সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতির টানাপোড়েনের মধ্যে যেভাবে নেপালের জেন-জিরা বেছে নিলেন অর্ন্তবর্তী সরকার প্রধান

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২৫, ০৮:২২ এএম

সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতির টানাপোড়েনের মধ্যে যেভাবে নেপালের জেন-জিরা বেছে নিলেন অর্ন্তবর্তী সরকার প্রধান

এক সপ্তাহের সহিংস ও ধ্বংসাত্মক বিক্ষোভের পর নেপালের প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পাওডেল শুক্রবার সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কিকে অন্তর্বর্তীকালীন নাগরিক সরকারের প্রধানমন্ত্রীর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। খবর নেপালি টাইমস-এর।

বৃহস্পতিবার থেকে প্রেসিডেন্ট পাওডেল আন্দোলনকারীদের তরুণ প্রতিনিধিদের সঙ্গে পরামর্শ করে আসছিলেন। এ আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ, সংসদের স্পিকার ও সেনাপ্রধানও। শেষ পর্যন্ত ঐকমত্যে কার্কিকে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রীর পদে মনোনীত করা হয়।

পার্লামেন্ট ভাঙা নিয়ে টানাপোড়েন

কার্কির শপথ অনুষ্ঠান বিলম্বিত হয় মূলত সাংবিধানিক প্রক্রিয়া নিয়ে মতপার্থক্যের কারণে। কার্কি ও তরুণ আন্দোলনকারীরা দাবি করেছিলেন, অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের আগে সংসদ ভেঙে দিতে হবে। কিন্তু প্রেসিডেন্টের যুক্তি ছিল, নতুন মন্ত্রিসভা নির্বাচনের ঘোষণা দিলেই সংসদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

জেনারেশন জেড আন্দোলনের প্রতিনিধি সুধান গুরুঙ স্পষ্ট করে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর আস্থা না থাকায় সংসদ ভাঙা তাদের জন্য অ-আলোচনাযোগ্য শর্ত। 


তিনি হুঁশিয়ারি দেন, এ দাবি না মানা হলে আবার রাস্তায় নেমে আসবে তরুণরা। শেষ পর্যন্ত রাতের মধ্যে সরকার গঠন না হলে সেনাবাহিনীর জরুরি অবস্থা ঘোষণার ঈঙ্গিতের পর নেপালের প্রেসিডেন্ট নতি স্বীকার করেন।

এর মাধ্যমে নেপালের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিলেন ৭৩ বছর বয়সী সুশীলা কার্কি—এক দশক আগে যিনি হয়েছিলেন দেশের প্রথম নারী প্রধান বিচারপতি।

গত সপ্তাহে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতায় কমপক্ষে ৫১ জন নিহত হন, সারাদেশে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে।

তবে কার্কির নিয়োগ ঘোষণায় অনেকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন এবং একে জেনারেশন জেড আন্দোলনের রাজনৈতিক সংস্কারের বড় বিজয় হিসেবে দেখছেন।

প্রথমদিকে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রীর জন্য কাঠমান্ডুর মেয়র বালেন শাহ ও সাবেক বিদ্যুৎপ্রধান কুলমান ঘিসিংয়ের নামও আলোচনায় ছিল।

তবে দুজনই আগ্রহ দেখাননি, কারণ তারা পরবর্তী নির্বাচনে অংশ নিতে চান।

বিচারবিভাগীয় অভিজ্ঞতা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কারণে কার্কিই আন্দোলনকারীদের পছন্দের প্রার্থী হয়ে ওঠেন।

সেনা-রাষ্ট্রপতি টানাপোড়েন
আলোচনার স্থান প্রথমে সেনা সদর দফতরে থাকলেও পরে সেটি সরিয়ে আনা হয় প্রেসিডেন্টের বাসভবন শীতল নিবাসে। কারণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও নাগরিক সমাজে সেনাবাহিনীকে প্রেসিডেন্টকে আটকে রাখার অভিযোগে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। এ নিয়ে এমনকি রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার গুজবও ছড়িয়ে পড়ে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সিনিয়র সাংবাদিক কিশোর নেপাল লেখেন, সেনাপ্রধান অশোকরাজ সিগদেল নাকি প্রেসিডেন্টকে সরে দাঁড়াতে বলেন। জবাবে প্রেসিডেন্ট পাওডেল বলেন, “আমি পদত্যাগ করব না। আমাকে মেরে আন্দোলনকারীদের ওপর দোষ চাপান, তারপর যা খুশি করুন।”

সাহসী বিচারপতি থেকে রাজনীতির শীর্ষে

২০১৬ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত নেপালের প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সুশীলা কার্কি। দুর্নীতিবিরোধী রায়ে তিনি আলোচনায় আসেন। এর মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধানকে অযোগ্য ঘোষণা, তথ্য ও যোগাযোগমন্ত্রী জয়প্রকাশ গুপ্তর দণ্ডাদেশ এবং সাবেক মাওবাদী সাংসদ বলকৃষ্ণ ধুঙ্গেলের হত্যার দায়ে সাজা বহাল রাখার মতো ঐতিহাসিক রায় ছিল।

১৯৫২ সালে বিরাটনগরে জন্ম নেওয়া কার্কি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেন ভারতের বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং পরে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি আইনজীবী হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি শিক্ষকতাও করেছেন। ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য তাকে কারাবরণও করতে হয়েছিল।

সামনে চ্যালেঞ্জ

অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করলেও কার্কির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। বিভিন্ন গোষ্ঠী, জেনারেশন জেড আন্দোলনের নেতারা, টেকনোক্র্যাট এবং বিদ্যমান রাজনীতিবিদদের সমন্বয়ে তাকে মন্ত্রিসভা গঠন করতে হবে।

একইসঙ্গে মুক্ত ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন, সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক ভারসাম্যে রাখা এবং চীন-ভারতের সঙ্গে নেপালের জটিল ভূরাজনৈতিক সম্পর্ক সামাল দেওয়াও তার জন্য কঠিন কাজ হবে।

সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হবে নেপালের রাজনীতি ও রাষ্ট্রযন্ত্র পুনর্গঠন করে একটি জবাবদিহিমূলক ও কার্যকর সরকার প্রতিষ্ঠার ভিত্তি গড়ে তোলা।
 

Link copied!