হামাসের আকস্মিক হামলায় ওলট-পালট মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

অক্টোবর ১২, ২০২৩, ০৯:৪৩ পিএম

হামাসের আকস্মিক হামলায় ওলট-পালট মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতি

গত সপ্তাহের শেষ পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্য তুলনামূলক শান্ত ছিল বলে জো বাইডেনের প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যে নিজের দ্বিমুখী কৌশল নীরবে বাস্তবায়ন করেই যাচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্র সৌদি-ইসরাইল সম্পর্কের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে আরও জোরালোভাবে প্রবেশ করতে চায়। সাথে ইরানের পারমাণবিক উচ্চাভিলাষকেও আটকে রাখতে চায়। কিন্তু হামাসের ভয়াবহ রকেট হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের সেই কৌশলের চিত্রই বদলে গেছে।

গত শনিবার ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশ্রস্ত্র গোষ্ঠী হামাস যোদ্ধারা গেরিলা কায়দায় চারদিক থেকে ইসরায়েলের শহরগুলোতে ঢুকে তাণ্ডব চালিয়েছে। তাদের হামলায় শত শত সামরিক-বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে এবং অনেককে অপহরণ করা হয়েছে।

ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনিদের আকস্মিক এই কঠিন সংঘাত যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্য নীতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।  

এখন হামাস যা করেছে তা একটি আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হতে পারে। ফলে এর সাথে সাথে মধ্যপ্রাচ্যের সমস্ত হিসাবও পাল্টে গেছে। হামাস তার শক্তি দেখিয়েছে এবং গাজার বাইরেও তার ঘাঁটি প্রসারিত করেছে। ফলে সংঘাত সঙ্কোচন না হয়ে আরও প্রসারিত হয়েছে।

এদিকে ইরান দীর্ঘ দিন ধরে হামাসকে সমর্থন দিয়ে আসছে। তারা এর মাধ্যমে কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরাইল-সৌদি সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণকে ভেস্তে দিতে চায় ইরান। ইরান মনে করে, সৌদি-ইসরাইল সম্পর্কের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে আরও জোরালোভাবে প্রবেশ করবে যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের লক্ষ্যই যুক্তরাষ্ট্রের এই কৌশলকে প্রতিহত করা।

এদিকে মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘদিনের শত্রু ইসরায়েল ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনে তাদের প্রচেষ্টা সংকট কাটিয়ে উঠবে বলে তারা আশাবাদি। তবে অনেক বিশেষজ্ঞই সে ক্ষেত্রে হতাশা ছাড়া আর কিছু দেখছেন না।

ওয়াশিংটনভিত্তিক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক প্রোগ্রামের প্রধান জন অল্টারম্যানের কথায় হতাশার সেই সুর আরও স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ভাষ্যের বিপরীতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘স্বাভাবিকীকরণের সমস্ত প্রচেষ্টা যে অদূর ভবিষ্যতের জন্য আটকে গেল, তা খুব সহজেই বলা যায়।’

হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জন কিরবি সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আলোচনা স্থগিত করা হয়েছে বা পিছিয়ে গেছে — এমন কড়া কথা তিনি বলতে চান না। তবে আপাতত ইসরায়েলকে ‘আত্মরক্ষায়’ সহায়তা দিতে পুরো মনোযোগ নিবদ্ধ রাখবে ওয়াশিংটন।

মধ্যপ্রাচ্যে সাবেক মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জোনাথন প্যানিকফ বলছেন, নতুন এই যুদ্ধের পরে আরবের পথ স্বাভাবিকীকরণের গন্তব্যে যাবে না। কারণ, এরই মধ্যে ইসরায়েলি হামলা গাজার বেশিরভাগ অঞ্চল মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে।’

সৌদি আরব সংশ্লিষ্ট এক সূত্র একই সূরে গলা মিলিয়ে বলছে, আরেকটি আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের কথা বলা বোধ হয় কঠিন হবে।  

মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে ওঠা চীনের উচ্চাভিলাষও এই ঘটনায় বড় ধাক্কা খেয়েছে। গত মার্চে চীনের মধ্যস্ততায় সৌদি-ইরান চুক্তির পর ওয়াশিংটনের দীর্ঘ আধিপত্য বলয়ে থাকা এই অঞ্চলে বেইজিংয়ের নজরকাড়া উপস্থিতি নিয়ে দেশটির গণমাধ্যমে বেশ হইচই হয়। বিশ্বজুড়ে ‘হটস্পট ইস্যু’ বা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় চীন গঠনমূলক অবদান রাখবে বলে তখন দেশটির শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ই ঘোষণা দেন।

হামাসের হামলার ঘটনার পর চীন সরকারের মুখপাত্র হামাসকে নিন্দা না জানিয়ে ‘উত্তেজনা প্রশমনের’ ডাক দেন এবং সংকট মোকাবিলায় ফিলিস্তিনে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ‘দুই রাষ্ট্র নীতি’ গ্রহণে উভয় পক্ষকে আহ্বান জানান। তবে, বিষয়টি নিয়ে চীনের শীর্ষ নেতা সি চিন পিং মুখ খোলেননি।

চীন-মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্ক নিয়ে কাজ করেন নেদারল্যান্ডসের ইউনিভার্সিটি অব গ্রোনিনজেনের সহকারী অধ্যাপক বিল ফিগোয়েরোয়া। তিনি বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জন্য অবদান রাখার হাকডাক করে চীন যে ভাবমূর্তি তৈরি করল, তাতে চিড় ধরাল ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ। আর এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় চীনকে নতুন করে ভাবতে হবে।

গত জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) বিকল্পে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও সৌদি আরবকে সঙ্গে নিয়ে ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ করিডর (আইএমইসি) প্রকল্পের ঘোষণা আসে। কিন্তু হামাসের হামলার পর আরব বিশ্বের অবস্থানের প্রেক্ষাপটে এই করিডরের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

এছাড়া, দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে নয়াদিল্লি ভারসাম্য নীতি অনুসরণ করে আসলেও ইতোমধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরায়েলের প্রতি সংহতি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। ফলে, এই করিডর যেহেতু ইসরাইলকে সংযুক্ত করবে, সেহেতু এই উদ্যোগ যে অদূর ভবিষ্যতে আলোর পথ দেখবে তা আশা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

এদিকে দীর্ঘ সমর্থনের কারণে হামাসের এই হামলায় ইরান জড়িত বলে মনে করছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। যদিও তাঁদের কাছে তেহরানের সরাসরি জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ নেই। ইরান হামাসের হামলার প্রশংসা করলেও কোনো ধরনের ভূমিকা থাকার কথা অস্বীকার করেছে। তেহরান হামাসকে ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে হামলা চালিয়েছে বলে ইসরায়েলও অভিযোগের আঙুল তুলছে।

দ্য গার্ডিয়ানের কূটনীতি-বিষয়ক সম্পাদক প্যাট্রিক উইনটরের মতে, ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার যেকোনো প্রচেষ্টাকে অসম্ভব করে তুলতে চায় ইরান।

উইনটর বলছেন, সৌদি আরব ও ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক হলে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র সহজে শেকড় গাঁড়বে বলে মনে করে ইরান। আর একবার যদি সেটা সফল হয়, তাহলে ফিলিস্তিনিরা তাদের মদতদাতাকে হারাবে।

‘উপসাগরের যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে মদদ দিয়েছে, তারা ভুল ঘোড়ার ওপর সওয়ার হয়েছে’ বলে কয়েক দিন আগে কড়া সাংকেতিক বার্তা দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। তিনি বলেন, যেসব দেশ ইহুদিবাদীদের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ঝুঁকি নিচ্ছে, তারা দ্রুতই এর পরিণতি ভোগ করবে। আজ ইহুদিবাদীদের সাথে সম্পর্ক করার ভুল তাদের করা উচিত নয়।

গত শুক্রবার তার সাথে যোগ দিয়েছিলেন ইসলামিক জিহাদের প্রধান জিয়াদ আল-নাখালা। তিনি বলেন, যারা ইহুদিবাদীদের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের দিকে ধাবিত হয় তাদের অবশ্যই জানা উচিত যে, এর মধ্য দিয়ে তারা স্বীকার করে নেবে যে ফিলিস্তিন আমাদের নয়, জেরুসালেম ও তার মসজিদগুলো আমাদের নয়।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, হামাসের এই হামলায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ‘অপ্রতিরোধ্য’ বলে খ্যাতি ম্লান হয়ে গেছে। এর ফলে ইসরায়েলের সঙ্গে ‘ছায়া যুদ্ধ’ বাড়াতে সাহসী হবে ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্রকে ঠেকাতে আঞ্চলিক ‘প্রক্সি’ অর্থাৎ সহায়ক শক্তিগুলোকে ব্যবহার করবে।

এদিকে হামাসের হামলার সৃষ্ট যুদ্ধে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে সৌদি আরব। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক সব পক্ষীয় উদ্যোগের সঙ্গেই আছে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বে নতুন রাজতন্ত্র। সৌদি আরব তেলের উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে, এখন বিদেশি বিনিয়োগের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে এবং ইসরায়েলের প্রযুক্তির জন্য ক্ষুধা তৈরি হয়েছে। ক্রমবর্ধমান লেনদেনমূলক কূটনীতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়া রিয়াদ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রতিরক্ষা নিরাপত্তাও চায়।

ফিলিস্তিনের ‘উপদল ও দখলদার বাহিনীর’ মধ্যে ‘অভূতপূর্ব পরিস্থিতি’র কথা তুলে ধরে সব পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে সৌদি আরব।

সেই সঙ্গে ইসরায়েলের নাম না ধরে ‘টানা দখলদারিত্ব, বৈধ অধিকার থেকে ফিলিস্তিনি জনগণকে বঞ্চিত রাখা এবং পবিত্র স্থানে (আল-আকসা) যাওয়া নিষেধাজ্ঞা এবং পদ্ধতিগত উসকানির পুনরাবৃত্তির ফলে পরিস্থিতি যে বিস্ফোরিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে, সে বিষয়ে আগের সতর্কবাণী’ স্মরণ করিয়ে দেয় রিয়াদ। ফিলিস্তিনের স্বাধীন রাষ্ট্রের ওপরও জোর দিয়েছে। কিন্তু রিয়াদের এই প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলের জন্য মোটেই উৎসাহব্যঞ্জক নয়।

এদিকে কূটনৈতিকেরা মনে করেন, মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মিসরকে আশা করা যায়। কিন্তু, দুই মাসের নির্বাচনের মুখে থাকা মিশর এই মুহূর্তে গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ হজম করতে পারবে না।

গাজায় ব্যাপক হামলার সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে মিসরের মাধ্যমে ইসরায়েলকে আগেই বার্তাও পাঠিয়েছে হিজবুল্লাহ। তবে ইসরায়েল এরই মধ্যে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে এবং এখন স্থলভাগ দিয়ে গাজায় প্রবেশের পরিকল্পনা করছে। এর মধ্যে হিজবুল্লাহও পাল্টা হামলায় অংশ নিয়েছে।

ইসরায়েলকে উত্তেজনা প্রশমনে, স্থলভাগে হামলার পরিকল্পনা বন্ধ রাখতে, হামাসকে আলোচনায় বাধ্য করতে গাজার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করার মতো পদক্ষেপের সীমাবদ্ধ থাকতে যুক্তরাষ্ট্র আহ্বান জানাচ্ছে।

ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধের পর মেনাখেম বিগিন এসে ১৯৭৮ সালে মিশরের আনোয়ার সাদাতের সঙ্গে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির পথ করে দিয়েছিলেন।

তবে এই মুহূর্তে সে ধরনের ইতিবাচক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা বেশ কম। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি স্থাপনে কোন ধরনের কূটনীতি সফল হবে—সেটাই দেখার অপেক্ষা। 

তথ্যসূত্র: রয়টার্স, দ্য গার্ডিয়ান, ফরেন পলিসি, আল-জাজিরা

Link copied!