অভিনব সব কায়দা জানে চনপাড়ার প্রতারকচক্র!

আহম্মেদ মুন্নী

জুলাই ৩০, ২০২৩, ০৬:৫৪ পিএম

অভিনব সব কায়দা জানে চনপাড়ার প্রতারকচক্র!

নামে যেমন বাহারি, তেমনই কৌশলেও চনপাড়ার এই প্রতারকরা দুর্ধর্ষ।

পত্রিকার পাতা খুললেই প্রতিদিন চোখে পড়ে নানা প্রতারক চক্রের ফাঁদে পড়ে সাধারণ মানুষদের সর্বস্বান্ত হওয়ার খবর। এসব প্রতারক চক্রের ফাঁদ, কৌশল ও প্রতারণার ধরন বুঝে কারও নাম হয় অজ্ঞান পার্টি, কেউ-বা মলম পার্টি। এই চক্রগুলো এখন পুরনো। বিশেষ করে চনপাড়ার অপরাধীদের কাছে ওসব চক্রের দিন শেষ! এখন সময় খড় পার্টি,  ধাক্কা পার্টি কিংবা চির পার্টির। নামে যেমন বাহারি, তেমনই কৌশলেও এই অপরাধীরা দুর্ধর্ষ। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে এসব চক্রের কেউ গ্রেপ্তার হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন মূল খুঁজতে যায়, অপরাধের সূত্র তাদের নিয়ে যায় এই চনপাড়ায়!

এই চনপাড়া ঢাকার একেবারে অদূরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নে অবস্থিত ঘিঞ্জি এক বসতি। ঢাকার কোলে থেকেও যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্গম চনপাড়া নামের এই জনবসতিতে। মূলতঃ মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন কেন্দ্র হিসেবে ১৯৭৪ সালে যাত্রা করলেও এখন এটি অপরাধীদের আশ্রয়কেন্দ্র! এটিকে লোকজন পুনর্বাসন কেন্দ্র নয়, ডাকে বস্তি নামে। এখানে দেড় থেকে দুই লাখ মানুষের বাস যাদের বেশিরভাগই বহিরাগত। এরা জীবিকার জন্য গড়ে তুলেছে একেকটা অপরাধী চক্র। খুন-খারাবি থেকে প্রতারণা, সবই করে তারা। প্রতারণার হেন উপায় নেই যে এসব গ্রুপের সদস্যরা জানে না।

চির পার্টির সদস্য হয় তিন থেকে পাঁচ জন। কোন অস্ত্র বা হাতিয়ার নয়, শুধুমাত্র কথার প্যাঁচ আর শারিরীকি কসরত করেই শিকারকে ফাঁদে ফেলে দিতে পারে তারা। এরা কাজ করে বিভিন্ন বড় বড় মার্কেটের আশপাশে কিংবা ফুটপাতের দোকানের কাছে।

আরও পড়ুন: ‘খুন-খারাবি, গুলি, পুলিশ কোনো কিছুই আর মাইন্ড করি না’

চক্রের সদস্যরা ওঁৎ পেতে থাকে কোন ক্রেতা কী ধরনের জিনিসপত্র কিনছে, কত টাকার নোট দিচ্ছে, কয়টা জিনিস কিনছে— এসবের দিকে। এরপর ক্রেতা তার ক্রয়কৃত পণ্যের মূল্য পরিশোধ করে চলে গেলে তার পিছু নেয় এই চক্র। এরপর ক্রেতাকে বলতে থাকে, আপনার নোটটটি জাল টাকা, কখনও বা বলে টাকা না দিয়ে চলে এসেছেন! বা দাম আরও বেশি ছিল, বাকি টাকা দেন— এরকম নানা কথা। এরকম নানা কথা বলে বাগবিতণ্ডা তৈরি করলে তখনই চক্রের বাকি সদস্যরা ছুটে আসে সাক্ষী দিতে। এরপর ক্রেতাকে সর্বস্বান্ত করার পথ বের করে ওই চক্র।

ধাক্কা পার্টির কাজও অভিনব। টার্গেট ব্যক্তির সাথে ধাক্কা লাগিয়ে শুরু করে বিতণ্ডা। চক্রের অন্যরা এসে যোগ দেয় তাতে। এরপর সর্বস্ব লুটে নেয় তার।

প্রতারক চক্রের একটি দল আছে যারা বাসাবাড়িতে গিয়ে নতুন ভাড়াটের ছন্দবেশে চুরি এবং লুটপাট করে। ডেমরায় এরকম একটি ঘটনা ঘটে। ওই এলাকায় এক ছয়তলা বাড়ির মালিকের দুটি ফ্লাট দেখে তারা ভাড়াটিয়া সেজে প্রতারণার ছক কষে সম্প্রতি। চক্রের দুই সদস্য একদিন রেকি করতে যায় ওই বাসায়। একদিন তারা এডভ্যান্স করার কথা বলে বাড়িওয়ালার পরিবারে কে কে আছে, কী কী করে, ছেলে মেয়েদের সব তথ্য নিয়ে নেয়। এর ঠিক একদিনের মাথায় এডভান্স দিতে গিয়ে টাকাগুলো ভেতরে রেখে দিতে বলে। বাড়ির মালিক টাকা ভেতরের রুমে আলমারিতে রাখতে গেলে চক্রের এক সদস্য বাড়ির গৃহকর্তীর মুখে রুমাল চেপে অজ্ঞান করে ফেলে। ভেতর থেকে মালিক আসার পর কিছু বুঝে উঠার আগে তাকেও অজ্ঞান করে ফেলে তারা। এরপর আলমারিতে থাকা টাকা-পয়সা ও মূল্যবান জিনিস নিয়ে সটকে পড়ে প্রতারকরা।

আরও পড়ুন: চনপাড়া: যেখানে সন্ধ্যা নামে অপরাধীদের মুখে হাসি ফুটিয়ে!

খড় পার্টির প্রতারণার কৌশল আরও অদ্ভূত। তারা মূলত নারীদের টার্গেট করে। রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর এবং আশপাশের এলাকায় এরা সক্রিয়। এই চক্রের সবার আস্তানাও চনপাড়ায়। সাধারণত পথঘাটে অসহায় সেজে কোনো নারীর কাছে সহায়তা চেয়ে আলাপ শুরু করে খড় পার্টির সদস্যরা। নিখুঁত অভিনয় আর কথার মায়াজালে ফেলে ওই নারীকে ফাঁদে ফেলে তাঁরা। পরে নারীর কাছে থাকা মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে প্রতারকরা সটকে পড়ে।

এসব চক্রের পাল্লায় পড়ে গত কয়েক বছরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাজারও মানুষ। এরকম ৩০-৪০টি চক্র সক্রিয় রয়েছে রাজধানীসহ আশপাশের এলাকাতে। চক্রের সদনস্যরা সবাই চনপাড়ার বাসিন্দা হলেও তারা কাজ চালায় রাজধানীর বাড্ডা, খিলগাও, রামপুরা, মগবাজার, মোহাম্মদপুর, মিরপুর এলাকায়। এই চক্রকে রীতিমত প্রশিক্ষণ দিয়ে মাঠে নামানো হয়।

এ বিষয়ে রুপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম সাইদ বলেন, আমরা এ ধরনের প্রতারক চক্রের সদস্যদের ইতিমধ্যে অভিযান পরিচালনা করে ধরেছি। ভবিষ্যত্বে এই ধরনের অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।

Link copied!