ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শত্রুতার রক্তাক্ত ইতিহাস

হাসনাত আসিফ কুশল

জুন ১৭, ২০২৪, ০৮:২৪ পিএম

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শত্রুতার রক্তাক্ত ইতিহাস

জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে থার্ড টেম্পল প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর ইসরায়েলিরা। যার কারণে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসকে রুখে দিতে চায় ইসরায়েল। গত বছর ৭ অক্টোবর গোষ্ঠীটি ইসরায়েলের অভ্যন্তরে নজিরবিহীন হামলা করে।

এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ সেদিন থেকেই গাজায় হামলা শুরু করে ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের তাবড় তাবড় রাষ্ট্রগুলো তাদের ওপর চাপপ্রয়োগ করে যাচ্ছে। উঠেছে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব। কিন্তু বিরোধীদের দাবির মুখেও গোয়ারগোবিন্দ নেতানিয়াহু সেদিকে কর্ণপাত করছেন না। তার দাবি, হামাসকে নির্মূল না করা পর্যন্ত গাজায় তথাকথিত অভিযান থামবে না।

এদিকে হামাস যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নিতে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। বলেছে, তারা এই প্রস্তাবকে ভালোভাবে দেখছে।

মসজিদ আল আকসাকে ঘিরেই ইহুদি ও মুসলিমদের মধ্যে সংঘাত

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হলো হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে এই সংঘাত কীভাবে সৃষ্টি হলো? সহজ কথায় বলতে গেলে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। হামাস সংশ্লিষ্ট আদর্শিক প্রচারণা যদিও এরও আগে থেকে শুরু হয় বলে গবেষকদের একাংশের অভিমত।

হাসান ও সায়েদ আহমেদ ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন। তারা তাদের গবেষণায় বলেছেন, ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও সত্তরের দশক থেকেই ফিলিস্তিনের ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠী ফাতাহকে নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করতে থাকে হামাস। তবে গবেষকদের আরেকটি অংশ মনে করেন যে হামাস মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি সামরিক শাখা থেকে সৃষ্টি হয়েছে।

মুসলিম ব্রাদারহুড
মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড হলো সুন্নী ইসলামী গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীর সদস্যরা সামাজিক ও ধর্মীয় রক্ষণশীলতা এবং মিশ্র অর্থব্যবস্থার ভিত্তি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গড়ে তোলার পক্ষপাতী ছিলেন। ১৯২৮ সালে হাসান আল-বান্না নামে একজন স্কুল শিক্ষক মুসলিম ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শুরু থেকেই পুর্নাঙ্গ ইসলামী শরিয়াহ বাস্তবায়নের পক্ষে জনমত গঠন করে আসছিলেন এই স্কুল শিক্ষক। ফিলিস্তিনিদের তিনি তার সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় বুঝিয়ে আসছিলেন, ইসলামী রীতি অনুযায়ী কীভাবে রাষ্ট্র গড়ে তোলা যায়।

ইসলামী সংস্কারক মুহাম্মদ আবদুহ ও রশিত রিদার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে হাসান আল-বান্না মনে করতেন, ইসলামের সামাজিক ঐতিহ্য হারানোর কারণ নিষ্কলুষ ফিলিস্তিনি জনসাধারণের ওপর পশ্চিমাদের কলুষিত প্রভাব এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ঔপনিবেশিক মনোভাব। সেই অভিপ্রায়ে মিশরে তিনি গড়ে তোলেন মুসলিম ব্রাদারহুড। শুরুতে এটা সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু ফিলিস্তিনি জনসাধারণের মুক্তির লক্ষ্যে খুব দ্রুতই দলটি পুরোদস্তুর রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হয়।

ওসমানিয়া খেলাফত বিলুপ্তি
ইসরায়েলের ইতিহাস পাঠের জন্য ওসমানিয়া খেলাফত সম্পর্কে কিঞ্চিত ধারণা থাকা আবশ্যক। ১৮৭৬ সালে সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ সিংহাসনে বসে অনুধাবন করেন যে সালতানাতের দুর্বল অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য একমাত্র পথ হলো সুযোগ্য খলিফা এবং তার শক্তিশালী অবস্থান। এ জন্য পূর্বসূরীদের মন্ত্রী ও অন্যান্য রাজকর্মচারীদের সরিয়ে দেন এবং নিজের ক্ষমতা বাড়াতে থাকেন।

সালতানাতের প্রশাসিক দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করেন। পাশ্চাত্য প্রভাবের বিপরীতে গিয়ে ওসমানিয়া রাষ্ট্রে ইসলামী রীতি বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব দিতে থাকেন। নিজের খলিফা পদকে শক্তিশালী করে মুসলিম ঐক্যের দিকে মনোযোগী হন। কিন্তু মুসলিম ঐক্যের গতি রুদ্ধ করার জন্য ১৮৮৯ সালে গঠন করা হয় ‘ইত্তেহাদ-ই-উসমানি জেমিয়েতি’ বা ‘কমিটি অব অটোম্যান ইউনিয়ন’ নামে একটি গুপ্ত সংগঠন। পরবর্তীতে সংগঠনটির নাম বদলে রাখা হয় ‘কমিটি অব ইউনিয়ন অব প্রগ্রেস রাখা হয়। এর ব্যানারে ওসমানিয়া খলিফা ও খেলাফতের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে থাকে তুর্কি জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহীরা।

এ সময় ওসমানিয়া খলিফাকে আরেকভাবে কাবু করতে চাইল ইহুদিরা। তারা মনে করল, অর্থনৈতিক ঋণ মেটানোর বিনিময়ে জেরুজালেমে বসতি স্থাপনের অনুমতি আদায়ের সুপারিশ করলে সুলতান আবদুল হামিদ নাখোশ হবেন না। কিন্তু ঘটল উল্টোটা। থিওডোর হার্জেল এই সুপারিশ নিয়ে সুলতান বা খলিফার সামনে দাঁড়াতেই জেরুজালেমের এক ইঞ্চি জমিও ছেড়ে দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দেন আবদুল হামিদ।

থিওডোর হার্জেলের প্রস্তাব প্রত্যাখানের পর কমিটি অব ইউনিয়ন অ্যান্ড প্রগ্রেসের মাধ্যমে ইহুদিদের অন্যতম রাজনৈতিক প্রজ্ঞাবান নেতা ইমানুয়েল কারাসু ওসমানিয়া সালতানাতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহী সংঘ গড়ে তুলতে শুরু করেন। এভাবে ১৯০৬ সালের মধ্যেই ইহুদিরা হাজারো তুর্কি তরুণ সেনা সদস্যদের মধ্যে ওসমানিয়া সুলতান বা খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী মনোভাব তৈরি করতে সফল হয়। তাদের বেশির ভাগ তরুণ হওয়ার কারণে এটা ‘ইয়াং তুর্ক’ নামে পরিচিত হতে থাকে।

ওসমানিয়া সেনাবাহিনীতে এর ব্যাপক প্রভাব তৈরি হয়। এর মধ্যেই আনোয়ার পাশা, তালাত পাশা ও জামাল পাশা ইয়াং তুর্কদের প্রধান নেতা হয়ে ওঠেন।

১৯০৮ সালে আনোয়ার পাশার নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান হয়। ১৯০৯ সালে খলিফা আবদুল হামিদকে উৎখাত করে ক্ষমতায় বসানো হয় পঞ্চম মুহম্মদকে।

ক্রমবর্ধমান ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ এবং ইহুদি ষড়যন্ত্রের কারণে সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদকে সরে যেতে হয়।

দ্বিতীয় আবদুল হামিদের স্থলে ১৯০৯ সালের ২৭ এপ্রিল ক্ষমতা গ্রহণ করেন পঞ্চম মুহম্মদ। পঞ্চম মেহমেদ নামেও ওসমানিয়া সালতানের ইতিহাসে সমধিক পরিচিত তিনি। তবে তিনি ছিলেন শুধু নামমাত্র সুলতান। সালতানাতের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ আনোয়ার পাশা, তালাত পাশা ও জামাল পাশার করায়ত্ত ছিল।

১৯১১ সালে খেলাফতে ওসমানিয়া থেকে যুদ্ধের মাধ্যমে লিবিয়া দখল করে নেয় ইতালি। ১৯১২ সালের ৮ অক্টোবর শুরু হয় বলকান যুদ্ধ। শেষ হয় ১৯১৩ সালের ৩০ মে। এই যুদ্ধের মাধ্যমে বুলগেরিয়া, সার্বিয়া, মন্টিনিগ্রো ও গ্রিস ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এর ফলে ইউরোপে ওসমানিয়া খেলাফতের অবস্থান খর্ব করা হয়। এদিকে ১০১৩ সালে অপর একটি অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তিন পাশা- আনোয়ার পাশা, তালাত পাশা ও জামাল পাশা সরাসরি ক্ষমতা দখল করে নেন। অর্থাৎ এতদিন রাখঢাক রেখে পেছন থেকে সালতানাত পরিচালনা করছিলেন।

এবার সরাসরি সালতানাতের সর্বেসর্বা হয়ে উঠলেন তারা। সুলতান পঞ্চম মেহমেদ এ সময় তার পদে বহাল ছিলেন। অথচ সালতানাতের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ তার হাতে ছিল না।

ভুল পরামর্শে সুলতানের কর্ণপাত
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ৩ পাশার ভুল পরামর্শে ওসমানিয়া সুলতান পঞ্চম মেহমেদ কেন্দ্রীয় বা অক্ষ শক্তির সঙ্গে যোগ দেন। আমরা সবাই জানি সারাজেভোতে হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এক পক্ষে ছিল অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া ও জার্মানি। অপরপক্ষে ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, সার্বিয়া, রাশিয়া, ফ্রান্স, জাপান, ইতালি, রুমানিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। ৪ বছরব্যাপী চলতে থাকা যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া ও জার্মানি অর্থাৎ কেন্দ্রীয় শক্তি।

এই যুদ্ধের ফলে বাগদাদ, দামেস্ক ও জেরুজালেমসহ পুরো আরব অঞ্চল দখলে নেয় ইউরোপীয় মিত্রবাহিনী। এসব অঞ্চল নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নেয় তারা। এ অবস্থায় উপায় না পেয়ে সুলতান পঞ্চম মেহমেদকে ‘জেহাদের ডাক’ দেওয়ার পরামর্শ দেন ৩ পাশা। তবে জেহাদের এই আহ্বান কোনো কাজে আসেনি। এই জেহাদে মুসলিমরা কোনো সুবিধা করতে পারেনি। এদিকে পরাজয় টের পেয়ে ইয়ং তুর্ক সরকার পদত্যাগ করে। সেই সঙ্গে ৩ পাশা বলে পরিচিত আনোয়ার পাশা, তালাত পাশা ও জামাল পাশা জার্মান যুদ্ধজাহাজে দারুল খেলাফত ইস্তাম্বুল ছেড়ে পালিয়ে যান।

যেভাবে হলো খেলাফতের বিলোপ সাধন
১৯১৮ সালের জুলাইয়ে খলিফা বা সুলতান পঞ্চম মেহমেদ মৃত্যুবরণ করলে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয় ষষ্ঠ মুহাম্মদকে। এরপর ১৯১৮ সালের ৩০ অক্টোবর দারুল খেলাফার রাজধানী ইস্তাম্বুলে প্রবেশ করে সুলতানের প্রাসাদ দখলে নেয় ব্রিটিশ বাহিনী। এই সময় ওসমানিয়া সেনাবাহিনী ব্রিটিশ বাহিনীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে পরাজয় স্বীকার করে নেয়। এরপর ১৯২০ সালের ১০ আগস্ট খলিফা ষষ্ঠ মুহম্মদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মিত্র শক্তির সেভ্র চুক্তি হয়। তবে মুস্তাফা কামাল পাশার নেতৃত্বে তুর্কি জাতীয়তাবাদীরা এই চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে। একই বছর ২৩ এপ্রিল আঙ্কারায় মোস্তফা কামাল পাশার নতুন সরকার গঠন করা হয়। ১৯২২ সালের ১ নভেম্বর তুরস্কের গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি থেকে ওসমানিয়া সালতানাত বিলুপ্ত ঘোষণা করা হলে সুলতান পদ ‍বিলুপ্ত হয়ে যায়।

সুলতান পদ বিলুপ্ত করলেও খেলাফত তখনও বিলুপ্ত হয়নি। ইস্তাম্বুল থেকে ষষ্ঠ মুহম্মদকে মাল্টায় নির্বাসনে পাঠানো হয়। এরপর ১৯২২ সালের ১৯ নভেম্বর খলিফা পদে আসীন হন দ্বিতীয় আবদুল মাজিদ।

১৯২৩ সালের ২৪ জুলাই তুর্কি জাতীয়তাবাদী সরকারের প্রধান মোস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্বে মিত্রশক্তির সঙ্গে স্বাক্ষরিত হয় শতবর্ষী লুজান চুক্তি। যার মাধ্যমে তুরস্ককে প্রজাতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে খলিফা আবদুল মাজিদ প্রতিবাদ করেন। খেলাফতের শাইখুল ইসলাম তুরস্ক রাষ্ট্র গঠনকে অনৈসলামিক বলে ফতোয়া জারি করেন। পরবর্তীতে কামাল পাশার চাপে খলিফা আবদুল মাজিদ নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। এতে কামাল পাশার নেতৃত্বে তুর্কি জাতীয়তাবাদীরা জয়ী হয়।

অবশেষে ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ ওসমানিয়া খেলাফতের বিলোপ সাধন করেন মোস্তফা কামাল পাশা।

ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস
১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে যখন সালতানাতে ওসমানিয়া প্রবলভাবে ধরাশায়ী, ঠিক তখনই ইহুদি সাংবাদিক জেমস আর্থার বেলফোর ঘোষণা করেন। যা ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্মারক দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। ১৯২৫ সালে দ্বিতীয়বার বেলফোর ঘোষণা দেওয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা পাকাপাকিভাবে দেওয়া হয়। এই ঘোষণার প্রভাবে ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে জেরুজালেমে আসতে থাকে ইহুদিরা। অবশেষে ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণা অনুযায়ী ১৯৪৮ সালে গঠন করা হয় ইহুদিদের জন্য প্রবল পরাক্রান্ত রাষ্ট্র ইসরায়েল।

এখানে একটি ফ্যাক্টর হলো-
দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে হযরত দাউদ ও সোলায়মান আলাইহিস সাল্লাম, যাকে ইহুদিরা যথাক্রমে রাজা ডেভিড ও রাজা সলোমন বলে সম্মানিত করে এবং বিশ্বাস করে শেষ যুগে রাজা সলোমনের অনুরূপ ইহুদিদের জন্য স্বর্ণযুগের সূচনা হবে। ১৮৯৭ সালে যায়োনিস্ট নামে একটি সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। যার সার্বিক কৌশল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন খ্যাতিমান ইসলামিক স্কলার ও শেষজমানা সংক্রান্ত বিষয়ের গবেষক ইমরান নযর হোসেন। তার লেখা ‘পবিত্র কুরআনে জেরুজালেম’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘দুর্নীতিগ্রস্ত, স্থায়ীভাবে ধনী, লুণ্ঠনজীবী ও ধর্মবিমুখ সম্ভ্রান্ত শ্রেণি যারা এখন ইসরায়েলের প্রতিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের সাথে সুবিধাবাদী আঁতাতের মাধ্যমে ইসরায়েলের প্রতিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টাই হল যায়োনিস্টদের সার্বিক কৌশলের একটা দিক’ (পৃষ্ঠা: ৪০-৪১)।

বইটিতে আরও বলা হয়, ‘পবিত্রভূমিতে’ ঐ শয়তানসুলভ কৌশল বাস্তবায়ন করার লক্ষ্য নিয়েই ইসরায়েল ইয়াসির আরাফাত এবং তার ধর্মনিরপেক্ষ ও জাতীয়তাবাদী দল পিএলও-কে শান্তির জন্য নিজের সহযাত্রী হিসেবে বেছে নিয়েছে। ঐ কৌশল মিশর, জর্ডান, তুরস্ক এবং সৌদী আরবের বেলায় কাজ করেছে, যারা সবাই যুক্তরাষ্ট্রের তাঁবেদার রাষ্ট্র। কিন্তু ঐ কৌশল ‘পবিত্রভূমিতে’ সফল হয়নি। সিরিয়া বা ইয়েমেনেও তা সফল হয় নি (পৃষ্ঠা: ৪১)।

ইমরান নযর হোসেন তার ‘পবিত্র কুরআনে জেরুজালেম’ গ্রন্থে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন: ‘সর্বজ্ঞানী আল্লাহ তা’আলাই যেহেতু ইব্রাহিম (আ.) ও লূত (আ.)-কে ‘পবিত্রভূমিতে’ যাবার এবং সেখানে অভিবাসী হবার নির্দেশ দিয়েছিলেন, এর নিহিতার্থ ছিল এই যে, সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাদের অন্যত্র প্রত্যাবাসনের নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত, তারা এবং তাদের বংশধরেরা সেখানেই বসবাস করবেন। আর তাই ঐ ভূমি তাদেরই অধিকারে ছিল (পৃষ্ঠা: ৬৭)।’

আরেকটি ফ্যাক্টর হলো-
লস অ্যাঞ্জেলস টাইমসে প্রকাশিত প্রবন্ধে (২১ জুলাই ২০০০) দানিয়েল পাইপস জেরুজালেমের ওপর মুসলিমদের দাবিকে প্রত্যাখানের চেষ্টা করেছেন এবং ইহুদি স্বত্বকে প্রতিষ্ঠার সুচতুর চেষ্টা করেছেন। তিনি তার প্রবন্ধে লেখেন, কুরআনে বা দোয়ার মধ্যে কোথাও একবারও জেরুজালেমের উল্লেখ নেই। এরই সূত্র ধরে ইমরান নযর হোসেন লিখেছেন, এটা সত্যি যে ‘জেরুজালেম’ শব্দটি আক্ষরিকভাবে কুরআনে উল্লেখিত হয়নি, কিন্তু তা মনে হয় আল্লাহর প্রজ্ঞাস্বরূপ। পবিত্র কুরআনে এক রহস্যময় ভাষায় জেরুজালেমের উল্লেখ করা হয়েছে (পৃষ্ঠা: ৭৬-৭৭)।

এই যুগে ইসরায়েলের ইহুদিরা যে নিজেদের আল্লাহর নির্বাচিত বান্দাহ হিসেবে দাবি করে থাকে তা আসার বলে অভিমত দিয়েছেন ইমরান নযর হোসেন। কেননা তারা এরই মধ্যে তাওরাত পরিবর্তন করেছে এবং নিজেদের মনগড়া কথা সেখানে লিখে দিয়েছে। আর সেই মনগড়া কথা অনুযায়ীই ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর পর মুসলিম বিশ্বে ক্ষোভের আগুন জ্বলতে থাকে। এই বছরই শুরু হয় প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ। আরব ভূমির অন্যান্য দেশ এবং ফিলিস্তিনি বাহিনী মিলে গঠন করা হয় সম্মিলিত সামরিক বাহিনী। ইসরায়েলের সঙ্গে এই বাহিনীর যে যুদ্ধ হয় তা ইতিহাসে প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ হিসেবে সমধিক পরিচিত। একে আরবিতে নাকবা বা বিপর্যয় এবং হিব্রুতে মিলখেমেত হাতজমাউত বা স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত।

এই যুদ্ধে মিশর, ইরাক, সিরিয়া, ট্রান্সজর্ডান, লেবানন, সৌদি আরব, ইয়েমেন ও জইশ আল ইনকাজ আল আরাবি ইসরায়েলের বিপক্ষে লড়াই করতে থাকে। এতে আরবের ৩ হাজার ৭০০ থেকে ৭ হাজার যোদ্ধা এবং ফিলিস্তিনের ৩ হাজার থেকে ১৩ হাজার যোদ্ধা ও বেসামরিক লোক নিহত হন। ইসরায়েলের পক্ষে ৬ হাজার ৩৭৩ জন নিহত হন। এর মধ্যে যোদ্ধা ছিলেন ৪ হাজার এবং বেসামরিক লোক ২ হাজার ৪০০ জন।

দ্বিতীয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ
১৯৫২ সালে জামাল আবদেল নাসেরের নেতৃত্বে মিশরে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। ১৯৫৪ সালে মিশরের প্রধানমন্ত্রী এবং ১৯৫৬ সালে প্রেসিডেন্ট হন নাসের। ক্ষমতা গ্রহণের পর মিশরের উন্নয়নে মনোযোগ দেন তিনি। এর জন্য দুটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি: ১. আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সুয়েজ-সমস্যার সমাধান এবং ২. আসোয়ান এলাকায় নীলনদে উঁচু বাঁধ নির্মাণ করে মিশরে নীলনদের জলপ্রবাহ বৃদ্ধি করা। এক্ষেত্রে তিনি ইউরোপীয়দের সহযোগিতার আশা করেছিলেন। কিন্তু আশাহত হন। তাদের অসহযোগিতায় রুষ্ট হয়ে ১৯৫৬ সারের ২৬ জুলাই সুয়েজ খালের জাতীয়করণ করেন। এর পর সুয়েজ খাল ব্যবহারকারীদের দেওয়া অর্থে আসোয়ান বাঁধ নির্মাণের কাজ সম্পূর্ণ করা হয়।

সুয়েজ খাল জাতীয়করণের সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করে ব্রিটেন ও ফ্রান্স। কারণ সুয়েজ খাল কোম্পানিতে লগ্নি করা অর্থের বেশির ভাগই এসেছিল এই দুই দেশ থেকে। শুধু তাই নয়, মিশরকে জব্দ করার অভিপ্রায়ে ব্রিটেন ও ফ্রান্স ইসরায়েলকে সঙ্গে নিয়ে একটি গোপন ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৫৬ সালের ২৯ অক্টোবর মিশরে হামলা করে ইসরায়েল। এর ঠিক দুই দিন পরে ব্রিটেন ও ফ্রান্স এই হামলায় অংশীদার হয় এবং তারাও মিশরে হামলা করে। ইসরায়েল, ব্রিটেন ও ফ্রান্স- এই তিন শক্তির সম্মিলিত আক্রমণে পর্যুদস্ত হয় মিশর। পাশাপাশি ব্রিটিশ ও ফ্রান্সের বাহিনী সুয়েজ খাল অঞ্চল দখলে নেয়। তবে আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতিস্বীকার করে মিশরের অধিকৃত এলাকা থেকে প্রথমে ব্রিটেন ও ফ্রান্স, পরে ইসরায়েল তাদের সৈন্য সরিয়ে নেয়। সুয়েজ খালকে কেন্দ্র করে যুদ্ধের পরিণতিতে এই অঞ্চলে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের প্রভাব কমে যায় ও ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের উন্নতি হয়। অন্যদিকে আরব তথা মুসলিম বিশ্বে আরব জাতীয়তাবাদের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে জামাল আবদেল নাসেরের প্রভাব বাড়তে থাকে।

তৃতীয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ
১৯৫৬ সালের সুয়েজ সংকটের পর সিনাই অন্যলে জাতিপুঞ্জের শান্তিরক্ষাবাহিনী মজুত ছিল। ১৯৬৭ সালের মে মাসে মিশরের অনুরোধক্রমে জাতিপুঞ্জের মহাসচিব শান্তিরক্ষাবাহিনীকে গাজা ও ইজিপ্টের সীমানা থেকে প্রত্যাহার করে নেন। শান্তিরক্ষাবাহিনী সরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ইসরায়েল, সিরিয়া ও জর্ডন তাদের সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করে। ২০মে গাজ অঞ্চলের ওপর মিশর তার নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। ২৩ মে নাসের তিরান প্রণালীর মধ্য দিয়ে ইসরায়েলি জাহাজ চলাচল বন্ধের কথা ঘোষণা করেন।

কিন্তু এই ঘোষণা কার্যকরের আগেই ইসরায়েলি বিমান বাহিনী ১৯৬৭ সালের ৫ জুন অতর্কিত হামলায় মিশরের বিমান ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করে দেয়। সেই সঙ্গে গাজাসহ সমগ্র সিনাই উপত্যকা দখল করে নেয়। সিরিয়া, ইরাক ও জর্ডান আগের চুক্তি অনুযায়ী ছয়দিনের এই যুদ্ধে মিশরের পক্ষে যোগ দেয়। কিন্তু প্রতিপক্ষের সমন্বয়ের অভাব ও সামরিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) সহজেই জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর, সিরিয়ার গোলান মালভূমি এবং জেরুজালেম শহরের পূর্বাংশ দখল করে নেয়।

ছয়দিনের এই যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের চাপে থেমে গেলেও মূল আরব-ইসরায়েল সমস্যা অমীমাংসিতই রয়ে যায়। যুদ্ধ শেষের বেশ কিছুদিন পর ১৯৬৭ সালের ২২ নভেম্বর জাতিপুঞ্চের নিরাপত্তা পরিষদে একটি ব্রিটিশ প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এই প্রস্তাবের মূল বিষয়গুলো ছিল-
১. ইসরায়েলকে অধিকৃত সব ভূখণ্ড থেকে সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার করতে হবে;
২. আরব বিশ্বকে ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতে হবে;
৩. শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আস্থাশীল থাকতে হবে।

এই প্রস্তাব কোনো পক্ষই মেনে নেয়নি। ফলশ্রুতিতে স্বাভাবিকভাবেই আরেকটি যুদ্ধের সম্ভাবনাকে জিইয়ে রাখা হলো।

চতুর্থ আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ
আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে বারবার আরব রাষ্ট্রগুলোর পরাজয় থেকে ফিলিস্তিনি মুক্তিযোদ্ধারা উপলব্ধি করেন, সম্মুখ সমরে ইসরায়েলকে পরাজিত করে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। তাই প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের বিভিন্ন গেরিলা গোষ্ঠী, বিশেষ করে ইয়াসির আরাফাত পরিচালিত আল-ফাতাহ গোষ্ঠী, জর্ডান ও লেবানন সীমান্ত থেকে ঘন ঘন গেরিলা হামলা চালাতে থাকে। এই ধরনের গেরিলা হামলা প্রতিহতের জন্য ইসরায়েল পাল্টা হামলা চালায়। এতে ইসরায়েলের প্রতিবেশী দেশ বিশেষ করে জর্ডান বিশেষ অসুবিধার সম্মুখীন হয়। এ জন্য জর্ডান সরকার ফিলিস্তিনের মুক্তিযোদ্ধাদের জর্ডান ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য করে।

তখন পশ্চিম এশিয়ার রাজনীতিতে অন্য একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে যায়। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বরে মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসেরের মৃত্যুর পর পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হন অনোয়ার সাদাত। নাসেরের অনুগামী হওয়া সত্ত্বেও আনোয়ার সাদাত মিশরের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিতে কিছু পরিবর্তন ঘটান। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে নাসেরের সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পথ থেকে সরে আসতে শুরু করলেন আনোয়ার সাদাত। আর বৈদেশিক ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মিত্রতা রেখে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে গুরুত্ব দেন। কারণ তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, আরব-ইসরায়েল বিরোধের মীমাংসা ও ইসরায়েলের কাছ থেকে হৃত ভূখণ্ড ফিরে পেতে মূল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বহুত্বমূলক সম্পর্ক স্থাপন খুবই জরুরি।

প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর আনোয়ার সাদাত একদিকে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশ নীতিতে পরিবর্তন সাধন করতে থাকেন। অন্যদিকে মিশরীয় বাহিনীকে উন্নতমানের অস্ত্রে সজ্জিত করে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। কারণ মিশরসহ আরব দেশগুলো ১৯৬৭ সালে ছয়দিনের যুদ্ধের পরাজয়ের গ্লানি ভুলতে পারছিল না।

অবশেষে ১৯৭৩ সালের ৬ অক্টোবর মিশর ও সিরিয়া একযোগে ইসরায়েল হামলা করে। এই যুদ্ধ ‘ইয়ম কিপুর যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। অতর্কিত হামলায় মিশরীয় ও সিরীয় সৈন্যরা ইসরায়েলি প্রতিরোধ ব্যূহ ভেদ করে সিনাই উপত্যকায় ঢুকে পড়ে। প্রাথমিক অবস্থায় দিশেহারা হয়ে পড়লেও দ্রুত সেই অবস্থা কাটিয়ে ওঠে ইসরায়েলি সেনারা। পাল্টা হামলায় তারা সুয়েজ খালের পশ্চিমে মিশরের সীমানায় ঢুকে পড়ে। একই সঙ্গে খেলান পার্বত্য অঞ্চল পুনর্দখল করে নেয়।

এই যুদ্ধে মিশর ও সিরিয়া সামরিকভাবে জয়লাভ না করলেও নৈতিকভাবে অনেকখানি সফল হয়েছিল।

ফাতাহ প্রতিষ্ঠা
১৯৫৯ সালে ইয়াসির আরাফাত গাজা ও কুয়েতে ফাতাহ দল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৪ সালের পর যা প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) প্রধান দলে রূপান্তর হয়।

ইসরায়েলে আঞ্চলিক যুদ্ধ
১৯৭৩ সালের ৬ অক্টোবর ইহুদিদের ইয়ম কিপুর দিবস উপলক্ষে সরকারি ছুটির দিন মিশরীয় ও সিরীয় সেনারা নতুন করে আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরু করে। এই যুদ্ধে ইসরায়েলিরা নিজেদের ভূমি থেকে আরব সেনাদের তাড়িয়ে দেয় এবং এতে উভয়পক্ষেই বহুসংখ্যক হতাহত হয়েছিল।

আরব দেশগুলোর সঙ্গে স্বাভাবিকীকরণ
১৯৭৯ সালে ইসরায়েল ও মিশরের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের লক্ষ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। ওয়াশিংটনে ইসরায়েলের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মানাচিম বেগিন ও মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের মধ্যে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি হয়েছিল। চুক্তির ফলশ্রুতিতে মিশরকে সিনাই উপদ্বীপ ফিরিয়ে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে আনোয়ার সাদাতই প্রথম আরব নেতা যিনি ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

এরপর সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও ওমানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে তোলে ইসরায়েল। এদিকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইসরায়েলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু উগান্ডায় এক সফরে গিয়ে সার্বভৌমত্ব কাউন্সিলের চেয়ারম্যান আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহানের সঙ্গে দেখা করেন এবং সেখানে তারা দুজনেই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে রাজি হন।

হামাস প্রতিষ্ঠা
১৯৮৭ সালে গাজা ও পশ্চিম তীর জুড়ে শুরু হয় প্রথম ইন্তিফাদা। এটা ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর শুরু। এই বছরই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম ইন্তিফাদা স্থায়ী হয় ১৯৯১ সালের মাদ্রিদ সম্মেলন পর্যন্ত। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে এর সমাপ্তি হয়।

দ্বিতীয় ইন্তিফাদা
২০০০ সালের সেপ্টেম্বর শুরু হয় দ্বিতীয় ইন্তিফাদা বা মসজিদ আল আকসা ইন্তিফাদা। এরিয়েল শ্যারন হাজারখানেক সেনা সজ্জিত হয়ে জেরুজালেমের পুরনো শহর ও মসজিদ আল আকসা ভ্রমণে এলে এই ইন্তিফাদা শুরু হয়।

ফিলিস্তিনিদের কাছে তার এই ভ্রমণ ইসলামের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ মসজিদের ওপর ইসরায়েলি দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ হিসেবে চিহ্নিত হয়।

২০১৪ সালের গাজা যুদ্ধ
২০১৪ সালের জুনে তিনজন ইসরায়েলি কিশোরকে হত্যা করা হয়। একে কেন্দ্র করে ৮ জুলাই শুরু হয় গাজা যুদ্ধ। এতে ২ হাজার ২০০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন।

ফিলিস্তিনিদের অবরোধ
২০২১ সালে গাজায় ইসরায়েলি সীমান্তের উপকণ্ঠে বিক্ষোভ শুরু করেন ফিলিস্তিনিরা। কয়েক মাস ধরে চলতে থাকা এই বিক্ষোভে অন্তত ১৮৯ ফিলিস্তিনি প্রাণ হারান।

হামাসের নজিরবিহীন হামলা
২০২২ সাল অর্থাৎ গত বছরের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস ইসরায়েলের অভ্যন্তরে নজিরবিহীন হামলা করে। এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় এখনও পর্যন্ত ইসরায়েল গাজায় তথাকথিত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করলেও সেদিকে তারা কর্ণপাত করছে না। অন্যদিকে এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে হামাস। দুই মন্ত্রীর পদত্যাগের পরিপ্রেক্ষিতে আজ সোমবার (১৭ জুন) যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা বাতিল করেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু। ধারণা করা হচ্ছে, এখন উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করবেন তিনি। যারা শুধু তার কাছেই জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবেন।

আরও পড়ুন: যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা বাতিল করলেন নেতানিয়াহু

তথ্যসূত্র:
১. ইমরান নযর হোসাইন, পবিত্র কুরআনে জেরুজালেম;
২. মো. আছাদ পারভেজ, প্যালেস্টাইনের বুকে ইজরাইল;
৩. ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘর্ষ, ফ্রান্স টোয়েন্টিফোর;
৪. অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চল: ওভারভিউ ম্যাপ (ডিসেম্বর ২০১১);
৫. বেনি মরিস (২০০৪), ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু সমস্যা পুনর্বিবেচনার জন্ম, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস;
৬. জেরেমি বোয়েন (২০০৩), ছয় দিন: কীভাবে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যকে আকার দিয়েছে;
৭. অ্যাডাম এম গারফিঙ্কল (২০০০), আধুনিক ইসরায়েলে রাজনীতি এবং সমাজ: মিথ এবং বাস্তবতা;
৮. হেনরি লরেন্স, প্যালেস্টাইনের প্রশ্ন;
৯. উরি বেন-এলিয়েজার, ওয়ার ওভার পিস: ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব ইসরায়েলের সামরিক জাতীয়তাবাদ, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া প্রেস;
১০. নামি নাসরাল্লাহ, ডেভিড নিউম্যানে‍‍`দ্য ফার্স্ট অ্যান্ড সেকেন্ড ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদাস, জোয়েল পিটার্স (সম্পাদনা) রাউটলেজ হ্যান্ডবুক অন দ্য ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি দ্বন্দ্ব , রাউটলেজ, ২০১৩, পৃষ্ঠা ৫৬-৬৮।
১১. রশিদ খলিদি, ফিলিস্তিন যুদ্ধের ১০০ বছর;
১২. আলী আহমাদ মাবরুর, হামাস: ফিলিস্তিন মুক্তি আন্দোলনের ভেতর-বাহির;
১৩. সাইমন সেবাগ মন্টেফিউরি, (অনুবাদ: মো. হাসান শরীফ ও মাসুম বিল্লাহ), জেরুজালেমের ইতিহাস;
১৪. এ এন এম সিরাজুল ইসলাম, আল আকসা মসজিদের ইতিহাস;
১৫. ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত: কী, কেন এবং কীভাবে এর শুরু?;
১৬. ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব নিরসনে ট্রাম্পের মিডল ইস্ট পিস প্ল্যান: কী আছে এতে?;
১৭. “ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়ানোর কেউ নেই”- কামরান হাসানভ

Link copied!