কাতুকা রেকুলা পোদা

ব্রিটিশদের নাজেহাল করা সাপ কিভাবে হয়ে উঠল রাসেল’স ভাইপার?

ফাহিম রেজা শোভন

জুন ২৫, ২০২৪, ০৮:১০ পিএম

ব্রিটিশদের নাজেহাল করা সাপ কিভাবে হয়ে উঠল রাসেল’স ভাইপার?

প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশে চন্দ্রবোড়া বা উলুবোড়া নামেও পরিচিত রাসেল’স ভাইপার সাপ। ইংরেজিতে ভাইপার অর্থ সাপ। এই সাপ শব্দটির আগে রাসেল’স নামটি এলো কিভাবে?

স্কটল্যান্ডের এডিনবারায় (এডিনবার্গ) জন্মগ্রহণ করা প্রকৃতিবিদ-সার্জন প্যাট্রিক রাসেল ১৭৮১ সালের পর ভারতে এসে এই উপমহাদেশীয় অঞ্চলের প্রাকৃতিক ইতিহাস অধ্যয়ন শুরু করেন।

সে সময় কর্নাটক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তারা সাপের কামড়ে অতিষ্ট হয়ে ওঠেন। এই সমস্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বিষধর সাপ শনাক্ত করার উপায় খুঁজতে প্যাট্রিক রাসেলকে নিয়োজিত করেন ব্রটিশরা। তিনি কোবরার পরেই যে প্রাণঘাতী সাপটি শনাক্ত করতে পেরেছিলেন সেটিকে স্থানীয় তেলেগু ভাষায় ডাকা হত কাতুকা রেকুলা পোদা (Katuka Rekula Poda)। এটিই বর্তমান সময়ের রাসেল’স ভাইপার।

পরবর্তিতে ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে সাপের ওপর ‘অ্যান অ্যাকাউন্ট অফ ইন্ডিয়ান সার্পেন্টস কালেক্টেড অন দ্য কোস্ট অব কোরোমন্ডেলের’ (An Account of Indian Serpents Collected on the Coast of Coromandel) বই লিখেছেলেন প্যাট্রিক রাসেল। বইটির প্রথম খণ্ড ১৭৯৬ সালে ৪৪টি প্লেটে প্রকাশিত হয়েছিল। প্যাট্রিক রাসেল অবিবাহিত অবস্থায় মারা যান ১৮০৫ সালে।

এছাড়াও জীবদ্দশায় পিট ভাইপার ট্রাইমেরেসুরাসের (Trimeresurus) গর্তের ওপর দুটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন তিনি। আর মৃত্যুর এক বছর আগে “কীভাবে সাপ তার ফণা ছড়িয়ে দেয়” তার ওপর আরেকটি গবেষণাপত্র তৈরি করেছিলেন তিনি। বিষধর এই সাপের ওপর তার গবেষণা ও সেই ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের জন্যই এই প্রজাতির সাপের নাম রাসেল’স ভাইপার হয়। রাসেল’স ভাইপারের আরেকটি শ্রেণি রয়েছে যার নাম ডাবোয়া রুসেলি।

এক সময়ের বিলুপ্ত প্রায় বিষধর সাপ রাসেল’স ভাইপার মূলত বরেন্দ্র তথা রাজশাহী অঞ্চলে বেশি দেখা যেত। বর্তমানে আশে পাশে ছাড়াও সাপটির খোঁজ মিলছে বরিশাল, পটুয়াখালী, চাঁদপুর এমনকি ঢাকার আশপাশেও।

আরও পড়ুন: উত্তরবঙ্গের সাপ ঢাকায় কিভেবে এল?

গুগল ট্রেন্ড -এ ব্রেক আউট টপিক  

২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত এ সাপের কামড়ে মারা গেছেন ১০ জন। সম্প্রতি গুগল ট্রেন্ড - এর বাংলাদেশ রিজিয়নের বিগত ৭ দিনের সংবাদ সার্চের ক্যাটাগরি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, টপিক হিসেবে রাসেল’স ভাইপার (Russell‍‍`s Viper) সার্চের ব্রেকআউট ঘটেছে। ব্রেকআউট বলতে বোঝায় যখন কোনও কিছুর পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক অনেক বেশি হয়ে যায়। আর গুগলে সার্চ ব্রেকআউট বলতে কোনও বিষয়বস্তুর সার্চ ভলিউম সাম্প্রতিক সময়ে ৫০০০% বৃদ্ধি পাওয়া কে বোঝায়।

নেটিজেনরা অনেকেই বলছে সাপ প্রকৃতির থেকে বেশি ঘোরাঘুরি করছে “সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে”। এমনকি, চিত্র নায়িকা পরী মণি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন “রাসেল’স ভাইপার ট্রেন্ড শেষ হয়ে তিনি হতে যাচ্ছেন নতুন আলোচনার বিষয়বস্তু”। এ থেকেই বোঝা যায় সাপটির সোশ্যাল মিডিয়া ট্রেন্ড সম্পর্কে।

চাঞ্চল্যকর ঘটনা

বাস্তব জীবনে অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এই সাপ ধরতে পারলেই ৫০ হাজার টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেন ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহ্ মো. ইশতিয়াক আরিফ। এক ব্যক্তি সাপ ধরে জেলাটির প্রেস ক্লাবেও হাজির হয়েছিলেন পুরস্কার পাওয়ার আশায়। তবে স্থানীয় সূত্রের বরাতে জানা যায়, রাসেল’স ভাইপার না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত আর টাকা পাননি তিনি।

গত ২১ জুন যশোরের শার্শায় সাপের কামড়ে ফোরকান হোসেন (১২) নামের এক মাদ্রাসা ছাত্রের মৃত্যু হয়। সাপে কাটার পর প্রাথমিকভাবে তাকে হাসপাতালে না নিয়ে ওঝার কাছে নিয়ে ঝাড়ফুঁক করা হয় বলেও জানা যায়। তবে তাকে রাসেল’স ভাইপার কামড়েছিল কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

কোন এলাকায় পাওয়া যাচ্ছে রাসেল’স ভাইপার

১৯২৯ সালে পি ব্যানার্জি লিখিত ‘হ্যান্ড বুক অব স্নেক-বাইট’ বইটিতে এক হাজার ৮৩টির মতো কেস স্টাডি আছে। সেখানে ২২টি চন্দ্রবোড়া সাপের তথ্য আছে, যেগুলোর ভৌগোলিক এলাকা বর্তমান বাংলাদেশ। এর মধ্যে খুলনা, কুষ্টিয়া, যশোর—এসব জায়গার নাম আছে।

পদ্মা নদীর তীরবর্তী জেলাগুলোতে এই সাপ বেশি ছড়াচ্ছে। গবেষকরা বলছেন, অনুকূল আবহাওয়ার কারণেই ছড়াচ্ছে রাসেল’স ভাইপার। মূলত পদ্মা অববাহিকায় চাঁদপুর, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ এমনকি ঢাকাতেও দেখা মিলছে রাসেলস ভাইপারের। সাপটি একসঙ্গে ৩-৬৩টি পর্যন্ত বাচ্চার জন্ম দিয়ে থাকে। এসব বাচ্চা দুই বছরে পরিপক্ব হয়। এদের গর্ভধারণকাল ছয় মাস। এই সাপের কামড়ে দেড় বছরে শুধু রাজশাহী মেডিকেলেই মারা গেছেন অন্তত ১৮ জন। এ সময়ে ওই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬৮ জন।

আরও পড়ুন: রাসেল’স ভাইপার বাংলাদেশে এলো কোথা থেকে?

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজেরে ভেনম রিসার্চ সেন্টারের হিসেবে জেলার কিছু কিছু জায়গায় এ সাপ আছে ২৭টির মতো। তার মতে এটি কোবরা কিংবা কেউটের চেয়ে কম প্রাণঘাতী কিন্তু এই সাপের বিষে নানা ধরণের উপাদান বেশি। ফলে চিকিৎসায় বিলম্ব হলে বহুমাত্রিক জটিলতা তৈরি করে শরীরে। সেজন্য তখন আর অ্যান্টিভেনম দিয়ে কাজ হয় না। ক্রমান্বয়ে ফুসফুস, কিডনি আক্রান্ত হয়। এক পর্যায়ে অনেক রক্তক্ষরণ হয়, তখন আর রক্ত দিলে শরীরে তা থাকে না।

Link copied!