সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ তখন সবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। ‘৭৩’র নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে দেশ চালাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। দেশের প্রথম নির্বাচনের ঠিক এক বছরের মাথায় বাংলাদেশ-ভারতের স্থল সীমানা নির্ধারণ ও আনুষঙ্গিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শেখ মুজিব ও শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে চুক্তি হয়। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে এই চুক্তি স্বাক্ষর হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে সংঘটিত এই চুক্তি বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের মধ্যে প্রগাঢ় মিত্রতা ও শান্তি-সম্প্রীতির প্রতীকী নিদর্শন।
চুক্তির পেছনের ইতিহাস
পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে যে সমস্যা ছিল, তার বেশির ভাগই ছিল অতি পুরনো। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে আদায় করে নেওয়া স্বাধীনতা ও বিভক্তির সময় এই সমস্যার সূত্রপাত হয়েছে। ভারত ও তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জরিপ-আমিনরা প্রথম দিন থেকেই আন্তর্জাতিক সীমানা চিহ্নিত ও অঙ্কিত করতে কাজ করছিলেন। তাদের চেষ্টা ছিল দেশভাগের বছরে স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ যে রেখা টেনে দিয়েছিলেন এবং লিখিত বিবরণ দিয়েছিলেন, তা যথাসাধ্য মেনে চলা।
এই কাজ করতে গিয়ে তারা এমন কিছু ভিন্নতার মুখোমুখি হতে থাকেন, যার পরিণাম আগে থেকে বোঝা যায়নি। এর সূত্র ধরেই ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি এলেন ব্যাগি রোয়েদাদ। এর সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক ও আইনি পরিপ্রেক্ষিতও উঠে এলো। দেশজুড়ে নানা আলোচনা, সমালোচনা হতে থাকল। অবশেষে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু ও পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুন প্রথম সীমান্ত চুক্তি করেন ১৯৫৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। এই চুক্তিতে অন্যান্য বিষয়গুলোর সঙ্গে প্রধানত তিনটি লক্ষ্য অর্জনের কথা ভাবা হয়েছিল:
১. সীমান্তের বিভিন্ন সেক্টরে সীমানা নির্ধারণে যেসব অসঙ্গতি আছে সেসবের নিষ্পত্তি। সেই সঙ্গে দক্ষিণ বেরুবাড়ির ১২ নম্বর ইউনিয়নে ভারতের সঙ্গে যুক্ত থেকে যায়। ইউনিয়নটি স্যার র্যাডক্লিফের অঙ্কিত রেখানুসারে ভারতের ভাগে পড়ে। তবে লিখিত বিবরণ অনুসারে পড়ে পাকিস্তানের অংশে। কোথাও এমন অসঙ্গতি দেখা দিলে লিখিত বিবরণকেই মান্যতা দেওয়া হবে- এমনই কথা ছিল। কিন্তু এই ইউনিয়নের বাসিন্দাদের বেশির ভাগই মুসলিম ছিলেন না। সেই কারণে তারা পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত হতে আপত্তি জানায়। আর পাকিস্তান সরকারও এর কতৃত্ব নিতে পারেনি। এভাবে এক দশকেরও বেশি সময় পার হয়ে গেলেও এই ইস্যুর নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ দক্ষিণ বেরুবাড়ি ভারতের সঙ্গেই যুক্ত থেকে যায়। নেহেরু-নুন চুক্তিতে স্থির হয় ইউনিয়নটিকে মোটামুটি সমানুপাতিক দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলতে হবে। দক্ষিণের অর্ধেক এবং আরও দুটি ছিটমহল পাবে পাকিস্তান। আর উত্তরের অর্ধেক ভারতের অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
২. ১৯৫৮ সালের নেহেরু-নুন চুক্তির লক্ষ্য ছিল, ছিটমহল সমস্যার মীমাংসা। পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় ছিটমহল ছিল ১১৩টি, আর ভারতের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ছিটমহল ছিল ৫৩টি। চুক্তিতে নির্ধারিত হয় যে, এসব ছিটমহল যে দেশের মধ্যে পড়েছে, সেই দেশেরই অঙ্গীভূত হবে। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে যেসব ভারতীয় ছিটমহল আছে, সেগুলো পূর্ব পাকিস্তানের হয়ে যাবে, আর ভারতে যেসব পূর্ব পাকিস্তানের ছিটমহল আছে, সেগুলো পাবে ভারত। ফলে যে বাড়তি জায়গা পেয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান, সে জন্য ভারত কোনো ক্ষতিপূরণ পাবে না।
৩. সীমানা নির্ধারণের পর সেই অনুযায়ী ভূখণ্ড বিনিময় করা হবে। সীমান্ত চিহ্নিতের ফলে যেসব ভুখণ্ড অন্যায্যভাবে কোনো দেশের অধিকারে আছে (অর্থাৎ অপদখলীয় এলাকা) বলে জানা যাবে, সেগুলো ন্যায্যত যে দেশের অধিকারে থাকা উচিত, সেই দেশের কাছে হস্তান্তর করতে হবে।
১৯৫৮ সালের চুক্তির এসব দিক বাস্তবায়ন করা সম্ভব ছিল না। যে দিকগুলোতে ছিটমহলগুলোর পারস্পরিক বিনিময় ও দক্ষিণ বেরুবাড়ি ১২ নম্বর ইউনিয়নের দক্ষিণ অংশ ভারতের পূর্ব পাকিস্তানের কাছে হস্তান্তরের মতো একাধিক বিষয় ছিল। এর কারণ ছিল ভারতীয় নাগরিকদের রুজু করা মামলা। মামলাটিতে দক্ষিণ বেরুবাড়ির গোটা ইউনিয়ন দাবি করা হয়। কারণ এটা ভারতীয় সংবিধান বলবৎ হওয়ার সময় থেকেই ভারতীয় ভূখণ্ডের অংশ এবং কোচবিহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত যেসব ছিটমহল আছে, সেগুলোও ভারতের অংশ। সে কারণেই ইউনিয়নের দক্ষিণ ভাগ ও ছিটমহলগুলোর কোনোটিই কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের কাছে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে না। যথাসময় মামলাটি ভারতের সুপ্রিম কোর্টে গড়ায়। রায় আসে, রিপাবলিক অব ইন্ডিয়া থেকে দক্ষিণ বেরুবাড়ি ১২ নম্বর ইউনিয়নের দক্ষিণ অর্ধেক বাদ দিতে হলে ও পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে থাকা ভারতীয় ছিটমহলগুলো চুক্তির আবশ্যকীয় শর্ত হিসেবে বিনিময় করতে গেলে ভারতের সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সেই অনুযায়ী ১৯৬০ সালে নবমবারের মতো ভারতের সংবিধান সংশোধন করা হয়। তা সত্ত্বেও আবশ্যকীয় বিনিময় কার্যকর হয়নি। ঠিক এ কারণেই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেকার এই তিনটি সমস্যা উত্তরাধিকার সূত্রে দীর্ঘদিন জট বেঁধেছিল।
ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এসব সমস্যার দ্রুত মীমাংসার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেকার স্থল সীমানা নির্ধারণ ও আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ মুজিবের মধ্যে সম্পাদিত এই স্থল সীমানা চুক্তি, ১৯৭৪ দ্রুত ও শান্তিপূর্ণভাবে সীমান্তের মূলত ১৩টি সেক্টরে থাকা অনির্ধারিত এলাকাগুলোতে সীমানা চিহ্নিতের জন্য এবং সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো যেমন ছিটমহল বিনিময় ও অপদখলীয় এলাকা বিনিময়, যথাযথ দ্রুততার সঙ্গে সমাধানের জন্য, দুই দেশের জরিপ কর্তৃপক্ষকে পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশনা দেয়। সেই সঙ্গে আদালতে নিষ্পত্তিযোগ্য ও রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল দক্ষিণ বেরুবাড়ি ১২ নম্বর ইউনিয়ন ইস্যুটির প্রায়োগিক ও সুবিবেচনাপ্রসূত সমাধান দেয়। এই ইউনিয়ন ১৯৫৮ সালে স্বাক্ষরিত নেহরু-নুন চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে ১৯৪৭ সালে স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ অঙ্কিত সীমান্তরেখা অনুসরণ করে ভারতেরই অন্তর্ভুক্ত থেকে যায়।
ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির ইতিহাস তুলে ধরে প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, স্থলসীমা নির্ধারণ সম্পন্ন করা, অপদখলীয় ভূমি হস্তান্তর ও ছিটমহল বিনিময়ের লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালের ১৬ মে নয়াদিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল (মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী-১ জানুয়ারি ২০১৬, ছিটমহল এখন অতীত)।
ছিটমহল বিনিময়
২০১৫ সালের ১ আগস্টের আগে ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের মোট ১৬২টি ছিটমহল ছিল। ভারত ও বাংলাদেশের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৭৪ সালে যে চুক্তি স্বাক্ষর করেন তা স্থল সীমানা চুক্তি নামে সমধিক পরিচিত। এই চুক্তির উদ্দেশ্য চিল ছিটমহল বিনিময় এবং তাদের আন্তর্জাতিক সীমান্ত সরলীকরণের জন্য। এরপর দীর্ঘদিন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেকার এই সমস্যা অমীমাংসিত রয়ে যায়। অবশেষে ২০১৫ সালের ৭ মে ভারতের সংবিধানের ১০০তম সংশোধনী পাসের সময় এই চুক্তির একটি সংশোধিত সংস্করণ গ্রহণ করে দুই দেশ।
প্রথম আলোর নিবন্ধে বলা হয়, ১৯৪৭ সালে ভারতবাসী যখন ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি লাভ করে, তখন মালিকানা বিবেচনায় বিচ্ছিন্ন ছিটমহল নামক ভূখণ্ডগুলোতে বসবাসকারী মানুষেরা উল্টো অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড় ও নীলফামারী জেলার সীমান্ত এলাকা এবং ভারতের কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলার সীমান্ত এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছিটমহলগুলো হয়ে পড়ে একেকটি স্থলবেষ্টিত দ্বীপ। এর অধিবাসীরা পরিণত হয় রাষ্ট্র ও নাগরিকত্বহীন মানুষে। স্থলসীমা চুক্তিটি অবশেষে ২০১৫ সালের ৬ মে ভারতের রাজ্যসভায় ও ৭ মে লোকসভায় সর্বসম্মতভাবে পাস হয়। ভারতীয় সংবিধানের এই শততম সংশোধনীটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। লোকসভায় যারা এই বিলের মৃদু বিরোধিতা করেছিলেন, তাদের বিরোধিতা করা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বলেছিলেন, ‘আমরা যে রাজনীতির ঊর্ধ্বেও উঠতে পারি, তা গোটা পৃথিবীকে দেখানো দরকার।’ গোটা পৃথিবী সত্যি ছিটমহল-সংকটের একটি দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী মানবিক সমাধান দেখল।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের এক নিবন্ধে বলা হয়, ছিটমহলবাসীর মধ্যরাতের এই স্বাধীনতা ভারত-বাংলাদেশ এর বহু প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়েছে, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের এক নবদ্বার উন্মুক্ত করেছে (হাসান ইবনে হামিদ, ছিটমহল বিনিময়: এক ঐতিহাসিক অর্জন)।
ধর্মকে কেন্দ্র করে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকে ছিটমহল সমস্যা ছিল অমীমাংসিত। ১৯৫৮ সালের নেহেরু-নুন চুক্তি ছিল এই সমস্যার সমাধানের প্রথম প্রচেষ্টা। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালের ১৬ মে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মধ্যেকার চুক্তিতেও এ সমস্যার সমাধান হয়েছিল না। পরিশেষে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঐকান্তিক মধ্যস্থতায় দীর্ঘদিনের ছিটমহলের এই সমস্যার মীমাংসা হয়। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ৪৪ বছর অপেক্ষার পর স্বাধীনতার স্বাদ পায় ছিটমহলবাসী।