করোনার পর ভারতে ডায়াবেটিকস সুনামির শঙ্কা

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

আগস্ট ১৪, ২০২১, ১২:৫২ এএম

করোনার পর ভারতে ডায়াবেটিকস সুনামির শঙ্কা

করোনা ভাইরাস সংক্রমণ থেকে ভারতে ভয়াবহভাবে ডায়াবেটিকস রোগী বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, করোনা মহামারির পর ভারতে দেখা দিতে পারে ‘ডায়াবেটিকস সুনামি’। 

ভারতে এ পর্যন্ত তিন কোটি ২০ লাখের বেশি কোভিড রোগী শনাক্ত হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের পরে বিশ্বে সর্বোচ্চ। বর্তমানে দেশটিতে  প্রায় ৭ কোটি ৭০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, যা চীনের পর বিশ্বে সর্বোচ্চ। চীনে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ১১ কোটি ৬০ লাখ।

করোনা আক্রান্ত রোগীকে ফুসফুসের প্রদাহ কমানোর জন্য দেওয়া হয় স্টেরয়েড। ফুসফুসের কিছু ক্ষতি বন্ধ করতেও সাহায্য করে এটা। কিন্তু একই সঙ্গে এটা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ডায়াবেটিস যাদের আছে, তারা এবং যাদের ডায়াবেটিস নেই— এমন উভয় শ্রেণির কোভিড-১৯ রোগীদের শরীরে চিনির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ফলে আগে ডায়াবেটিকস ছিল না, এমন মানুষ করোনা থেকে মুক্তি পাওয়ার অনেক পরও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য ওষুধ ব্যবহার করছেন। বিশ্বে ডায়াবেটিসের হিসেবে ভারতে প্রতি ছয় জন মানুষের মধ্যে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।

মুম্বাইভিত্তিক ডায়াবেটোলজিস্ট ড. রাহুল বকশি বিবিসিকে বলেন, “দুশ্চিন্তার বিষয়টি হচ্ছে, মহামারী পার হওয়ার পর ভারতে ডায়াবেটিসের একটি সুনামি দেখা দিতে পারে।”

তিনি জানান, তার কাছে যারা এখন চিকিৎসা নিতে আসছেন, তাদের ৮ থেকে ১০ শতাংশের আগে ডায়াবেটিসের কোনও ইতিহাস ছিল না। করোনায় আক্রান্ত হয়ে সেরে ওঠার পর এখন তাদের মাসের পর মাস ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য ওষুধ খেতে হচ্ছে। কারো কারো ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। অন্যরা করোনা থেকে সেরে ওঠার এক বছর পরেও ওষুধ খেয়ে শুগার নিয়ন্ত্রণে রাখছেন।

চিকিৎসায় ব্যবহৃত স্টেরয়েডই এই কোভিড পরবর্তী ডায়াবেটিসের মূল কারণ, নাকি এক্ষেত্রে কোভিডেরও সরাসরি কোনো ভূমিকা আছে, তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে চিকিৎসকদের মধ্যে আলোচনা চলছে।

সম্প্রতি একটি গবেষণাপত্রে এ বিষয়ে একটি ইংগিত মিলেছে। মিউকরমাইকোসিস বা প্রাণঘাতি ‘কালো ছত্রাক’ রোগ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ভারতীয় চিকিৎসকরা এই যোগসূত্র খুঁজে পান।

প্রসঙ্গত, অগ্নাশয় যখন পর্যাপ্ত পরিমাণ ইনসুলিন উৎপাদন করতে পারে না অথবা শরীরে উৎপন্ন ইনসুলিন ব্যবহারে অক্ষম হয় দেহ, তখনই ডায়াবেটিস দেখা দেয়। এর ফলে শরীরে গ্লুকোজের ঘনত্ব বাড়তে থাকে। গ্লুকোজও এক ধরনের চিনি। রক্তে এর আধিক্য হওয়ার ফলে স্বাস্থ্যগত মারাত্মক সব ঝুঁকি দেখা দেয়। এর মধ্যে আক্রান্ত হতে পারে কিডনি, চোখ এবং হার্ট। এ ছাড়া শরীর মোটা হয়ে যেতে থাকে। রক্তের চাপ বাড়তে থাকে। হার্ট এবং ফুসফুসের নানা রোগ দেখা দেয়।

করোনায় যেসব মানুষ মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হন তাদের মধ্যে এই ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি খুব বেশি থেকে যায়। চিকিৎসকরা আশঙ্কা করছেন, করোনা ভাইরাস সংক্রমণ থেকে যে বিপুল পরিমাণ রোগী সুস্থ হয়েছেন, তাদের সামনে ঝুঁকি আছে। তাদেরকে পরীক্ষা করলে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত দেখা যাবে অনেককে।

বিবিসির ওই রিপোর্টে একজন বিপুল শাহের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। তিনি মুম্বইয়ের একটি হাসপাতালে সিসিইউতে কাটিয়েছেন ১১ দিন। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আগে কোনোদিনই তার ডায়াবেটিস ছিল না। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর তাকে স্টেরয়েড দিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

করোনা থেকে প্রায় এক বছর আগে সুস্থ হয়েছেন ৪৭ বছর বয়সী বিপুল শাহ। তবে রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে তাকে এখনও ওষুধ খেতে হয়। বিপুল শাহ বলেন, আমার মতো বহু মানুষকে জানি। তারা করোনা ভাইরাস সংক্রমণ থেকে সুস্থ হওয়ার পর ডায়াবেটিসের চিকিৎসা নিচ্ছেন।

ভারতে ৪৫ হাজারের বেশি মানুষ এই ছত্রাকে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই করোনা থেকে সেরে ওঠার ১২ থেকে ১৮ দিনের মধ্যে সংক্রমণের শিকার হন।

গবেষণায় দেখা গেছে, ১২৭ জন রোগীর মধ্যে ১৩ জনের, অর্থাৎ ১০ শতাংশের দেহে নতুন করে ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে, যাদের আগে এ রোগ ছিল না। এই রোগীদের বয়সের গড় ৩৬ বছর। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই ১৩ জনের মধ্যে ৭ জনকে কোভিড চিকিৎসার সময় কোনো ধরনের স্টেরয়েড বা বাড়তি অক্সিজেন দিতে হয়নি।

অথচ এসব রোগীর রক্তে এখন উচ্চ পরিমাণে শুগার পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে গবেষক দলের সদস্য ড. অক্ষয় নায়ার বলেন, “এটা আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। মনে হচ্ছে, সামনের বছরগুলোতে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা হয়ত লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে পারে।”

দিল্লি ও চেন্নাইয়ের দুটি হাসপাতালে ৫৫৫ জন রোগীর ওপর পরিচালিত আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, কোভিড আক্রান্ত হওয়ার পর যারা ডায়াবেটিসের চিকিৎসা নিয়েছিলেন, তাদের ব্লাড শুগারের মাত্রা, যাদের ডায়াবেটিসের আগের ইতিহাস রয়েছে, তাদের চেয়ে বেশি।

গবেষণাপত্রের সহ-লেখক ডায়াবেটোলজিস্ট ডা. অনূপ মিশ্র বলেন, কোভিড এবং ডায়াবেটিসের মধ্যে যে যোগসূত্রের প্রমাণ এখন আসছে, তা যথেষ্টই জটিল। কোভিড থেকে সেরে ওঠা নতুন যাদের মধ্যে ডায়াবেটিস ধরা পড়ছে, তাদের ক্ষেত্রে মূলত হিমোগ্লোবিনের এওয়ানসি’র মাত্রা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পরীক্ষায় রক্তে চিনির মাত্রার তিন মাসের গড় একটি ধারণা পাওয়া যায়। 

এখন, এটা হতে পারে যে, এসব রোগীর আগেই ডায়াবেটিস ছিল, কিন্তু পরীক্ষা না করায় তা ধরা পড়েনি। আবার এমনও হতে পারে যে তাদের কোভিড চিকিৎসার সময় স্টেরয়েড দেওয়ার পর রক্তে চিনির মাত্রা বেড়ে গেছে এবং এখন তা স্বাভাবিক মাত্রায় নামছে না। 

করোনা থেকে সেরে ওঠার পর হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে যাওয়া অনেকের রক্তে চিনির মাত্রা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। কিন্তু কারও কারও ক্ষেত্রে তা ঘটছে না, তাদের এখন ডায়াবেটিসের চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।

অনূপ মিশ্র বলেন, “আমাদের ধারণা হল, এই রোগীরা মুটিয়ে যাওয়া বা পারিবারিক ডায়াবেটিসের ইতিহাসের কারণে আগে থেকেই ডায়াবেটিসের ঝুঁকির মধ্যে ছিল।”

আর সংখ্যায় খুব কম হলেও কিছু রোগীর ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস মারাত্মক আকারে দেখা দিচ্ছে। তাদের ক্ষেত্রে কোভিডে অগ্ন্যাশয়ের ক্ষতি হওয়ায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে ডা. মিশ্রর ধারণা।

ইমপেরিয়াল কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক গাই রুটারের মতে, করোনাভাইরাস দেহের যেসব অঙ্গকে আক্রমণ করে, তার একটি হল অগ্ন্যাশয়। যাদের ক্ষেত্রে অগ্ন্যাশয় আক্রান্ত হয়েছে, তাদের শরীরে ইনসুলিন তৈরি হওয়াও বিঘ্নিত হতে পারে। ফলে তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে।

তবে করোনা থেকে সেরে ওঠা এ ধরনের রোগীদের ডায়াবেটিস স্থায়ী হয়ে যাবে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয় গবেষকদের কাছে।

তবে মহামারী কেটে গেলেও ভারতকে একটি বড় সংখ্যক ডায়াবেটিস রোগীর ভার সামলাতে হবে বলে মনে করছেন চিকিৎসকদের অনেকেই।

ভাইরাসের প্রকোপ আর লকডাউনের কারণে ভারতে অনেকেই দীর্ঘদিন বাসা থেকে কাজ করেছেন। অনলাইনে অর্ডার করে বাইরের খাবার খেয়েছেন। তাদের শরীরিক পরিশ্রমও সেভাবে হয়নি। অনেকে আবার উদ্বেগ বা হতাশায় ভুগেছেন নানা কারণে।

ডা. মিশ্র বলেন, “এ ধরনের ব্যক্তিদের অনেকেই হয়ত সামনে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারেন। এটা আমাকে সত্যিই উদ্বেগের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।”

করোনার সঙ্গে ডায়াবেটিসের সম্পর্ক নিয়ে বিশ্বজুড়ে চিকিৎসকরা এখন জোর আলোচনা করছেন। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আগে যেসব রোগীর ডায়াবেটিস ছিল না, করোনায় তাদের দেহে ডায়াবেটিস হতে পারে কিনা— তা নিয়েই মূল আলোচনা ও গবেষণা তাদের। তারা বলছেন, এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে করোনা চিকিৎসায় ব্যবহার করা স্টেরয়েডের কারণে। আবার ভাইরাস নিজেও অগ্নাশয়ের কোষকে আক্রান্ত করতে পারে। তবে ভারতের চিকিৎসদের এক গবেষণা পিয়ার রিভিউ হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, যেসব মানুষ মিউকরমাইকোসিস থেকে সুস্থ হয়েছেন অথবা ভয়াবহ ব্লাক ফাঙ্গাস থেকে সুস্থ হয়েছেন, দৃশ্যত তার সঙ্গে এর যোগসূত্র আছে। এ পর্যন্ত ভারতে কমপক্ষে ৪৫ হাজার ব্লাক ফাঙ্গাস সংক্রমণের রিপোর্ট করা হয়েছে। এই ফাঙ্গাস নাক, চোখ, ব্রেনের কিছু অংশ আক্রান্ত করে, ক্ষতি করে। করোনা ভাইরাস থেকে সুস্থ হওয়ার ১২-১৮ দিন পরে সাধারণত এই সংক্রমণ দেখা দেয়।

সূত্র: বিবিসি।

Link copied!