এপ্রিল ১৫, ২০২৫, ০৯:০০ পিএম
এই দোকানের প্রতিটি কর্মীই তৃতীয় লিঙ্গের
ঢাকার বনানীর ব্যস্ত শহুরে মোড়ে হঠাৎ করেই চোখে পড়ে এক শান্ত, সুসজ্জিত শোরুম—নাম তার ‘সমান্তরাল’। বাইরে থেকে দেখলে বোঝার উপায় নেই, এই দোকান শুধু কাপড় বা গৃহসজ্জার সামগ্রী বিক্রি করে না—এটি বিক্রি করে সাহস, আত্মবিশ্বাস আর পরিবর্তনের গল্প। সময় তখন দুপুর ১টা ৩০ মিনিট। কৌতূহল নিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই স্বাগত জানালেন সাজু নামের এক ট্রান্সজেন্ডার কর্মী। চোখেমুখে আত্মবিশ্বাস আর ব্যবহার এতটাই ভদ্র আর আন্তরিক যে প্রথম দেখাতেই মন ছুঁয়ে যায়। অতিথির মতো বসতে বললেন, সম্মান দিয়ে কথা বললেন।
বেগুলী রঙের নামফলকে বাংলায় লেখা ‘সমান্তরাল’। ভেতরে ঢুকতেই নজরে আসে রঙিন জামা-কাপড়, হাতে তৈরি গিফট আইটেম আর ছোট ছোট ঘরোয়া সৌন্দর্য বাড়ানোর জিনিস। তবে এখানকার সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য লুকিয়ে রয়েছে দোকানের মানুষগুলোর হাসিমুখে। কারণ এই দোকানের প্রতিটি কর্মীই তৃতীয় লিঙ্গের।
যারা একসময় চাঁদা তুলতেন, আজ ব্যবসা করছেন
এক সময় যারা বাসে-ট্রেনে উঠে চাঁদা তুলতেন, সমাজের গালিগালাজ সহ্য করতেন, আজ তারা কাপড় তৈরি করছেন, শোরুম চালাচ্ছেন, সম্মানের সঙ্গে জীবন কাটাচ্ছেন।
সাজু নামে তৃতীয় লিঙ্গের কর্মচারী বলেন, “আগে কেউ কাছে আসত না, চোখে চোখ রাখত না। এখন মানুষ আমাদের সঙ্গে কথা বলে, আমাদের কাজ দেখে। আমরা নিজেরাই কাপড় তৈরি করি। এই কাজেই জীবনের মানে খুঁজে পেয়েছি।”
সমান্তরাল উদ্যোগটি শুরু হয় ২০২২ সালে, আকিজ বশির গ্রুপের ট্রাস্টের একটি মানবিক প্রকল্প হিসেবে। প্রথমে একটি ছোট কারখানা দিয়ে শুরু হলেও আজ এটি একটি পরিপাটি শোরুমে রূপ নিয়েছে, যেখানে কাজ করছেন প্রায় ২০–২৫ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ।
সমান্তরাল ঘুরে যাওয়া পারটেক্স কোম্পানির এক কর্মকর্তা সেতু জানান, “আগে যারা হিজড়া দেখলে ভয় পেত, এখন তারা এই দোকানে এসে কিনাকাটা করছে। এটা একটা বড় পরিবর্তন। এই মানুষগুলো যখন একটি স্বাভাবিক পরিবেশে কাজ করে, তখন আমরাও তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি।”
এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে হার না মানা মানসিকতা, অনেক অপমান, অনেক কান্না, এবং একচিলতে স্বপ্ন—সমানভাবে সমাজে বেঁচে থাকার।
শেখ সেঁজুতি আহসান, যিনি এই উদ্যোগের টিম লিডার ও ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর, জানালেন, “তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের আমরা শুধু কাজ দিয়েই থামছি না, তাদের দক্ষতা বাড়ানোর প্রশিক্ষণও দিচ্ছি। তারা যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, ক্যারিয়ার গড়তে পারে—এই হচ্ছে আমাদের আসল লক্ষ্য।”
সমান্তরাল দোকানটি এখন অনেকের কাছেই ভালোবাসার জায়গা। এখানে যারা কেনাকাটা করতে আসেন, তারা শুধু একটা জামা কিনে যান না—তারা নিয়ে যান একটা গল্প, একটা বার্তা।
এই স্টল আজ শুধু একটি বিক্রয়কেন্দ্র নয়—এটি হয়ে উঠেছে আশার কেন্দ্র, ভালোবাসার প্রতীক। যে সমাজ একসময় তাদের অবহেলা করেছিল, সেই সমাজ আজ তাদের কাজের প্রশংসা করছে, পণ্য কিনছে, এবং ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে।
সমান্তরাল আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—সুযোগ পেলে, সম্মান পেলে, কেউই সমাজের বাইরে থাকে না। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরাও সমাজের গর্ব হতে পারেন। প্রয়োজন শুধু একটু সহানুভূতি, একটু সহযোগিতা আর সমতার চোখে দেখার দৃষ্টি।