আগের পর্বের পর: ফরাসি বিপ্লবের পেছনে রসদ জুগিয়েছিল অর্থনৈতিক দুরাবস্থা। সবচেয়ে অন্ধকারময় দিক হলো রাজকোষের যথেচ্ছাচার। অভিজাত সম্প্রদায় প্রায়ই নিজেদের ‘ফ্রাঙ্কিশ বিজেতাদের বংশধর’ বলে দাবি করতেন। স্বয়ং রাজা ছিলেন অভিজাত। সেজন্য অভিজাতদের স্বৈরাচার চরম মাত্রা পেয়েছিল।
যাজকদের অত্যাচার, অভিজাতদের স্বৈরাচারে পর্যুদস্ত হতে থাকে ফ্রান্সের তৃতীয় শ্রেণির মানুষজন। ‘স্বাধীনতা, সমতা, ভ্রাতৃত্ব অথবা মৃত্যু’ এই স্লোগানে বুরবোঁ রাজতন্ত্রের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠতে থাকে ফ্রান্সের সাঁকুলেৎ শ্রেণি। ফরাসি ভাষায় এই স্লোগান ছিল- ‘Liberté, égalité, fraternité, ou la mort’।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই বাস্তুল দুর্গের পতন হয়। বাস্তুল দুর্গকে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে চিত্রিত করা হয়। ফ্রান্সের আপামর জনসাধারণের বিক্ষোভের মুখে স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন ডাকতে বাধ্য হন রাজা।
সুদীর্ঘ ১৭৫ বছর পর ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৫ মে ভার্সাইয়ের রাজসভায় স্টেটস জেনারেল নামে জাতীয় সভার অধিবেশন বসে।
এই অধিবেশন শুরুর পর ফ্রান্সের রাজকোষের অর্থাভাব ধরা পড়ে। এদিক থেকে ফ্রান্সের বুরবোঁ রাজবংশের রাজা, মন্ত্রী ও অভিজাতদের দুর্বলতাগুলো ফাঁস হয়ে যায়।
অতঃপর ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের জুনে রাজার বিরুদ্ধে ফ্রান্সের বিপ্লবীরা বিজিত হয়। কারণ ২৭ জুন ৩ শ্রেণির প্রতিনিধিদের একত্রে যোগদান করে মাথাপিছু ভোটদানের অধিকার মঞ্জুর করেন ষোড়শ লুই। এ সময় থেকেই ফ্রান্সের জন্য নতুন সংবিধান রচনার কাজ শুরু হয়। এজন্য তখন জাতীয় সভা পরিণত হয় সংবিধান সভায়।
সংবিধান সভার সদস্যবর্গ বুদ্ধিমান থাকলেও ছিল না তাদের কোনও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৪-১১ আগস্ট সংবিধান সভা কতকগুলো বিধিবিধান সংযোজন করে সামন্ত প্রথা বিলুপ্ত করে।
মানবাধিকার সনদ ঘোষণা: সংবিধান সভার দ্বিতীয় অবদান মানবাধিকার সনদ ঘোষণা। মূলত আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও দার্শনিকদের রচনার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে রচনা করা হয় এই সনদ।
রাজার ক্ষমতা: নতুন এই সংবিধান অনুযায়ী ফ্রান্স শাসনের ক্ষমতা রাজা ও আইনসভার মধ্যে সমন্বয় করে দেওয়া হয়। রাজাকে দেওয়া হয় মন্ত্রী নিয়োগের অধিকার। তবে আইনসভার কোনও সদস্যের মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ থাকল না। এভাবে আইনসভা থেকে শাসন বিভাগ বিভক্ত করা হয়। নতুন সংবিধান অনুযায়ী রাজা শুধু ‘ভেটো’ (Suspensive Power) ব্যবহার করে অনির্দিষ্টকালের জন্য কোনো আইন প্রয়োগ স্থগিত রাখার ক্ষমতা লাভ করেন। মোটকথা, নতুন এই সংবিধানে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে ফ্রান্সের রাজতন্ত্রকে ‘নিয়মতান্ত্রিক’ করা হয়।
৭৪৫ জন সদস্য নিয়ে গঠন করা হয় এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা। মেয়াদ ধরা হয় ২ বছর। আইন প্রণয়নের পূর্ণ অধিকার লাভ করে আইনসভা।
শাসনকার্যের সুষ্ঠু অধিকারের ভিত্তিতে পুরাতন প্রদেশ বাতিল করে ৮৩টি বিভাগ গঠন করা হয়। সব বিভাগ ও কয়েকটি জেলাকে ক্যান্টন ও কমিউনে বিভক্ত করা হয়। এভাবে সমগ্র ফ্রান্সকে ঐক্যবদ্ধ করা হয়।
গির্জার পুনর্গঠন: গির্জার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা ছাড়াও সংবিধান-সভা ফ্রান্সে ধর্ম সংক্রান্ত বিষয় সমাধানে ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে যাজকদের নাগরিক সংবিধান পাশ করে গীর্জার সকল স্বাতন্ত্র্য ধ্বংস করা হয়।
আরও পড়ুন: বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সে প্রকট আকার নেয় শ্রেণিবৈষম্য
যাজক নির্বাচনে পোপের হস্তক্ষেপ আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়। ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বর সংবিধান সভা বাতিল ঘোষণা করা হয়।
সংবিধান সভা বন্ধের পর প্রথম সমস্যা নাগরিক সংবিধানের প্রতি যেসব যাজক অসম্মতি দেবে, তাদের রাষ্ট্রদ্রোহী ঘোষণা করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ভাতা, বেতন ও অন্যান্য সুবিধা বিদ্রোহী ধর্মযাজকদের ওপর থেকে নাকচ করে নেওয়া হবে বলেও ঘোষণা দেওয়া হয়। দ্বিতীয় সমস্যা এমিগ্রি অর্থাৎ ফ্রান্সের রাইন সীমান্তে সৈন্য সংগঠন করে বিপ্লবী সরকারকে আক্রমণের চেষ্টা করতে পারে এমিগ্রিরা। এদের সম্পর্কে বিধানসভা সিদ্ধান্ত নেয় ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়াারির মধ্যে তাদের ফিরে আসতে বলা হয়। যারা এই আদেশ অমান্য করবে তাদের বিষয়-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে ও তাদেরকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। এই দুটি সিদ্ধান্ত রাজার কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হলে তিনি ভেটো ক্ষমতাবলে নাকচ করে দেন। রাজার এই নিষেধাজ্ঞায় জিরন্ডিস্ট ও জ্যাকোবিন গোষ্ঠী ক্রুদ্ধ হয়। চরমপন্থীরা জাতীয় সভার উদারপন্থীদের বিরোধিতা শুরু করে।
১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে কর্ডেলিয়ান ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। এই গোষ্ঠীর লোকজন ছিল উগ্রপন্থী। এর ফলে সাঁকুলেৎ শ্রেণিও নিজ শক্তি সম্পর্কে সচেতন হয়। উগ্রপন্থীদের উসকানিতে ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন টুইলারিস প্রাসাদ আক্রমণ ও রাজাকে অপদস্থ করে ফ্রান্সের উন্মত্ত জনতা। এই আক্রমণের ফলে রাজা স্ব-নিরাপত্তার জন্য উদ্বিগ্ন হন। অস্ট্রিয়ার রাজা লিউপোল্ড তার ভগ্নি ও ভগ্নিপতির নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হন। রাজা ষোড়শ লুই, রাণী মেরি এন্টোয়নেট ও তাদের বালকপুত্র ছদ্মবেশ ধরে লুক্সেমবার্গ সীমান্তে মন্টমেডি দুর্গের দিকে পালিয়ে যান। কিন্তু সীমান্তের অদূরে ভ্যারেন্নে গ্রামে একজন সাধারণ ফরাসি রাজা ও রাণীকে চিনতে পেরে যায়। তারা রাজাকে আটক করে রাজধানীতে খবর দেয়। তীব্র ধিক্কার ও অপমানের মধ্য দিয়ে রাজা ষোড়শ লুই সপরিবারে প্যারিসে ফিরে আসেন।
রাজা ষোড়শ লুইয়ের ভ্যারেন্নেতে পলায়নের পর তার বৈদিশিক শক্তি বিশেষত অস্ট্রিয়ার গোপন ষড়যন্ত্রের সন্দেহ উগ্রপন্থীদের মধ্যে দেখা দেয়। এ সময় ব্রান্সউইক ঘোষণার দ্বারা অস্ট্রিয়ার সেনাপতি সতর্ক করে দেন, ফ্রান্সের রাজপরিবারের কোনো ক্ষতি হলে তিনি বিপ্লবীদের কঠিন শাস্তি দেবেন। উগ্রপন্থীরা অভিযোগ করতে থাকে, রাজা দুটি শত্রু দেশ অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়ার সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন। পলাতক রাষ্ট্রদ্রোহী এমিগ্রি ও বৈদেশিক শক্তির সঙ্গে রাজার গোপন যোগাযোগের গুজব ছড়িয়ে যায় সর্বত্র। ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুলাই জ্যাকোবিনদের প্ররোচনায় শাম্প দ্য মার-এ এক জনসভায় রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান করা হয়। এই মর্মে বিধানসভার কাছে একটি গণ আবেদন পাঠানো হয়। এই পরিস্থিতিতে অস্ট্রিয়ার সম্রাট, রাণী মেরী এন্টোয়নেটের ভ্রাতা লিওপোল্ড ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের ২৭ আগস্ট পিলনিৎসের ঘোষণা দেন যে যদি ইউরোপের সকল রাজশক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়, তবে অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়া ষোড়শ লুইকে রক্ষা ও তার হৃত ক্ষমতা পুনঃস্থাপনের জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করবে। ঐতিহাসকদের মতে, পিলনিৎসের এই ঘোষণা ছিলো ফাঁকা হুমকি। কিন্তু এ ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে উগ্রপন্থী বিপ্লবীরা। তারা রাজাকে বৈদেশিক ষড়যন্ত্রের দায়ে অভিযুক্ত করে ও রাজতন্ত্র উচ্ছেদের জন্য মারমুখী হয়। জিরন্ডিস্টদের চপে বিধানসভা অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সভায় জিরন্ডিস্টরা ‘পিতৃভূমি বিপন্ন’- এই ধ্বনি তুলে যুদ্ধ ঘোষণার অনুকূলে সদস্যদের ভোট পেয়ে যায়। কিন্তু যুদ্ধের শুরুতেই ফ্রান্সের সেনাপতি জেনারেল ডুমুরিয়েৎস বেলজিয়াম সীমান্তে পিছু হঠেন। ফলে রাজধানী প্যারিস বিপন্ন হয়ে পড়ে। অভিযোগ তোলা হয়, শত্রুপক্ষকে গোপনে ফ্রান্সের রণপরিকল্পনার খবর দিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন তিনি। ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের বিপ্লবী কমিউনের নেতৃত্তে টুইলারিস প্রাসাদ আক্রমণ করা হয় ও রাজার সুইস দেহরক্ষী দলকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। রাজা-রাণী প্রাণভয়ে প্রাসাদ থেকে পালিয়ে আইনসভায় আশ্রয় নেন। ক্ষিপ্ত আইনসভা ঘেরাও করে রাজতন্ত্র বাতিলের দাবি জানায়। ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে রাজতন্ত্র রদ করা হলে সব রাজভক্ত পদত্যাগ করে। লেফেভার ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে গণভোট প্রথার প্রবর্তন ও প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সঙ্গে রাজতন্ত্রের উচ্ছেদকে দ্বিতীয় ফরাসি বিপ্লব আখ্যা দেন।
জাতীয় সম্মেলনের সম্মুখে প্রধান কাজ ছিল সব রাজতন্ত্রী ও ক্যাথলিক প্রতিক্রিয়াশীল নেতাদের দমন করা। ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের সংবিধান বাতিল হওয়ায় নতুন সংবিধান রচনা করা হয়। বুর্জোয়া শ্রেণির স্বার্থে ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের সংবিধান রচিত হয়েছিল। এমতাবস্থায় রাজা ষোড়শ লুইকে পদচ্যুত করা হয়। জনসাধারণ ও অপরাপর রাজনৈতিক দল তার প্রাণদণ্ডের পক্ষপাতী না হলেও জ্যাকোবিন দলের রোষের মুখে ষোড়শ লুইকে গিলোটিন যন্ত্রে শিরোশ্ছেদ করা হয়।
১৭৯১ সালে সংবিধান-সভা বাতিলের ফলে বুর্জোয়া শ্রেণির স্বার্থে নতুন সংবিধান রচনা করা হয়। বুরবোঁ কবলিত শাসনব্যবস্থাকে নির্মূল করে নতুন চিন্তাচেতনায় সমাজ বিনির্মাণের জন্য জাতীয় সম্মেলনকে লক্ষ স্থির করতে হয়।
এই বিপ্লব ছিল নতুন চিন্তাচেতনা ও মতামত প্রতিষ্ঠার বিপ্লব। বুরবোঁ রাজবংশের স্বেচ্ছাচারিতা এতটাই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল যে করের বোঝায় সাধারণ জনগণ অর্থাৎ তৃতীয় শ্রেণী স্বাভাবিক মত প্রকাশেও অক্ষম ছিলো। বাস্তুল দুর্গ পতনের সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লব নতুন মাত্রা পায়। বাতিল হয়ে যায় সংবিধান-সভা। বুরবোঁ শ্রেণির স্বার্থে স্থিত হয় জাতীয় সম্মেলন । ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যায়িত করে ষোড়শ লুইকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়। যদিও তার প্রাণদণ্ডের মতো চরম ব্যবস্থার পক্ষপাতী ছিল না জ্যাকোবিন দল। তবে জিরন্ডিস্ট দলের একগুঁয়েমির কারণে এহেন চরম দণ্ড কার্যকর করা হয়।
সংকটকালীন সময়ে জাতীয় সম্মেলনের নেতারা উপস্থিত অনুযায়ী বিপ্লব রক্ষার্থে সন্ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে । ঘোষণা করা হয় জরুরি অবস্থা। রদ করা হয় সংবিধান। আইনসভার সদস্যদের দ্বারা গঠিত কয়েকটি সমিতি গঠন করা হয়। এর মধ্য দিয়ে তাদের হাতে সন্ত্রাসের রাজত্ব পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এসব কমিটির মধ্যে প্রথমটির নাম জন-নিরাপত্তা সমিতি ও দ্বিতীয় কমিটির নাম সাধারণ নিরাপত্তা সমিতি। প্রথম সমিতির ৯ জন সদস্য জাতীয় সম্মেলন দ্বারা নির্বাচিত হয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করত। দ্বিতীয় সমিতি পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলার কাজ দেখে। প্রতি-বিপ্লবী সন্দেহে বহু লোককে এই দুই সমিতি গিলোটিনে হত্যার মধ্য দিয়ে ফ্রান্সে প্রতি-বিপ্লব দমন করা হয়।
সন্ত্রাসের রাজত্বের জন্য প্রতিষ্ঠিত দুটি সমিতির নিয়ন্ত্রণ ক্রমে রোবসপিয়ের বা Robespierre ও তার সহযোগী সাঁ জ্যুস্ত বা Saint Just এর হাতে চলে যায়। এই দুই প্রধানের তৃতীয় সহকারী ছিলেন ক্যুথন বা Cuthon। এই ত্রিমূর্তির স্বেচ্ছাচারী শাসনের চাপে বহু লোক সন্ত্রাসে প্রাণ হারায়। ঐতিহাসিক ডোনাল্ড গ্রীযারের মতে, সন্ত্রাসের বলি হয় ৩৫-৪০ হাজার লোক। এই রাজত্বের শেষ দিককে বলা হয় মহাসন্ত্রাস। ১৭৯৩ সালের আগস্ট থেকে ১৭৯৪ সালের জুলাই পর্যন্ত এই মহাসন্ত্রাস চালু ছিল। এর ফলে একদিকে যেমন প্রতি-বিপ্লব দমন করা হয়, অন্যদিকে বহু নিরপরাধ মানুষ প্রাণ হারায়। এই সময় বৈদেশিক যুদ্ধে ফ্রান্স সাফল্য লাভ করে। মহাসন্ত্রাসের ফলে বৈদেশিক আক্রমণ ও অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের হাত থেকে বিপ্লব রক্ষা পায়। ঐতিহাসিক রাইকারের মতে, সন্ত্রাস বিপ্লবকে রক্ষা করে।
রোবসপীয়ারের নেতৃত্বে পুরনো রাজ-কাঠামো থেকে বেরিয়ে এসে সাম্যবাদী চিন্তাধারা প্রতিষ্ঠিত হয়। সন্ত্রাসের শাসন ন্যাশনাল কনভেনশনের জ্যাকবিন দলের সদস্যরা মূল্যবান সংস্কার প্রবর্তন করেছিলেন। লেফেভারের মতে, এই পর্যায়ে ফরাসি বিপ্লবের ফলে মহত্তম অধ্যায় সৃষ্টি হয়। গণহত্যার পাশাপাশি স্বাধীনতা ও সাম্যের আদর্শকে প্রতিষ্ঠার কাজে কনভেনশন কাজ করে। কোব্বানের মতে, সন্ত্রাসের ফলে গোটা ফ্রান্সে বিপ্লবের পর কেন্দ্রীয সরকারের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ফেডারেলিস্টদের দমনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের কতৃত্ব বেড়ে যায়।
১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর এক আইন দ্বারা কনভেনশন আদেশ দেয়, পুলিশ বিভাগ ভিন্ন সকল শ্রেণির কর্মচারী ও প্রাদেশিক শাসনকর্তারা সাধারণ নিরাপত্তা সমিতির নির্দেশ মেনে চলবে। অবাধ্য কর্মচারীদের জন্য প্রাণদণ্ডের বিধান রাখা হয়। এই আইন কার্যকরের ফলে আপাতত ন্যাশনাল কনভেনশন সফলতা পায় ও এই আইন কার্যকরের মধ্য দিয়ে জাতীয় সম্মেলন ফ্রান্সে ‘দ্বিতীয় ফরাসি বিপ্লব’ সম্পূর্ণ হয়।
সন্ত্রাসের রাজত্বের মাত্রাহীন নিষ্ঠুরতা জাতীয় সম্মেলন ও জ্যাকোবিন দলের জনপ্রিয়তা বিনষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মাদাম রোল্যান্ড, ড্যান্ডনসহ অন্যান্য বিপ্লবীদের গিলোটিনে হত্যার ফলে জাতীয় জীবনে হতাশা সৃষ্টি হয়।
১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই জাতীয় সম্মেলনের সদস্যরা রোবসপীয়ের ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের গ্রেপ্তারের আদেশ দেয়। রোবসপীয়েরকে আত্মপক্ষ সমর্থনে সভাকক্ষে কথা বলতে দেওয়া হয়নি। প্যারিস ক্যামিউন রোবসপীয়ের সমর্থক জড় করতে ব্যর্থ হয়। পরবরর্তী সময়ে রোবসপীয়ের, সাঁ জ্যুস্ত, ক্যুথন ও ১৮ জন শীর্ষস্থানীয় জ্যাকোবিন দলের নেতাদের গিলোটিনে প্রাণদণ্ড কার্যকর করা হয়। এর একদিনের ব্যবধানে আরও ৭০ জন প্যারিস ক্যামিউনের নেতার প্রাণদণ্ড কার্যকর করা হয়।
রোবসপীয়েরের পতনের ফলে সন্ত্রাসের রাজত্বের অবসান ঘটে। জাতীয় সম্মেলন সন্ত্রাস রদের জন্য বিপ্লবী পরিষদ, জননিরাপত্তা সমিতি ভেঙে দেয়। ফ্রান্সের জনমত সন্ত্রাসের বিপক্ষে গেলে, কনভেনশনের আদেশে সন্ত্রাস সম্পর্কিত সব ব্যবস্থার বিলোপ সাধন করা হয়। তখন জাতীয় সম্মেলনে প্রধান্য বিস্তার করতে থাকে মধ্যপন্থী জিরোন্ডিস্ট দল। এর মধ্য দিয়ে জাতীয় সম্মেলন বৈপ্লবিক চরিত্র হারিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণির নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
থার্মিডরীয় প্রতি-বিপ্লবের ফলে জ্যাকবিন দলকে দমনের জন্য পাল্টা সন্ত্রাস শুরু হয়। যদি জ্যাকোবিন দলের সন্ত্রাসকে ‘লাল সন্ত্রাস’ বলা হয়, তবে এই প্রতি-বিপ্লবী সন্ত্রাস ছিল- ‘শ্বেত সন্ত্রাস’। এই সন্ত্রাসের ফলে জ্যাকোবিন ও সাঁকুলেৎ শ্রেণি নিহত হয়। দোকানের কর্মচারী ও বেকার যুবকদের সাহায্যে এক প্রতি-বিপ্লবী বাহিনী গঠন করা হয় যার চলতি নাম ছিলো মাস্কাদিন (Masscadin)। মাস্কাদিনদের মধ্যে এক ধর্মান্ধ গোষ্ঠী গ্রামাঞ্চলে জ্যাকোবিনদের হত্যা করে। কিছুকাল পরে থেমে যায় ‘শ্বেত সন্ত্রাস’।
রোবসপীয়েরের পতনের পর জাতীয় সম্মেলন ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে এক নতুন সংবিধান গ্রহণ করে। এই সংবিধান অনুযায়ী যে নতুন সরকার গঠিত হয় তা ইতিহাসে ডাইরেক্টরীর শাসন নামে সমধিক পরিচিত।এই নতুন সংবিধানে সরকারের কার্যনির্বাহী ক্ষমতা ৫ সদস্যবিশিষ্ট এক সমিতির হাতে দেওয়া হয়। অর্ধশত সদস্যের নামের একটি তালিকা উচ্চকক্ষে পাঠাতো নিম্ন পরিষদ। উচ্চকক্ষ সদস্যরা তার মধ্য থেকে ৫ সদস্যকে ডাইরেক্টর হিসেবে ৫ বছরের জন্য নির্বাচন করে। ডাইরেক্টর ক্ষমতা বিভাজন তত্ত্ব অনুযায়ী শুধু প্রশাসনিক ক্ষমতা ভোগ করতো। আইনসভা থেকে পাশকৃত আইন যথাযথ প্রয়োগ করা ছিল তাদের দায়িত্ব।
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার ব্যবস্থা করা হয়। এই আইনসভার নিম্নকক্ষের নাম হয় পাঁচশতের পরিষদ আর উচ্চকক্ষের নাম হয় প্রবীনদের পরিষদ। ডাইরেক্টরির আইনসভার নির্বাচনে সর্বসাধারণের ভোটাধিকার স্বীকৃত না হয়ে বরং সম্পত্তির ভিত্তিতে নিম্নকক্ষের সদস্যদের নির্বাচনের ব্যবস্থা হয়। এর ফলে প্রকৃত গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়। ধনী বুর্জোয়া শ্রেণি আবারও ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
আইনসভার দুই কক্ষ থেকে প্রতি বছর এক-তৃতীয়াংশ আসন শূন্য হলে নতুন সদস্য দ্বারা তা পূর্ণ করার ব্যবস্থা করা হয়। নতুন আইনসভা গঠিত হলে যাতে উগ্রপন্থী জ্যাকোবিনরা ঢুকে না পড়ে এই কারণে ন্যাশনাল কনভেনশনের ৫০০ সদস্যকে আইনসভায় আসন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সংবিধানটি গণভোটে পাশ করিয়ে নেওয়া হয় । মাত্র দুই লাখ লোকের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা সংবিধানকে কার্যকর করা হয়। প্যারিসের একটি সেকশন ভোটদানে বিরত থাকে। মূলত এই সংবিধানের ত্রুটি ছিল এই যে এই সংবিধান আবারও বুর্জোয়াদের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এই সংবিধানকে তাই থার্মিডরীয় প্রতিক্রিয়ার সন্তান হিসেবে ধরা যায়। ফলে প্রশাসন ও আইনসভার মধ্যে মীমাংসার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। এজন্য সংকট দেখা দিলে ডাইরেক্টরিরা বলপ্রয়োগের দ্বারা আইনসভার বিরোধী কোনও সদস্যদের বহিষ্কারের নীতি নেন। সংবিধানের এই দুর্বলতাই পরে ডাইরেক্টরির পতন ঘটায়।
দ্বিতীয়ত, গণভোট-রদের ফলে সাধারণ লোক ডাইরেক্টরির সংবিধানকে অবৈধ বলতে থাকে। ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ অক্টোবর প্যারিসের সেকশনগুলো থেকে জনতা আইনসভা আক্রমণের চেষ্টা করে। এই বিদ্রোহে সেকশনগুলোর পক্ষে গণতন্ত্রীরাও যোগ দেয়। ২৫ হাজার লোক যারা আগে জ্যাকোবিনপন্থী ছিল, আইনসভা ঘেরাওয়ের চেষ্টা করলে যুবক সেনাপতি নেপোলিয়ন তাদের বিদ্রোহের পর রুদ্ধ করে দেন।
ডাইরেক্টরি এভাবে বাম ও দক্ষিণপন্থীদের দমন করে একটি মধ্যপন্থা অবলম্বনের মধ্য দিয়ে ফ্রান্সে স্থিতিশীলতা আনয়নের চেষ্টা করে। এ সময় সেনাপতি পিশেগ্রুর নেতৃত্বে আবারও রাজতন্ত্রী বিদ্রোহ ঘটে। ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে বহু রাজতন্ত্রী নির্বাচনে নির্বাচিত হয়। ৫ জন ডাইরেক্টরের মধ্যে অন্তত ২ জন ডাইরেক্টর রাজতন্ত্রের সমর্থন ফ্রুক্তিদরের সন্ত্রাস সংঘটিত হয় যা ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দের ৪ সেপ্টেম্বর ডাইরেক্টর সেনাপতি নেপোলিয়নের সহায়তায় দমন করা হয়।
কর্নোৎ ও বার্থেলোমি বহিষ্কৃত হন ও আইনসভার ১১৮ জন নবনির্বাচিত সদস্যকে বহিষ্কার করা হয়। এই সময় থেকে ডাইরেক্টরী ক্রমশ জনসমর্থন অপেক্ষা সামরিক শক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এভাবে এই সরকারের পতনের পথ প্রশস্ত হয়।
১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব ছাড়া মানব জাতির ইতিহাসে ফরাসি বিপ্লবের মতো সুদূরপ্রসারী বিপ্লব আর ঘটেনি। ‘দানবীয় ঝাঁটার’ মতো এই বিপ্লব বহু পুরাতন সমাজব্যবস্থাকে আঘাত করে নতুন সমাজব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে।
লোপ হয় সামন্ত প্রথা: মধ্যযুগ থেকে ফ্রান্সে অভিজাত ও সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিল। অভিজাতরা প্রায়ই ফ্রাঙ্কিশ বিজেতাদের বংশধর দাবি করতো এবং তারা বিশেষ অধিকার ভোগ করতো বলে জমিদারি, সামন্ত কর, সরকারি চাকরির একাধিপত্য ভোগ করতো। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ আগস্ট ফরাসি বিধানসভা সব ধরনের সামন্ত কর, সামন্ত স্বত্ব বিলোপ করে। দেশত্যাগী সামন্ত বা এমিগ্রিদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়।
স্বাধীন কৃষক শ্রেণির উদ্ভব: সামন্ত প্রথা বিলোপের ফলে ফ্রান্সে নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠে। স্বাধীন কৃষক শ্রেণি বাজেয়াপ্ত করা ভূমি ক্রয় করে সম্পদশালী হয়ে ওঠে। তারাই গ্রামাঞ্চলের প্রধান শক্তিতে রূপান্তর হয়। তাদের ওপর শোষণমূলক টাইদ বা ধর্ম কর, কর্ভি বা বেগার প্রভৃতি কর প্রথা থেকে মুক্ত হয়। ভূমিদাস শ্রেণি মুক্ত হয় ভূমি দাস প্রথা থেকে। ব্যানালিতে বা সামন্ত কর, ম্যানর প্রথা লুপ্ত হয়। ফলে বহুলাংশ স্বাধীন জীবিকা গ্রহণ করে।
সাঁকুলেৎ শ্রেণির স্বার্থ উপেক্ষিত: ফরাসি বিপ্লব সাঁকুলেৎ শ্রেণির কোনও উপকারে আসেনি। ‘ল অব ম্যাক্সিমাম’ ও ‘ল অব মিনিমাম’ দ্বারা কিছুদিনের জন্য তাদের উন্নতির চেষ্টা করা হলেও থার্মিডিরীয় শাসনামলে এই আইনগুলো রদের ফলে সাঁকুলেৎ শ্রেণির দুরস্থা বিদ্যমান থেকে যায়।
লেফেভারের মতে, সাঁকুলেৎ শ্রেণি জীবিকার অধিকার ও কাজের অধিকার প্রভৃতি যেসব দাবি জানায় থার্মিডরীয় ফরাসি বিপ্লবের সময় বুর্জোয়া নেতারা এসব দাবি পূরণ করতে অনিচ্ছুক থাকায় সাঁকুলেৎ শ্রেণীর স্বার্থ উপেক্ষিত হয়।
বুর্জোয়া শ্রেণির স্বার্থরক্ষা: ফরাসি বিপ্লবকে ক্ষুদ্র দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এটি ছিল মূলত বুর্জোয়াদের জন্য বিপ্লব। ফলে উপেক্ষিত থাকে সাঁকুলেৎ শ্রেণির স্বার্থ। একচেঁটিয়া অধিকার ভোগ করতে থাকে বুর্জোয়া শ্রেণি।
বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের প্রতি আস্থা লোপ: ফরাসি বিপ্লব ছিলো বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। সুতরাং এই বিপ্লবের ফলে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের ওপর থেকে আস্থা কমে আসে।
গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা: জ্যাঁ জ্যাঁক রুশো প্রণীত সামাজিক চুক্তি (Social Contract) গ্রন্থে গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার রূপরেখা তৈরি করা হয়।
মানবতাবাদী ও উপযোগবাদী সংস্কার প্রবর্তন: ফরাসি বিপ্লবের ফলে মানবতাবাদী ও উপযোগবাদী সংস্কার প্রবর্তন করা হয়।
১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ইতালির কর্সিকা নামক দ্বীপের আজাসিও (Ajacio) নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা কার্লো বেনাপোর্ট ও মাতা লেটিজিনা বোনাপোর্ট। বোনাপার্টের জন্মের কিছুদিন পূর্বে কর্সিকা দ্বীপটি ফ্রান্সের অন্তর্ভুক্ত হয়। ফলে পরিণত বয়সে তিনি ফ্রান্সের নাগরিকত্ব লাভ করেন । প্রথম জীবনে তিনি ব্রিয়োন প্যারিসের সামরিক স্কুলে শিক্ষা লাভ করেন। ইতিহাস, গণিত, যুদ্ধবিজ্ঞান ও সমকালীন দার্শনিকদের রচনা ছিল তার প্রিয় বিষয়। ১৬ বছর বয়সে পিতৃহারা হন। ১৭ বছর বয়সে সামরিক বাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগদান করেন ও ব্রিটিশ বাহিনীকে Toulon বন্দর থেকে বিতাড়িত করে অসামান্য খ্যাতি অর্জন করেন। এটি তার সামরিক জীবনে সর্বপ্রথম সাফল্য। ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে রাজতন্ত্রীদের বিদ্রোহ দমনের পর তিনি জাতীয় সম্মেলন বা ন্যাশনাল কনভেনশনকে রক্ষা করেন। ডাইরেক্টরির শাসনামলে ইতালি অভিযানের সেনাপতি নিযুক্ত হন তিনি। ইতালি অভিযানের সাফল্য তাকে খ্যাতি ও গৌরবের উচ্চসীমানায় নিয়ে যায়।
১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে দুর্নীতিপরায়ণ ডাইরেক্টরির পতন ঘটিয়ে ফ্রান্সে কনসুলেট নামে নতুন শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। নতুন সংবিধান অনুযায়ী শাসনব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয় তিনজন কনসালের ওপর। সিয়াস, ডুকাস ও নেপোলিয়ানকে নিয়ে কনসুলেট গঠিত হয়। সংবিধানে নেপোলিয়ন প্রথম কনসাল হন ও অন্য দুজন তার সহযোগী নিযুক্ত হন। প্রথম কনসালকে সব ক্ষমতার অধিকারী, আইন প্রণয়ন ও সামরিক-বেসামরিক কর্মচারী নিয়োগ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। তিনি প্রথম কনসাল হিসেবে নতুন সংবিধান রচনার গুরুদায়িত্ব অর্পন করেছিলেন সাইয়াসের ওপর। সাইয়াস যে সংবিধান রচনা করেছিলেন তার মূল কথা হলো, ‘কতৃত্ব উপর তলার আর আস্থা নীচ তলার’। ফলে নতুন সংবিধান ছিলো গণতন্ত্রের আবরণে একনায়কতন্ত্র।
প্রথম কনসাল হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের পর ফ্রান্সের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। তিনি ফ্রান্সে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অথচ বুরবোঁ রাজবংশের বিরুদ্ধে ফরাসি বিপ্লবের সূত্রপাত হয়েছিল। এজন্য অনেকে নেপোলিয়নকে ফরাসি বিপ্লবের মৃত্যুবাণ বলে মনে করেন। একথা সত্য যে তিনি প্রথম কনসাল হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু নেপোলিয়নের আদর্শ ও লক্ষ্য ফরাসি বিপ্লবের ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে ছিল না। তার মানসিকতা অতীতমুখী হলে তিনি বিপ্লবের যুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
নেপোলিয়ন ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ স্বাধিকারবাদের বিরোধী ছিলেন। তিনি জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি মনে করতেন রাজনৈতিক স্বাধিকারবাদ শক্তিশালী সরকার গঠনের পথে অন্তরায়। এই কারণে তিনি নির্বাচনের বদলে মনোনয়ন প্রথা চালু করেছিলেন। আইনসভাকে সার্বভৌমিক ক্ষমতা হতে বঞ্চিত করেছেন। তিনি মূলত জ্যাকোবিন যুগের প্রজাতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র ছেড়েছিলেন। এদিক থেকে বিচার করলে তাকে বিপ্লবের বিনাশক বলা যেতে পারে। কিন্তু ফরাসি বিপ্লবের মৈত্রী ও সাম্যবাদে তাঁর সম্পূর্ণ বিশ্বাস ছিল এবং তিনি সংস্কারের মধ্য দিয়ে এই আদর্শ প্রতিফলিত করেছিলেন। তার বিখ্যাত আইনবিধি (Code Nepoleon) সাম্যবাদের জ্বলন্ত নিদর্শন। তিনি বিশ্বাস করতে আইনের চোখে সবাই সমান এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। চাকরি লাভের ক্ষেত্রে বংশগত পদমর্যাদার চেয়ে ব্যক্তিগত যোগ্যতাকে তিনি বড় করে দেখেছেন। পিতার সম্পত্তিতে সব সন্তানের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। তার সময়ে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শকে রক্ষা করা হয়। ইউরোপে বিপ্লবের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। এজন্য অনেকে তাকে বিপ্লবের উত্তরাধিকারী বলেও অভিহিত করে থাকেন (শেষ)।