পুলিশি সেবা পেতে প্রতি পাঁচজনে চার জনই হন উল্টো হয়রানির শিকার: জরিপ

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

অক্টোবর ২৭, ২০২২, ০৪:৪২ এএম

পুলিশি সেবা পেতে প্রতি পাঁচজনে চার জনই হন উল্টো হয়রানির শিকার: জরিপ

জনগণের সেবা করাই পুলিশ বাহিনীর প্রতিটি সদস্যের সাংবিধানিক এবং পবিত্র দায়িত্ব। সেখানে কোনো ধরনের অনুরাগ বা বিরাগের সুযোগ নেই। দায়িত্বে অবহেলা বা নৈতিক পদস্খলন অমার্জনীয় অপরাধ। কিন্তু পুলিশি সেবা পেতে গিয়ে প্রায়শঃ হয়রানির অভিযোগ মেলে। এই সেবা পাওয়া সহজ কাজও নয় বলেও বিভিন্ন সময় অভিযোগ করেন নাগরিকেরা। তারা সেবা পাওয়ার বিপরীতে উল্টো উল্টো হয়রানির শিকার হন। এতে ভুক্তভোগী হয়েও ৮৩ শতাংশ মানুষ পুলিশি সেবা নিতে আগ্রহী হন না। ভুক্তভোগীদের মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ ইতিবাচক সাড়া পেয়েছেন পুলিশের কাছ থেকে। দেখা গেছে, প্রতি পাঁচজনে চারজনই সন্তুষ্ট নন পুলিশি সেবা নিয়ে।

‘বাংলাদেশের নির্বাচিত শহরাঞ্চলে অপরাধের শিকার জরিপ’ শীর্ষক এক জরিপ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। জরিপটি চলতি মাসে পুলিশের প্রধান কার্যালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে জরিপটি প্রকাশ করা হয়নি।

মামলা সমাধানে পুলিশের অনীহা

মাওলানা ভাষানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিদ্যা ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. ওমর ফারুকের নেতৃত্বে গবেষকদের একটি দল "বাংলাদেশের নির্বাচিত শহরাঞ্চলে অপরাধের শিকার জরিপ" শীর্ষক জরিপটি পরিচালনা করে। চলতি মাসের শুরুতে পুলিশ সদর দফতরে গবেষণার ফলাফল জমা দেওয়া হয়। দেশে এই জরিপ প্রথমবারের মত করা হয়। দেশের ১২টি সিটি কর্পোরেশন, বগুড়া ও টাঙ্গাইল পৌরসভার ৭০টি ওয়ার্ডের ১,২৪৬ জন মানুষের উপরে ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের মে মাসে ওই জরিপটি পরিচালিত হয়

গবেষণার তথ্যমতে, মাত্র ১৬ শতাংশ অভিযোগকারী পুলিশের কাছে যথাযথ সহায়তা পেয়েছেন বলে জানান। আর ৫৫ শতাংশ অভিযোগকারী উল্টো হয়রানির সম্মুখীন হয়েছেন। আর মোটামুটি সেবা পেয়েছেন বলে জানান ২৬ শতাংশ অভিযোগকারী। বাকি ৩ শতাংশ কোন মন্তব্য করেননি। অসন্তুষ্টির কারণ হিসেবে তাঁরা বলেছেন, (৪৭ শতাংশ অভিযোগকারীদের মতে) পুলিশ মামলা সমাধানের জন্য পর্যাপ্ত কাজ করে না এবং ১৩ শতাংশ মনে করেন পুলিশ মোটেও মামলাটি সমাধান করতে আগ্রহী নয়।

পুলিশের কাছে অভিযোগই করছে না ৭৩ শতাংশ মানুষ

জরিপে দেখা যায়, ২০১৮ সালে সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধের ৭৩ শতাংশ ভুক্তভোগী পুলিশকে রিপোর্ট করেনি। এর পেছনের কারণগুলির মধ্যে রয়েছে: মামলা দায়েরের অসুবিধা; পুলিশকে বারবার ফোন করে সাড়া না পাওয়া এবং আদালতে হাজির হওয়ার ঝামেলা; পুলিশ এবং আইনি সেবার জন্য খরচ এবং সহযোগিতা করতে পুলিশের অনীহা।

ছোটখাট অপরাধ বা ঝামেলার সম্মুখী হলে অনেকেই নিকটবর্তী থানায় যোগাযোগ করেন না। পুলিশের সাহায্য না চাওয়ার কারণ জানতে চাইলে প্রায় ৮৩ শতাংশ মনে করেন, যে কোন অপরাধের স্বীকার হয়ে পুলিশের কাছে গেলে নিজেকেই জবাবদিহি করতে হয়। আর ৮৫ শতাংশ জানান, পুলিশ পক্ষপাতমূলক আচরণ করে থাকে। এ ছাড়া পুলিশের কাছে না যাওয়ার কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ভুক্তভোগীদের সাথে ঘটিত অপরাধগুলিকে নগণ্য এবং রিপোর্ট করার উপযুক্ত নয় বলে জানানো হয়। অপরাধীদের প্রতি পুলিশের পক্ষপাতিত্ব এবং আইন ভঙ্গকারীদের ধরতে অদক্ষতা এবং ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থার অভাব।

জরিপের প্রধান তদন্তকারী অধ্যাপক মো. ওমর ফারুক বলেন, এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, পুলিশ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থার অভাব রয়েছে। পুলিশের আধুনিকায়ন করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি অভিযোগকারীদের আস্থা ফেরাতেও কাজ করতে হবে বাংলাদেশ পুলিশকে।

খরচ বাড়ছে মামলার

পুলিশের কাছে অভিযোগের পর করা মামলায় গড়ে ৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকা করে খরচ হয়েছে। মোট ১২৪৬ জন উত্তরদাতাদের মধ্যে, ১১০০ জন অপরাধের খরচ সম্পর্কে একটি মোটামুটি হিসাব দিয়েছেন। একটি অপরাধের মামলা পরিচালনার গড় খরচ ছিল ৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকার বেশি। ফলে ওই ১১০০ জন ভুক্তভোগী তাদের মামলার জন্য মোট খরচ করেছেন প্রায় ৩৭ কোটি টাকা।

খরচের মধ্যে সম্পত্তির ক্ষতি, চিকিৎসা খরচ, আইনি পরিষেবার ফি, আয়ের ক্ষতি, উত্পাদনশীলতা হ্রাস, স্থানান্তর খরচসহ অন্যান্য ঘুষের কথাও উল্লেখ করেন তাঁরা।

সেবা নিতে ঘুষ দিতে বাধ্য হচ্ছে

উল্লেখ্য ‘সেবা খাতে দুর্নীতি : জাতীয় খানা জরিপ ২০২১’ শীর্ষক টিআইবির এই জরিপে বলা হয় যে কেবল থানা পুলিশের হিসাব করলে ঘুষের পরিমাণ ৮ হাজার ৭০৯ টাকা। অর্থাৎ থানায় সেবা পেতে প্রতিটি পরিবারকে গড়ে ৮ হাজার ৭০৯ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। আর সবচেয়ে বেশি মানুষকে ঘুষ দিতে হয়েছে ট্রাফিক পুলিশকে। অর্থাৎ টাকার পরিমাণে কম হলেও ঘুষ গ্রহণের ঘটনা ট্রাফিক পুলিশে বেশি। সবমিলিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা থেকে সেবা নিতে গিয়ে যেসব খানা (পরিবার) ঘুষ দিয়েছে বা দিতে বাধ্য হয়েছে তাদের গড়ে ৬ হাজার ৬৯৮ টাকা দিতে হয়েছে।

জরিপ প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশও করা হয়েছে। তবে পুলিশ বিভাগের পক্ষ থেকে এখনও কেউ এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে চায়নি। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করার পরই তারা এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দেবেন বলে জানান।

পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের অতিরিক্ত এসপি (গবেষণা ও উদ্ভাবন) ফরিদা পারভিন দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ওমর ফারুক স্যারের সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু জরিপ প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিভাবে সবাইকে জানানো হবে। তখন এটা নিয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।

পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের অতিরিক্ত ডিআইজি (গবেষণা ও উদ্ভাবন ) মারুফ হোসেন সরদার বলেন,  গবেষণা  বিষয়টি এখন পর্যন্ত আমাদের নিজস্ব। প্রকাশের আনুষ্ঠানিকতা হয়নি। তাই এসব নিয়ে মিডিয়াতে কথা বলার সময় হয়নি।

সাবেক আইজিপি ও সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ গণমাধ্যমে বলেছেন, একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো স্থিতিশীল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। সংগঠিত পুলিশ বাহিনী সৃষ্টি হয়েছিল ১৮৬১ সালে। এই দেড়শ বছরীয় আইনে কোনো সংস্কার বা পরিবর্তন হয়নি। আইনে কোথাও সেবার কথা নেই, জনগণের কথা নেই, মানবাধিকারের কথা নেই। স্বাধীন দেশের জন্য যুগোপযোগী আইন দরকার।

Link copied!