বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সে প্রকট আকার নেয় শ্রেণিবৈষম্য

হাসনাত আসিফ কুশল

জুলাই ২৯, ২০২৪, ০৩:৩১ পিএম

বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সে প্রকট আকার নেয় শ্রেণিবৈষম্য

স্বৈরাচারী শাসনের কবলে এবং যাজক ও অভিজাত শ্রেণির ক্রমাগত চাপে পড়ে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে ফ্রান্সের তৃতীয় শ্রেণি।

১৫৬১ খ্রিস্টাব্দে তাদের সঙ্গে ফরাসি রাজার পৌইসির চুক্তি হওয়ার ফলে রাজা তাদের ওপর করারোপ করতে পারতেন না। অভিজাতরা নিজেদের ‘ফ্রাঙ্কিশ বিজেতাদের বংশধর’ বলে দাবি করতেন। রাজা নিজেও ছিলেন অভিজাত শ্রেণির অন্তর্গত। সেই অনুযায়ী রাজা নিজেও ‘ফ্রাঙ্কিশ বিজেতাদের বংশধর’ বলে দাবি করতেন।

ফ্রান্সের রাজার এহেন স্বৈরাচারী মনোভাব, অভিজাত শ্রেণির অহংবোধ ও যাজক শ্রেণির ক্রমবর্ধমান ঔদ্ধত্য ফ্রান্সের অর্থনীতিকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে রেখেছিল। মধ্যযুগে সামন্ত প্রথার কারণে ফ্রান্সের সমজে শ্রেণি বৈষম্য তীর্যক রূপ ধারণ করে। প্রাক-বিপ্লব ফ্রান্সের সমাজব্যবস্থা যাজক শ্রেণি, অভিজাত শ্রেণি ও তৃতীয় শ্রেণি- এই ৩ শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল।

যাজক শ্রেণি

অষ্টাদশ শতাব্দিতে ফ্রান্সের সমাজব্যবস্থা ৩ শ্রেণিতে বিন্যস্ত ছিল। যাজকরা ছিলেন তার মধ্যে প্রথম শ্রেণি। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে যাজকদের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৩০ হাজার। যাজক শ্রেণিতেও ছিল ভেদাভেদ।

ফ্রান্সের মোট লোকসংখ্যা ছিলো ২৫ মিলিয়ন । এর মধ্যে শতকরা ৯৩ ভাগ ছিলো তৃতীয় শ্রেণি তথা Third state’র অন্তর্ভূক্ত

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন যুগে যেমন হিন্দু তথা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বর্ণাশ্রম ও চতুরাশ্রম প্রথা তেমনই সেই সময় ফ্রান্সে নানা ধরনের প্রথা উদ্ভুত হয়েছিল। কৃষকদের ওপর সামন্ত প্রথার ফলে নির্যাতন ছিলো অবর্ণনীয়। যাজকদের মধ্যেও ছিলো না মিল। উচ্চ যাজক ও নিম্ন যাজক এই দুই ভাগে সুবিন্যস্ত ছিলেন। এ ছাড়া যাজকদের দিতে হতো টাইদ বা ধর্ম কর বা গির্জা কর যা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ছিল অমানবিক। ফরাসি মন্ত্রী নেকারের মতে, ফ্রান্সের গির্জার বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ছিল ১৩ কোটি লিভর। খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে গির্জার জমির ফসল চড়া মূল্যে বিক্রয় করে অনেক লাভ হতো। গির্জার এই বিপুল অর্থ উচ্চ যাজক বা বিশপ শ্রেণিই ভোগ করতো।

অভিজাত শ্রেণি

সমাজের দ্বিতীয় শ্রেণিতে ছিল অভিজাত শ্রেণি। ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে অভিজাতদের সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৫০ হাজার। দেশের জনসংখ্যার এক থেকে দেড় ভাগই ছিলো অভিজাতরা (Court Nobility)। এরা ছিলেন বংশ মর্যাদার দাবিদার। স্বয়ং রাজা ছিলেন অভিজাত। সেই দোহাই দিয়ে অভিজাতরাই সবসময় privilege ভোগ করতেন।

French-revolution

অভিজাতরা নিজেদের ‘ফ্রাঙ্কিশ বিজেতাদের বংশধর’ বলে দাবি করতেন। ফরাসি রাজাও এই দলে থাকায় রাজার স্বৈরাচার চরমে ওঠে।

অভিজাতদের মধ্যে বিভিন্ন উপগোষ্ঠী ছিল-

প্রাচীন বনেদী ঘরের অভিজাত: রাজার সভাসদ, সেনাপতিও বিচার বিভাগের উচ্চপদ; একচেঁটিয়া অধিকারে ছিলো রাজার মন্ত্রিপরিষদ, আইন পরিষদ, রাষ্ট্রদূত, প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও সামরিক বিভাগের উচ্চপদগুলো।

ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে

গ্রামীণ অভিজাত: গ্রামাঞ্চলের জমিদার শ্রেণি ও প্রাদেশিক সভায় প্রতিপত্তি খাটাত।

  • গ্রামীণ অভিজাতরা জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি ও সেই অনুপাতে তাদের আয়বৃদ্ধি না হওয়ায় ক্রমেই দরিদ্র হয়ে পড়ে। এরা কায়িক শ্রমের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনে অনাগ্রহী ছিল।

চাকরিজীবী অভিজাত: ধনী বুর্জোয়াদের একাংশ সামাজিক মর্যাদা ও ক্ষমতা লাভের জন্য পার্লামেন্টের বিচারক ও প্রদেশের ইন্টেন্ডেন্টের পদ বংশানুক্রমিকভাবে কিনে নিতো। এসব পদ তারা বংশানুক্রমিকভাবে ভোগ করতো।

এরা ছিল বংশ মর্যাদার দাবিদার। স্বয়ং রাজা ছিলেন অভিজাত সম্প্রদায়ের । সুতরাং অভিজাতরাই সবসময় privilege ভোগ করতেন।

তৃতীয় শ্রেণি

প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি ছাড়া ফ্রান্সের বাকি লোকেরা তৃতীয় শ্রেণির অন্তর্ভূক্ত। বুর্জোয়া, মধ্যবিত্ত, শ্রমিক, কৃষক, দিনমজুর প্রভৃতি সবাই ছিল তৃতীয় শ্রেণির অন্তর্গত। তৃতীয় শ্রেণীকে তাই Unprivileged বা অধিকারহীন শ্রেণি বলা হয়। ফ্রান্সের মোট লোকসংখ্যা ছিল আড়াই কোটি। এর মধ্যে তৃতীয় শ্রেণি তথা Third state’র অন্তর্ভুক্ত ছিল ৯৩ শতাংশ।

করের বোঝা

বিপ্লব-পূর্ব ফ্রান্সের সমাজ অধিকারভোগী ও অধিকারহীন এই দুই শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। দেশের ভূ-সম্পত্তির ৪০ শতাংশ সুবিধাভোগী দুই শ্রেণির বহাল নিয়ন্ত্রণে ছিল। তাদেরকে ন্যায়সঙ্গত কর দিতে হতো না। যাজকরা খুব কমই কর দিতেন। ফলে করের বোঝা গিয়ে পড়ে অধিকারহীন শ্রেণি অর্থাৎ কৃষক, কারিগর ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর। ফ্রান্সের বুরবোঁ রাজবংশের অর্থনীতিই এই সংকটের জন্য দায়ী ছিল। ফ্রান্সে তিনটি প্রধান কর ছিল- টেইলে বা ভূমি কর, ক্যাপিটেশন বা আয়কর ও ভিংটিয়েমে বা উৎপাদন কর। কিন্তু ফ্রান্সে যাজক ও অভিজাত শ্রেণি যথাক্রমে এক-দশমাংশ ও এক-পঞ্চমাংশ ভূ-সম্পত্তির মালিক। তাছাড়া ১৫৬১ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের রাজার সঙ্গে যাজক শ্রেণীর পৌ-ইসির চুক্তি হওয়ায় রাজা তাদের ওপর কর আরোপ করতে পারতেন না। অভিজাতরাও ক্যাপিটেশন বা আয়কর ও ভিংটিয়েমে বা উৎপাদন কর সুকৌশলে এড়িয়ে যেত। ইন্টেন্ডেন্ট নামক রাজকর্মচারীরা দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ছিল।

ফ্রান্সের বুরবোঁ রাজবংশ

তিনটি প্রত্যক্ষ কর ছাড়াও ফ্রান্সের বুরবোঁ রাজবংশ গ্যাবেলা (Gabella) বা লবণ শুল্ক, বাণিজ্য শুল্ক প্রভৃতি কর আদায় করতো। রাজার কর আদায়ের একমাত্র উৎস ছিল তৃতীয় শ্রেণি। ফলে তৃতীয় শ্রেণি করের যোগান দিতে গিয়ে সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া যাজকদের ফসলের এক-দশমাংশ জমির ওপর দিতে হতো টাইদ (Tithe) বা ধর্ম কর। সামন্ত প্রভুদের জন্যে কর্ভি বা বিনা মজুরিতে কাজ করে দেওয়া, বানালিতে (Banalites) প্রভৃতি বাধ্যতামূলকভাবে কর দিতে হতো। এভাবে তৃতীয় শ্রেণির মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর কর্তৃত্ব করতে থাকে ফরাসি বুরবোঁ রাজবংশ।

করবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধির সমস্যা যেন প্রকট হয়ে ওঠে। একেই কর দিতে দিতে নাজেহাল, তার ওপর বাজারের পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি যেন জনজীবনের নাভিশ্বাস আরও বাড়িয়ে তোলে (চলবে)।

Link copied!