‘খুন-খারাবি, গুলি, পুলিশ কোনো কিছুই আর মাইন্ড করি না’

আহম্মেদ মুন্নী

জুলাই ২৪, ২০২৩, ০৯:০৭ পিএম

‘খুন-খারাবি, গুলি, পুলিশ কোনো কিছুই আর মাইন্ড করি না’

রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় চনপাড়া হয়ে উঠেছে সকল অপরাধের কেন্দ্র। ছবি: দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ

বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশ হত্যাকাণ্ডের পর সারাদেশে আলোড়ন ফেলে। নতুন করে আবারও আলোচনায় আসে চনপাড়া। আলোচিত এই স্থানটি ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের একটি পুনর্বাসন কেন্দ্র। পঙ্গু ও অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা এবং বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনের জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এটি নির্মিত হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। কথা ছিল বিশাল এলাকা জুড়ে বানানো ওই বসতিটি মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরবর্তী প্রজন্মের পদচারণায় ধন্য হয়ে উঠবে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হলে ওই পুনর্বাসন কেন্দ্রটিও যেন হারিয়ে ফেলে তার পথ। তারপর থেকে চনপাড়ায় শুরু হয় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।

গত কয়েক দশকে এটি পরিণত হয়েছে অপরাধের আখড়ায়। স্থানীয়রা বলেন, এমন কোনো অপরাধ নেই যা চনপাড়ায় হয় না! যে কারণে প্রায়শঃ এই চনপাড়া থাকে আলোচনার কেন্দ্রে। চনপাড়া নামটি উচ্চারণ করলে সবার মানসপটে এখন ভেসে উঠে ‘মাদকরাজ্য’ হিসেবে পরিচিত এক বিভীষিকার জনপদের নাম। দুর্গম চনপাড়ার তিন দিক দিয়ে নদী, একদিকে খাল। যে কারণে মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন এই এলাকা। এখানে যেতে সড়কপথে ঢোকার একমাত্র উপায় হল ডেমরা হয়ে বালু নদের ওপর নির্মিত সেতুটি।

মাসখানেক আগেও চনপাড়া আলোচনায় আসে। ওই সময় র‌্যাবের ‘বন্দুক যুদ্ধে’ শাহীন মিয়া ওরফে সিটি শাহীন নামের এক মাদক নিয়ন্ত্রক নিহত হন। তবে শাহীনের স্ত্রী ইতি আক্তারের দাবি, কোনো বন্দুকযুদ্ধ নয়, শাহীনকে র‌্যাব তুলে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে। শাহীন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার কর্মী ছিলেন।

গত বছরের নভেম্বরের শুরুর দিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারদিন নূর ওরফে পরশের মৃত্যুর ঘটনায় ফের আলোচনায় আসে চনপাড়া। ওই ঘটনায় একে একে বেরিয়ে আসে চনপাড়ার মাদকসাম্রাজের নানা কথা। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মাদক সাম্রাজ্যের ডন হিসেবে পরিচিত বজলুর কথাও প্রকাশ্যে আসে। বজলুর রহমান উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী সদস্য ছিলেন। ফারদিনের মৃত্যুর ঘটনার পরপরই র‌্যাবের হাতে আটক হন বজলু। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। র‍্যাব তখন বজলুর বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও জাল টাকা রাখার অভিযোগে তিনটি মামলা করে। ওই তিন মামলার বাইরেও বজলুর বিরুদ্ধে হত্যা, মাদকসহ অন্তত ২৩টি মামলা ছিল বলে তখন জানিয়েছিল র‍্যাব।

বজলুর মৃত্যুর ঘটনায় দেশের গণমাধ্যমের দৃষ্টি ছিলো চনপাড়ার দিকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের ফলে চনপাড়ার মাদক কারবারি ও অপরাধীরা তখন কিছুদিনের জন্য এলাকা ছাড়া হয়। এ বছরের জুলাই মাসের ১২ তারিখ উপনির্বাচনকে ঘিরে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক ছিল। এরপর ধীরে ধীরে চনপাড়ায় ফিরতে শুরু করে অপরাধীরা। শুরু হয় আগের সেই মাদক ব্যবসা। তবে এবার শুধু বদলে গেছে দলনেতারা। আগে যারা এখানকার অপরাধ জগত ও মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতো, এখন তারা নেই। এখন তা নিয়ন্ত্রণ করছে নতুন তিনজন। আগে শুধু এক বজলু মেম্বারই নিয়ন্ত্রণ করতেন গোটা চনপাড়া।

প্রায় দুই লাখ জনসংখ্যার এই বসতিরূপী বস্তিটি রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ১২৬ একর জমি নিয়ে চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রটির অবস্থান। বজলুর একনিষ্ঠ শমসের আলী, শাহাবুদ্দিন ও জয়নাল এককালে বজলুর হয়ে নিয়ন্ত্রণ করতেন চনপাড়া। বজলু মারা যাওয়ার পর তারা তিনজনই এখন এককভাবে পুরো ক্ষমতা ও বস্তি নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া। এ নিয়ে গত দুই সপ্তাহে সেখানে সংঘর্ষ হয়েছে দফায় দফায়। এসব সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ চার জনসহ অন্তত ২৫ জন আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের এই প্রতিবেদক সরেজমিনে টানা কয়েকদিন খোঁজখবর করেন চনপাড়ায়। সাহাবুদ্দিন আর মহিলা লীগ নেত্রী রীতার নেতৃত্বে নতুন গ্রুপের উত্থান ঘটেছে চনপাড়ায়। এ অবস্থায় নতুন গ্রুপ তৈরি করে আরেকটি দল গড়েছেন ইয়াছমীন ও বজলুর ডানহাত হিসেবে পরচিতি জয়নাল। এছাড়াও স্থানীয় উঠতি বয়সের কিছু তরুণ-যুবক যেমন দাঁত ভাঙা রাব্বি ও শাওন গড়ে তুলছে বাহিনী। এদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শমসের আলী।

গত ২৩ জুন আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে করে দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে দুজন গুলিবিদ্ধসহ ১০ জন আহত হয়। এ ঘটনায় পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৪২টি রামদা উদ্ধার করে। গুলিবিদ্ধরা হলেন চনপাড়ার ৬নং ওয়ার্ডের বাদল মিয়ার ছেলে বাবলু (২৫) ও আজাহারের ছেলে মাসুদ (২১)।

এর আগে এ বছরের এপ্রিলে একই কারণে সংঘর্ষ বাঁধলে চারজন গুলিবিদ্ধ হয়। এরা হলেন মো. সানি (১৭), পারভেজ (২১), মো. রুমান (১৮) এবং ইমন (২২)। 

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চনপাড়ায় সহসাই অভিযানে যায় না। চনপাড়ার মাদক নিয়ন্ত্রকদের সাথে বোঝাপড়া না হলে সেখানে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে তাদের জন্য। এমনকি হামলার শিকারও হতে হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। অভিযানে গেলে মূল রাস্তার প্রবেশ মুখে অন্তত সাত থেকে আট হাজার নারী-শিশু মাত্র দুই মিনিটের মধ্যে জড়ো হয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। ফলে অপরাধীদের ধরা খুব কঠিন হয়ে পড়ে।

বাহিনীপ্রধান জয়নাল মিয়ার সাথে কথা হয় দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের এই প্রতিনিধির। তিনি বলেন, ‘বজলু ভাই মারা যাওয়ার পর নির্বাচনে আমিও দাঁড়াইছিলাম। আমার লোকগুলোরে ওরা (শমসেরের লোকেরা) পাখির মত গুলি করে দিছে। এখন বিষয়টা নির্বাচনের না। এখন বিষয়টা সম্মানের, বিষয়টা ক্ষমতার। আমার ওয়ার্ডের একটা পোলা, ওর নাম হৃদয়। গার্মেন্টসে কাজ করে। স্টাফ কোয়ার্টারে (পাশের এলাকায়) সে রাত দশটার ডিউটি শেষ কইরা এলাকায় ডুকছে একটা বিরানীর দোকানে। খাওয়া শেষ কইরা বের হতে না হতেই আমার নাম ধইরা আমাকে খুঁইজা না পাইয়া ওরে গুলি কইরা দেয় শমসেরের সাথে থাকা শাওন, রাব্বি ও ফাইজুল। রোজ রোজ খুন খারাবি, গুলি, হত্যা, পুলিশ, গ্রেফতার দেখতে দেখতে এসবে আমরা আর মাইন্ড করি না। এর বেশি কী বলমু? তবে আমার সাধারণ পোলাপানরে এভাবে গুলি করলে, মারধর করলে আমরা কি মুখ বুজে বসে থাকবো?’ 

৩নং ওয়ার্ডের কবরস্থানের পেছনে তিনতলা বাড়িতে শমসের আলীর বাসা। এ বিষয়ে কথা বলতে তার বাড়িতে গিয়ে জানা গেল, তিনি কয়েকদিনের টানা সংঘর্ষের পর এখন পলাতক আছেন।

Link copied!