রোগীটা মারা যায়। তারা মামলা করেছে, আমরা সেটা ফেস করব।

Link copied!