শ্রমিকদের বেতন নির্ধারনে উদাসীন সরকার

নিজস্ব প্রতিবেদক

মে ১, ২০২১, ০৯:২৫ পিএম

শ্রমিকদের বেতন নির্ধারনে উদাসীন সরকার

দেশের প্রচলিত শ্রম আইনে পাঁচ বছর পর পর শিল্প খাতে কর্মরত শ্রমিকের মজুরি পর্যালোচনার কথা বলা আছে। কিন্তু নির্ধারিত সময় পেরোলেও মজুরি পর্যালোচনার উদ্যোগ নেই প্রায় ২০ খাতে । যার ফলে শ্রমিকদের কোন ধরনের আইনী পদক্ষেপ ও দাবি রাখতে পারছে না। নিম্নতম মজুরি বোর্ড কর্তৃক দেশে প্রায় ৪২টি খাতের শ্রমিক ও কর্মচারীদের ৪১টি খাতে ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মাসিক ৫২১ ও ৭৯২ টাকা বেতনেরও চাকরি রয়েছে। 

১৯৮৩ সালের মজুরি দিয়ে চলছে শ্রম খাত

শুনতে অবাক লাগলেও টাইপ ফাউন্ড্রি খাতে বেতন ৫২১ টাকা, যা সর্বশেষ নির্ধারণ করা হয় ১৯৮৩ সালে। প্রায় ৩৮ বছরেও সংশোধন হয়নি তাদের মজুরী খাত। এদিকে পেট্রল পাম্পের শ্রমিকদের বেতনও সরকারি হিসেবে ৭৯২ টাকা। এই মাসিক বেতন নির্ধারিত হয় ১৯৮৭ সালে।

পর্যালোচনা না হওয়া আরও খাতগুলো হচ্ছে আয়ুর্বেদিক কারখানা, আয়রন ফাউন্ড্রি অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, টি-গার্ডেন, সড়ক পরিবহন, ওয়েল মিলস ও ভেজিটেবল প্রোডাক্টস, প্রিন্টিং প্রেস, রি-রোলিং মিলস, সল্ট ক্রাশিং, রাইস মিল, প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ, নির্মাণ ও কাঠ, কোল্ডস্টোরেজ, শিল্প প্রতিষ্ঠানে অদক্ষ শ্রমিক।

শ্রমিকদের কত আয় করার দরকার

দারিদ্র্যসীমার ওপরের স্তরে অবস্থানকারী প্রায় পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারে ‘জাতীয় খানা আয়-ব্যয় জরিপ’ অনুযায়ী খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবা কেনার ব্যয় মাসে ৯ হাজার ২৮০ টাকা। পরিবারের প্রধান উপার্জনকারীকে এ ক্ষেত্রে আয় করতে হবে ৬ হাজার ৪৪৫ টাকা।

সেন্টার ফল পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) মতে কাঙ্খিত পুষ্টিহার অনুযায়ী খাবার গ্রহণ ও জীবনধারণের জন্য একজন শ্রমিকের প্রতিমাসে ন্যূনতম মজুরি প্রয়োজন ১৭ হাজার ৮৩৭ টাকা। প্রকৃত খরচ অনুযায়ী বিবাহিত একজন শ্রমিকের মাসে আয় করতে হবে ১০ হাজার ৩৫২ টাকা।

বর্তমানে শ্রমিকদের মধ্যে অধিকাংশের বেতনই ১০ হাজারের কম। দেশের মোট শ্রমিকের সংখ্যা কত তার সঠিক পরিসংখ্যান কোনো সংগঠন বা সংস্থার কাছে নেই। তবে দেশে গার্মেন্টস খাতে মোট শ্রমিকের পরিমাণ প্রায় ৪০ লাখ। এ ছাড়া অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ খাতে ২০ লাখ, দর্জি শিল্পে ১০ লাখ, নির্মাণ খাতে ৩৫ লাখ ও ট্যানারি খাতে ২৫ হাজার শ্রমিক রয়েছে।

শ্রমিকদের ব্যয়ের সাথে আয়ের সামঞ্জস্য নেই

আইএলওর গ্লোবাল ওয়েজ রিপোর্ট-২০২০-২১-এ বলা হয়েছে, ২০১০-১৯ সালে বাংলাদেশে শ্রমিকের বার্ষিক উৎপাদনশীলতা বাড়লেও প্রকৃত ন্যূনতম মজুরি উল্টো কমেছে। এই সময়ে দেশে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা ৫ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও প্রকৃত ন্যূনতম মজুরি ৫ দশমিক ৯ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। বলা হয়েছে, এই সময়ে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রকৃত ন্যূনতম মজুরি হ্রাসের হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায়।

আইএলওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসে মজুরি বৃদ্ধির হার আরও কমে গেছে। আশঙ্কা, নিকট ভবিষ্যতে মজুরি হ্রাসের চাপ আরও বাড়বে। আর সবচেয়ে চাপের মুখে পড়বেন নারী ও নিম্ন মজুরির শ্রমিকেরা, যাঁদের বসবাস শহরের বস্তিতে।শহরের বস্তিতে যে শ্রমজীবীরা বসবাস করেন, তাঁদের অনেকের আয় প্রাক–কোভিড সময়ের তুলনায় কমলেও ব্যয় বেড়েছে। পিপিআরসি ও বিআইজিডির সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, খাবারের ব্যয় ছাড়া বস্তিবাসীর দৈনন্দিন ব্যয় গত বছরের জুনের তুলনায় এ বছরের মার্চে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ভাড়া বাড়িতে থাকা অধিকাংশ শহুরে দরিদ্রদের জন্য এটি নির্মম বাস্তবতা। সবার সঞ্চয় কমে গেছে আশ্চর্যজনকভাবে। অরক্ষিত ও দরিদ্র নয়, এমন শ্রেণির মানুষের সঞ্চয় কোভিড-পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় নিচে নেমে গেছে। একই সঙ্গে সব শ্রেণিতেই ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, জীবনযাপনের ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শ্রমিকের আয় বাড়ে না। ৫ বছর অন্তর ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের কথা থাকলেও বেশিরভাগ খাতে তা বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে শ্রমিকরা অনেক মৌলিক চাহিদার ছাড় দিয়ে বেঁচে আছেন।

তিনি আরও বলেন, একটি শ্রমিকের পরিবারের সন্তানরা যদি শিক্ষিত না হয়। তা হলে তারাও ভবিষ্যতে শ্রমিকের গন্ডি থেকে বের হতে পারে না। শ্রমিকদের পরিবার শ্রমিকই থাকছে।

তহবিলের সুবিধা পাচ্ছে না শ্রমিকরা

বিদ্যমান শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী, কোনো কোম্পানির মোট মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিকের পাওনা। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ শ্রমিকদের মধ্যে বণ্টন এবং ১০ শতাংশ কারখানা পর্যায়ে শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে ও বাকি ১০ শতাংশ সরকারের শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিলে জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু কেরোনা মহামারীর সময়ে তহবিল থেকে কোন সহায়তা না পেলেও ছাঁটাই বেড়েছে শ্রমিকদের।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেন, শ্রমশক্তির বিশাল অংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক। ফলে কাজের নিশ্চয়তা, কম মজুরি, আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না থাকা, বঞ্চনার পাশাপাশি নারী-পুরুষের মধ্যে ব্যাপক মজুরি বৈষম্য আছে।

এ বিশাল অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে অনেক সময় প্রয়োজন। তবে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এ বিষয়ে উদ্যোগ রয়েছে।

বেতন কম পোশাক খাতেই

দেশের উল্লেখযোগ্য ১০টি শিল্প খাতের মধ্যে পোশাকশ্রমিকের মজুরিই সবচেয়ে কম। সবচেয়ে বেশি মজুরি পায় জাহাজভাঙা শ্রমিকরা। তাদের মাসিক বেতন ১৬ হাজার টাকা। বর্তমানে ট্যানারি শ্রমিকের সর্বনিম্ন মজুরি ১২ হাজার ৮০০ টাকা। নির্মাণশিল্প ও কাঠের কাজ করেন এমন শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ৯ হাজার ৮৮২ টাকা, তেল মিলের শ্রমিকের মজুরি সর্বনিম্ন ৭ হাজার ৪২০ টাকা, সড়ক পরিবহনে ৬ হাজার ৩০০ টাকা, রি-রোলিং মিলে ৬ হাজার ১০০ টাকা, কোল্ড স্টোরেজে ৬ হাজার ৫০ টাকা, ধান ভাঙানোর চাতালে আধা দক্ষ শ্রমিকের মজুরিও এখন ৭ হাজার ১৪০ টাকা, পোশাক শ্রমিকদের সর্বনিম্ন বেতন ৫ হাজার ৩০০ টাকা, গ্লাস অ্যান্ড সিলিকেটস কারখানায় ৫ হাজার ৩০০ টাকা সর্বনিম্ন বেতন নির্ধারিত আছে।

Link copied!