সরকারি বিভিন্ন সংস্থার বানানো অবৈধ লেভেল ক্রসিংই এখন হয়ে উঠেছে মৃত্যুফাঁদ

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জুলাই ৩১, ২০২২, ০৬:২৪ এএম

সরকারি বিভিন্ন সংস্থার বানানো অবৈধ লেভেল ক্রসিংই এখন হয়ে উঠেছে মৃত্যুফাঁদ

রেলের লেভেল ক্রসিং হওয়ার কথা নিরাপত্তার স্বার্থে। কিন্তু সরকারি বিভিন্ন সংস্থার বানানো অবৈধ লেভেল ক্রসিং এখন হয়ে উঠেছে মৃত্যুফাঁদ। সারাদেশে দুই হাজার ৮৭৮ কিলোমিটার রেলপথে লেভেল ক্রসিং রয়েছে দুই হাজার ৪৯৭টি। এর মধ্যে সহস্রাধিক ক্রসিংই অবৈধ। এসব ক্রসিংয়ে নেই কোনো গেটম্যান, ট্রেন চলাচলের সময় সড়ক বন্ধ করার প্রতিবন্ধক বা গেটবার পর্যন্ত নেই।

রেলের হিসাবে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে মাত্র তিনটি অবৈধ লেভেল ক্রসিং তৈরি করা হয়েছে। বাকি এক হাজার ৮২টি লেভেল ক্রসিং সৃষ্টি করেছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। সেগুলোই হয়ে উঠেছে মৃত্যুফাঁদ।

জানা যায়, রেলের অনুমোদন ছাড়াই রেলপথ পেরিয়ে সড়ক নির্মাণের কারণে এসব অবৈধ লেভেল ক্রসিং সৃষ্টি হয়েছে। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, বিভিন্ন বন্দর কর্তৃপক্ষ এসব অবৈধ লেভেল ক্রসিং তৈরি করেছে। বৈধতা না থাকায় তাতে নেই গেটম্যান, সতর্কীকরণ ঘণ্টা-বাতি ও নির্দেশক। 

যত্রতত্র ও খেয়ালখুশি মত এসব রেল ক্রসিং নির্মাণের ফলে রেল এখন মৃত্যুফাঁদ হয়ে উঠেছে। সারাদেশে রেলে অনুমোদনবিহীন প্রায় ১ হাজার ৩৬১টি ক্রসিং রয়েছে। এছাড়া গেটম্যান নেই ৬৩২টি লেভেল ক্রসিংয়ে। যার ফলে ১ হাজার ৯৯৩ ক্রসিংয়ে কোন নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে না। এ ছাড়া রেল কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে রেল লাইনের ওপর স্থানীয় পর্যায়ে বিকল্প রাস্তা তৈরি করে বিপদের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।  

অরক্ষিত ২ হাজার রেলক্রসিং

রেলওয়ের তথ্যমতে, রেলের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল মিলে সারাদেশে ২ হাজার ৮৫৬টি লেভেলক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৬১টিরই অনুমোদন নেই রেলের। আবার বৈধ ১ হাজার ৪৯৫টির মধ্যে ৬৩২টিতে গেটম্যান নেই। অর্থাৎ মোট ১ হাজার ৯৯৩ ক্রসিংয়ে রেল কর্তৃপক্ষ থেকে কোন গেটম্যান বা নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। 

অনেক সময়ই দেখা যায়, রেলক্রসিংয়ের পাশে থাকা দোকানদাররা এগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। যার ফলে ট্রেন আসার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সাধারণ মানুষ লেভেল সরিয়ে চলাচল করে। এতে দুর্ঘটনা অনেক বেশি বেড়ে যায়।

দুর্ঘটনা বাড়ছে লেভেল ক্রসিংয়ে

বুয়েটের গবেষণা ইন্সটিটিউট এর তথ্য মতে, ২০১৬ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৬ বছরে ৯৭৪টি দূর্ঘটনায় ১ হাজার ৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ১১৬টি ছিলো লেভেল ক্রসিংয়ে।  এতে নিহতের সংখ্যা ছিলো ১৭৩ এবং আহত হয়েছে সহস্রাধিক মানুষ। 

এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অরক্ষিত রেলপথ, যত্রতত্র ও খেয়াল খুশি মত অবৈজ্ঞানিক ভাবে বানানো রেলক্রসিংয়ের কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই দুর্ঘটনাগুলো ঘটে। আবার পরিকল্পিতভাবে বানানো রেলক্রসিংয়ে গেটম্যানের অভাব, চলাচলকারীদের অসচেতনতা, সনাতন পদ্ধতিতে গড়ে উঠা রেলের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণসহ নানা কারণে ঘটছে এইসব দূর্ঘটনা। 

অথচ রেলওয়ের তথ্যমতে, গত এক দশকে রেলে ৬৫ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। প্রায় দেড় লাখ টাকা ব্যয়ে নেওয়া হয়েছে ৩৯টি প্রকল্প। নেওয়া হচ্ছে নতুন নতুন প্রকল্প, কিন্তু অভিযোগ রয়েছে নতুন প্রকল্প নেওয়ায় কর্তৃপক্ষ যতটা আন্তরিক, সংস্কার করে চলতে সক্ষমতা বাড়ানোতে ততটাই রয়েছে অনীহা। রেলক্রসিংগুলোর আধুনিকায়ন ও নিরাপদ করতে নেই তেমন কোন প্রকল্প। 

আধুনিকতা নেই রেল ক্রসিংয়ে

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ মো. হাদীউজ্জামান বলেন, লেভেল ক্রসিংয়ের জন্যে খুব বেশি বিনিয়োগ লাগে না। আমরা লেভেল ক্রসিংয়ে এখনও সনাতনী পদ্ধতি ব্যবহার করি। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ডিজিটালাইড পদ্ধতিতে এটি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। মানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে লেভেলক্রসিংয়ের গেট বন্ধ হয়ে যাবে। এতে করে রেলের লেভেলক্রসিংয়ে ঘটা দূর্ঘটনা কিছুটা হলেও কমবে। 

বিপুলসংখ্যক রেলক্রসিং অরক্ষিত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারাও। রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর হোসেন বিষয়টির সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, আমাদের গেটম্যান সংকট রয়েছে। যার ফলে আমরা কম গুরত্বপূর্ণ রেলক্রসিং বন্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনা করছি।

বৈধ ১ হাজার ৪৯৫টি লেভেলক্রসিং এর মধ্যে ৬৩২টিতে গেটম্যান নেই কেনো সেটা জানতে চাইলে রেলের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এস. এম. সলিমুল্লাহ বাহার জানান, কিছুদিন আগেই আমরা নিয়োগ দিয়েছি প্রায় ১ হাজার ৮০০ জনের মত। কিন্তু অনেকক্ষেত্রে অনেক রেল স্টেশন বিকল, অনেকে অবসরে যায় ফলে লোকবল সংকট হয়।

স্থানীয় সরকারের যত্রতত্র রেলক্রসিং

রেলওয়ের তথ্যমতে, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানও রেলকে না জানিয়ে অবৈধ লেভেলক্রসিং তৈরি করেছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) রেলপথে সবচেয়ে বেশি অবৈধ লেভেলক্রসিং বানিয়েছে। সংস্থাটির ৪৫২টি অবৈধ লেভেলক্রসিং রয়েছে। একইভাবে ইউনিয়ন পরিষদের ৩৬৩টি, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ১১টি, পৌরসভার ৭৯টি, সিটি করপোরেশনের ৩৪টি, জেলা পরিষদের ১৩টি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ৩টি, বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের একটি, জয়পুরহাট চিনিকলের একটি লেভেলক্রসিং রয়েছে। অন্যদিকে ৩৩টি ক্রসিংয়ের মালিকানার তথ্যই জানে না রেলওয়ে। অর্থাৎ রাস্তা কোন কর্তৃপক্ষ তৈরি করেছে তার হদিস করতে পারে না রেল।

এ বিষয়ে রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালক মো. আবু তাহের বলেন, রেলের যেসব অবৈধ লেভেল ক্রসিং রয়েছে সেগুলো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দেখভাল করা উচিত কিংবা যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করে পুনঃনির্মাণ উচিত। এ জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ শক্তি-নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হবে।

Link copied!