আগের পর্বের পর: ফরাসি বিপ্লবের পেছনে রসদ জুগিয়েছিল অর্থনৈতিক দুরাবস্থা। সবচেয়ে অন্ধকারময় দিক হলো রাজকোষের যথেচ্ছাচার।
ফরাসি বিপ্লবের কারণ ও ফলাফল, ফ্রান্সের বিভাজন, রাজা ও অভিজাতদের জনবিচ্ছিন্নতা এবং রাজন্যবর্গের দুর্বলতা, রাজতন্ত্রের শবযাত্রা, বাস্তুল দুর্গের পতন নিয়ে আমাদের অনেকেরই আগ্রহ রয়েছে। আগের পর্বে ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে সামাজিক শ্রেণিবৈষম্যের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এই পর্বে উপস্থাপন করবো ফরাসি বিপ্লবের প্রেক্ষাপট, কারণ ও ফলাফলের চিত্র।
বিপ্লবের প্রেক্ষাপট, কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে চলুন জেনে আসা যাক-
দাম্ভিক ঘোষণা, ‘আমিই রাষ্ট্র’ (I am the state)
ঐতিহাসিক গুডউইনের মতে ভার্সাইয়ের রাজসভায় ১৮ হাজার কর্মচারী নিযুক্ত; যাদের মধ্যে ১৬ হাজার কর্মচারী ছিলো শুধু রাজপ্রাসাদের কাজের জন্যই বহাল ছিল। রাণীর খাস চাকরের সংখ্যা ছিল ৫০০। রাণী নিত্যনতুন ভোজসভার আয়োজন করতেন এবং ভোজসভা ও পোশাকের পেছনে প্রচুর ব্যয় করতেন। রাজপরিবারের অতিরিক্ত ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য জন্য রাজাকে বহু অর্থ ঋণ করতে হয়।
১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স-জার্মানির সঙ্গে সেডানের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে ফ্রান্সের রাজকোষ শূন্য হয়ে যায়। ফ্রান্সের জাতীয় অর্থনীতিতে ধ্বস নামার এটাও একটি কারণ হতে পারে।
শুধু আমেরিকা তথা যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অর্থমন্ত্রী নেকার ঋণ নেন ১০০ কোটি লিভর। ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে রাজাকে ঋণের সুদের দরুণ ৩১ কোটি ৮০ লাখ লিভর ব্যয় করতে হতো। এর সঙ্গে সরকারের অন্যান্য খরচ যুক্ত হলে মোট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৩ কোটি লিভর।
রাজা চতুর্দশ লুই (১৬৪৩-১৭১৫ খ্রিস্টাব্দ) বিলাসব্যসনে মগ্ন থেকে স্বেচ্ছাচারী শাসনের ভিত্তি দাঁড় করিয়েছেন। তিনি দাম্ভিক ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আমিই রাষ্ট্র’ (I am the state.) তার উত্তরাধিকারী পঞ্চদশ লুই ছিলেন বিলাসী, অলস ও পরিশ্রমবিমুখ। ‘প্রজাপতি রাজা’ বলে পরিচিত এই রাজা তার রাণী উপপত্নী মাদাম-দ্য-পম্পদুয়্যরের প্রভাবাধীন ছিলেন। পঞ্চদশ লুইয়ের দুর্বলতার সুযোগে উপপত্নী পম্পদুয়্যর রাজকার্যে হস্তক্ষেপ করতেন প্রতিনিয়ত। এজন্য গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত মন্ত্রী ও অভিজাতদের ওপর ছেড়ে দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত থাকতেন। ঐতিহাসিক শেভিলের মতে, রাজার নামে অভিজাতরাই প্রশাসন চালাতে থাকেন। ফরাসি রাজসভা স্বার্থান্বেষী অভিজাতদের লীলাভূমিতে পরিণত হয়।
ফ্রান্সের সর্বশেষ রাজা ষোড়শ লুই ছিলেন দুর্বলচিত্ত শাসক। তার সময়ে রাজতন্ত্রে অবক্ষয়ের মাত্রা বেড়ে যায়। তিনি ছিলেন ভোজনবিলাসী ও স্ত্রৈণ। চারিত্রিক দৃঢ়তা তার মধ্যে কোনওভাবেই ছিল না। তিনি ছিলেন প্রথম রাণী মাদাম-দ্য-তুসোর নিয়ন্ত্রণাধীন ও দ্বিতীয় রাণী মেরী এন্টোয়নেটের প্রভাবাধীন। সেই কারণে তিনি পত্নী, অভিজাত, সভাসদ ও মন্ত্রী কাউকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি।
ফরাসি বিপ্লবের গতি যেমন ছিল বৈচিত্র্যময়, তেমনই ছিল ব্যাপক। ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চদশ লুইয়ের পর ষোড়শ লুই ফ্রান্সের রাজা হন। ষোড়শ লুই ছিলেন ভোজনবিলাসী ও স্ত্রৈণ রাজা। পিতা ও পিতামহের মতো তিনিও স্বেচ্ছাচারী পথ অবলম্বন করেন। ক্রীড়নক ছিলেন মেরি এন্টোয়নেট ও মাদাম-দ্য-তুসোর। ক্রমাগত বহিঃশত্রুর মোকাবেলা ও নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর ফলে ফ্রান্সের রাজকোষ অচিরেই শূন্য হয়ে পড়ে।
এ সময় জনসাধারণের ওপর করবৃদ্ধি করে ফ্রান্সের অচলাবস্থা মোচন করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না। ফলে টুর্গোকে আর্থিক সংস্কারের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। তিনি ছিলেন দক্ষ ও সাহসী অর্থমন্ত্রী। ফ্রান্সে তিনি অবাধ বাণিজ্য নীতি প্রবর্তন, গিল্ড উচ্ছেদ ও কৃষকদের ওপর থেকে বিশেষ কর উচ্ছেদের ঘোষণা দিলে অভিজাতবর্গ নাখোশ হন। বিদ্রোহ করতে থাকে অভিজাতরা। তাদের চাপে রাজা টুর্গোকে বরখাস্ত করতে বাধ্য হন। পরে ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে ব্যাংকার নেকারকে টুর্গোর স্থলাভিষিক্ত করা হয়। তিনি ফ্রান্সের অর্থনীতি ব্যয় সংকোচন নীতি প্রবর্তন ও ভূমি সংস্কারের চেষ্টা করেন। কিন্তু অভিজাতদের চাপের মুখে তিনিও ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে পদত্যাগে বাধ্য হন।
নেকারের পদত্যাগের পর অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ ক্যালোন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তিনি সরকারের আয়ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যে অভিজাত ও যাজক শ্রেণির ওপর কর ধার্যের প্রস্তাব করেন। এ ছাড়া তিনি ‘কর্ভি’ নামক বাধ্যতামূলক শ্রমদান নিষিদ্ধকরণ ও লবণ কর সব শ্রেণির ওপর আরোপের প্রস্তাব দেন। তার এই প্রস্তাব জনসাধারণের কাছে প্রশংসিত হলেও অভিজাতরা এর বিরোধিতা করেন। ষোড়শ লুই ক্যালোনের প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য গণ্যমান্য অভিজাতদের সভা ডাকার নির্দেশ দেন। কিন্তু গণ্যমান্যরা সুবিধাভোগী থাকায় এই প্রস্তাব প্রত্যাখাত হয়। নিরুপায় রাজা ষোড়শ লুই অর্থমন্ত্রী ক্যালোনকে পদচ্যুত করেন। ক্যালোনের পরে অর্থমন্ত্রী করা হয় ব্রিয়েনকে। পরিস্থিতির চাপে তিনি সংস্কার কর্মসূচি নিতে বাধ্য হন। ব্রিয়েন রাজার নির্দেশ অনুসারে আর্থিক সংস্কারের প্রস্তাবনা পার্লামেন্টে পেশ করলে এই প্রস্তাবও প্যারিসের পার্লামেন্ট নাকচ করে দেয়।
প্রকৃতপক্ষে অভিজাত শ্রেণি তাদের স্বার্থ বহির্ভূত একের পর এক কর প্রস্তাব প্রত্যাখান করতে থাকে। কিন্তু সেই সময় ফ্রান্সের অর্থনীতি এতটাই করুণ দশায় গেছিল যে সব শ্রেণির ওপর করারোপ ছাড়া কোনও পথ খোলা ছিল না। পরিস্থিতির উত্তোরণের জন্য রাজা স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন ডাকলেন।
সুদীর্ঘ ১৭৫ বছর পর ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৫ মে ভার্সাইয়ের রাজসভায় স্টেটস জেনারেল নামক জাতীয় সভার আয়োজন হয়েছিল। ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে এ-জাতীয় সভার আহ্বান অবিস্মরণীয় অধ্যায়। কারণ এদিন থেকেই বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল। এই রাজসভায় তখন মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ১ হাজার ২১৪ জন। এর মধ্যে যাজকদের সংখ্যা ছিলো ৩০৮ জন, অভিজাতদের সংখ্যা ছিল ২৮৫ জন ও তৃতীয় শ্রেণির সংখ্যা ছিলো ৬২১ জন। তৃতীয় শ্রেণির সদস্যদের মধ্যে ৩৬০ জন ছিলেন আইনজীবী। কিন্তু এ সব সদস্যের একটি করে ভোট ছিল না। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও কোনও লাভ হতো না। কেননা অভিজাত ও যাজক শ্রেণির বিরোধিতার জন্য রাজা তৃতীয় শ্রেণির দাবি-দাওয়া মানতে রাজি হতেন না।
আমরা জনগণের প্রতিনিধি, আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাদেরকে এখান থেকে বহিষ্কার করতে হলে একমাত্র বলপ্রয়োগ ভিন্ন অন্য কিছুতেই সম্ভব নয়
কয়েকদিন অপেক্ষার পরেও রাজার কাছ থেকে সন্তোষজনক উত্তর না আসায় ১৭ জুন স্টেটস জেনারেলের তৃতীয় শ্রেণীর প্রতিনিধিরা নিজেদেরকে ফ্রান্সের জাতীয় সভা ঘোষণা করে ও কর ধার্যের অধিকার নিজেদের হাতে তুলে নেন। এমতাবস্থায় অভিজাত ও যাজক শ্রেণির চাপের মুখে রাজা ষোড়শ লুই তৃতীয় শ্রেণির প্রতিনিধিদেরকে দমন করতে মনঃস্থির করেন। তিনি আবারও স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। কিন্তু রাজার এই সিদ্ধান্তের কথা তৃতীয় শ্রেণির প্রতিনিধিরা জানতেন না। ফলে ২০ জুন তারা এসে দেখেন সভাগৃহ বন্ধ রয়েছে ও প্রবেশপথে সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছে। তখন তারা বাধ্য হয়ে পার্শ্ববর্তী টেনিস খেলার মাঠে উপস্থিত হন ও সেখানে অবস্থান নেন। সেখানেই তারা ঐতিহাসিক শপথ নিয়েছিল, যতদিন তারা ফ্রান্সের জন্য একটি নতুন শাসনতন্ত্র রচনা করতে না পারবেন ততোদিন পর্যন্ত তারা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ চালিয়ে যাবেন।
এমতাবস্থায় রাজা ষোড়শ লুই ২৩ জুন স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন আহ্বান করে জাতীয় সভার কর্মকাণ্ডকে বেআইনি বলে ঘোষণা করেন ও প্রতিনিধি সভার তিনটি শ্রেণীকে পৃথক পৃথক কক্ষে মিলিত হওয়ার নির্দেশ দেন। রাজার এ ঘোষণার ফলে সদস্যদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। রাজার বক্তৃতা শেষ হলে অভিজাত ও যাজক শ্রেণীর সদস্যরা পরিষদকক্ষ ত্যাগ করলেও তৃতীয় শ্রেণীর সদস্যরা কক্ষ ত্যাগ করেননি। সভাগৃহে রাজার পরিচালক তাদেরকে সভাকক্ষ ছাড়তে বললে জননায়ক মিরাবো (Mirabeau) দৃঢ়কণ্ঠে উত্তর দেন, আমরা জনগণের প্রতিনিধি, আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাদেরকে এখান থেকে বহিষ্কার করতে হলে একমাত্র বলপ্রয়োগ ভিন্ন অন্য কিছুতেই সম্ভব নয়।
পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে রাজা শেষ পর্যন্ত তিন শ্রেণির প্রতিনিধিদের একত্রে যোগদান করে মাথাপিছু ভোটদানের অধিকার মঞ্জুর করেন। রাজা কতৃক জনসাধারণের দাবি মেনে নেওয়ার ফলে তাদের প্রাথমিক সাফল্য লাভ হয়। এভাবে বিপ্লবের গতি সর্বাগ্রে সহজ ও অপ্রতিহত হয়ে উঠল। প্যারিস নগরী বিপ্লবের মঞ্চে পরিণত হলো। এই সময় ফ্রান্সের অন্যত্র কৃষির অবনতি ও প্রচণ্ড শীতের প্রকোপে হাজার হাজার মানুষ শহরে কাজ ও খাদ্যের সন্ধানে গ্রাম থেকে শহরে চলে আসে। এসম বুভুক্ষু নরনারী প্যারিসে রুটির দোকান ও কারখানাগুলো বিধ্বস্ত করতে থাকে। এর আগে শহরে সশস্ত্র ডাকাত দলের আবির্ভাব ঘটে ও যত্রতত্র লুটতরাজ করতে থাকে। রাজা ষোড়শ লুই প্যারিস নগরীর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যর্থ হয়।
ভীতসন্ত্রস্ত রাজা আন্দোলনের প্রচণ্ডতায় বিচলিত হয়ে ভার্সাই নগরীর উপকণ্ঠে সেনা মোতায়েন করেন ২৭ জুন। শুরু হয় জনতার সাথে সেনাবাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষ। শীঘ্রই প্যারিসের নিয়ন্ত্রণ জনসাধারণের হাতে চলে যায়। রাস্তায় রাস্তায় গড়ে ওঠে ব্যারিকেড ও লুট হতে থাকে আগ্নেয়াস্ত্রের দোকান।
১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের অত্যাচারের প্রতীক বাস্তুল দুর্গ আক্রমণ করে ধূলিসাৎ করে দেয় উন্মত্ত জনতা। তারা বন্দিদিগকে মুক্ত করে কারাগারের অধিকর্তাকে হত্যা করে। বাস্তিল দুর্গের পতনের সঙ্গে সঙ্গে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের সমাধি প্রতিষ্ঠা হয়।
এই দুর্গের পতনের সঙ্গে সঙ্গে প্যারিসের শাসনভার বিপ্লবীরা নিজেদের হাতে তুলে নেয়। তারা নিজেদের মধ্য থেকে প্রতিনিধি নির্বাচন করে ‘প্যারিস কমিউন’ নামে অস্থায়ী পৌর পরিষদ গঠন করে। প্যারিস নগরীর শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য বিপ্লবীরা ন্যাশনাল গার্ড নামে এক জাতীয় রক্ষী বাহিনী গঠন করে। প্যারিসের মতো ফ্রান্সের অন্যান্য অঞ্চলেও একই ধরনের কামিউন গঠিত হয়।
এই দুর্গ পতনের সঙ্গে সঙ্গে কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। ভেঙে ফেলতে থাকে শোষণের যন্ত্রপাতি। এ সময় গুজব রটে, শহর থেকে অভিজাতরা ভাড়াটে লুটেরা শ্রেণি পাঠিয়ে গ্রামগুলোতে শস্যক্ষেত পুড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে কৃষকরা নিজেদের হাতে অস্ত্র তুলে নেয় ও তাদের সামন্ত প্রভুদের হত্যা করতে থাকে। কৃষকদের এই অপ্রত্যাশিত অভ্যুত্থানে যাজক ও অভিজাত শ্রেণি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ আগস্ট জাতীয় সভার অধিবেশন বসে এবং ১১ আগস্ট একাধিক আইন পাশ করে ফ্রান্সে যাজক ও অভিজাত শ্রেণি তাদের পূর্বতন সব সুবিধা প্রত্যাহার করেন। এর ফলে পূর্বতন সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে ও ফ্রান্সের ইতিহাসে আধুনিক যুগের সূচনা হয়।
বিপ্লবের গতিধারা ক্রমশ অনমনীয় হয়ে ওঠে। বিপ্লবের ফলে প্যারিসের খাদ্য সংকট (Food Crisis) তীব্র আকার ধারণ করে। বেকারত্ব বেড়ে যায়। এমতাবস্থায় খাদ্যাভাব চরমে পৌঁছলে ৫ অক্টোবর প্যারিসের কয়েক হাজার স্ত্রীলোক খাদ্যের দাবিতে ভার্সাই নগরীর দিকে রওনা হয়। এদের সঙ্গে লাফায়েলের নেতৃত্বে ২০ হাজার ন্যাশনাল গার্ড ভার্সাইয়ে যায়। মিছিল ভার্সাই নগরে উপস্থিত হয়ে রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করলে দুজন রক্ষী নিহত হয়।
যাই হোক, এ সময় লফায়েৎ ২০ হাজার জাতীয় রক্ষীদের সাহায্যে উন্মত্ত জনতার কবল থেকে প্রাসাদ রক্ষা করেন। ষোড়শ লুই বিক্ষোভের মুখোমুখি হয়ে জাতীয় পরিষদের সব আইনগুলোতে সম্মতি দেন। অতঃপর নারী জোট ও লাফায়েতের নেতৃত্বে জাতীয় রক্ষী বাহিনী রাজা, রাণী ও তাদের বালক পুত্রকে নিয়ে মিছিল করতে করতে প্যারিস নগরে আসে। এই ঘটনা ‘রাজতন্ত্রের শবযাত্রা’ বলে পরিচিত।
শুরু থেকেই বলে আসছি যে এই বিপ্লব ছিল নতুন ভাবাদর্শ, চিন্তাধারা প্রতিষ্ঠার বিপ্লব। এতে তাই দার্শনিকদের অবদান অনস্বীকার্য ছিল।
দার্শনিক হলব্যখ আধ্যাত্মিক ও ঈশ্বর চিন্তা অপেক্ষা বস্তুজগতে জনকল্যাণকেই প্রাধান্য দেন। তিনি বলেন, আদিতে মানুষ সুখী ছিল। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনাচারের জন্যই মানুষের দুঃখ-দুর্দশা বেড়েছে। হেল ভিসিয়াস বলেন, জনসাধারণের মঙ্গল বিধানই সব চিন্তার মূল।
ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে দার্শনিকরা মনে করতেন যে রাষ্ট্র ও সমাজের পশ্চাতে যে নিয়মগুলো (তন্ত্র-মন্ত্র) কাজ করে তা শুধু আবিষ্কার করলেই চলবে না; তাকে প্রয়োজন অনুযায়ী সংস্কার করতে হবে। তারা প্রাকৃতিক আইন ও যুক্তিবাদকেই গুরুত্ব দিতেন। একই সঙ্গে ভাবতেন ধর্মসহিষ্ণুতার কথা। ব্রিটিশ দার্শনিক ভ্যালক এই উদারনৈতিক বুদ্ধি বিভাসার সূত্রপাত করেন। পরে ফরাসি দার্শনিকরা এই ভাবধারাকে এগিয়ে নিয়ে যান (চলবে)।