২০১৮ সালে দ্রুতগতিতে বিস্তার লাভকারী কোটা সংস্কার আন্দোলন ২০২৪-এ এসে মহাবিস্ফোরণে রূপ নেয়। যার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হিসেবে আরব বসন্ত বলা যেতে পারে। ২০১০-১১ সালের মধ্যে বিশ্বের তাবড় তাবড় স্বৈরাচারীর পতন হয়ে গেল। মিশরের হোসনি মোবারক, লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফি কিংবা তিউনিসিয়ার বেন আলী- গণআন্দোলনের কাছে স্বৈরাচারের গদি যে তুচ্ছ তা আরব বসন্তই প্রমাণ করে দিয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা বৈষম্যের কারণে অনেক অযোগ্য প্রার্থী সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসছেন। আর মেধাবীরা পড়াশুনা করার পরেও নিজেদর আবিষ্কার করছে দারিদ্র্যের গুহার ভেতর।
এমনই একটা গুহা, যেখানে অনার্স-মাস্টার্স পাশ করার পরেও একটা ছেলে বা মেয়েকে বেকারত্বের গঞ্জনা সইতে হয়। কোটা বৈষম্যের কারণে মেধাবীরা তাদের জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছেন না।
এ তো গেল বাংলাদেশের কোটা বৈষম্যের কথা। এবার একটু বিস্তারিতভাবে আরব বসন্তের দিকে মনোযোগ দেওয়া যাক। আরব বসন্তের কথা বলতে গেলে আমার চোখে ভাসে, তিউনিসিয়ার ফেরিওয়ালা মোহাম্মদ বোয়াজিজি। চাঁদা না দেওয়ায় বোয়াজিজির ভ্যানে থাকা সব সবজি রাস্তায় ফেলে দেয় পুলিশ। সেই অপমানের প্রতিবাদস্বরূপ আত্মাহুতি দেন বোয়াজিজি। তার এই আত্মাহুতিতেই টনক নড়ে তিউনিসিয়াবাসীর। গড়ে ওঠে স্বৈরাচার বেন আলীর বিরুদ্ধে আন্দোলন। ছাত্র-জনতার সেই আন্দোলন অভ্যুত্থানে পরিণত হতে থাকে। একপর্যায়ে পদত্যাগে বাধ্য হন বেন আলী। একে একে মিশরে হোসনি মোবারক, লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফিসহ একাধিক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাউত্তর সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযোদ্ধাদের সচ্ছ্বলতা ফিরিয়ে আনার জন্য নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা নিয়ে আসেন। সেসময় এর পেছনে কাজ করেছে মহদুদ্দেশ্য মুক্তিযোদ্ধা ও পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীকে সুযোগ দেওয়ার জন্যই এই কোটা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে সরকারি গোষ্ঠীর ক্ষমতার অপপ্রয়োগের কারণে কোটা ব্যবস্থা ব্যাপক সমালোচিত হতে থাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যার পর ১৯৯৬ সালে আবারও ফিরে আসে এই কোটা ব্যবস্থা। এরপর ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের হারের পর ২০০৮ সালে আবারও এই ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হয়।
বিভিন্ন সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতে প্রণীত এই কোটা ব্যবস্থায় সরকারি চাকরির ৫৬ শতাংশ বরাদ্দ ছিল: মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের ৩, নারীদের ১০, অনগ্রসর জেলাগুলোর ১০, আদিবাসীদের জন্য ৫ ও প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ।
২০২৪ সালে শিক্ষার্থীদের দুর্বার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা ৫ ও অন্যান্য ২ শতাংশ রাখার আদেশ দেন। সেদিক থেকে আমি বলবো, শিক্ষার্থীদের বাংলা ব্লকেড ও কমপ্লিটলি শাটডাউন সফল হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদেরই বিজয় হয়েছে।
যদি বলা হয়, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আন্দোলন কোনটি? তবে আমি, আপনি নির্দ্বিধায় জবাব দেবো- সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন। নিকটঅতীতে দক্ষিণ এশিয়ায় মহাবিস্ফোরণের আকার নেওয়া দ্বিতীয় কোনও আন্দোলন নাম পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের তরুণরা সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করার দাবি নিয়ে রাজপথে নেমেছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, পুলিশ ও ছাত্রলীগ লেলিয়ে দিয়ে শিক্ষার্থীদের নানাভাবে হেনস্থা করা হয়েছে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করা হলো। আবার গ্রেপ্তার করা হলো- কিশোর মাহিমকে! যদিও দেশব্যাপী সমালোচনার মধ্যে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, মাহিমের বয়স যেখানে ১৫-১৬ বছর, সেখানে তাকে ১৯ বছর বয়স দেখানো হলো কেন?
বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে সাম্প্রতিক বিশ্বের আরব বসন্তকে মেলানো যায়। কেননা আরব বসন্তও ছিল সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অসন্তোষের ফল। ২০১০ সালের শেষদিকে তিউনিসিয়ায় শুরু হওয়া এই আন্দোলন দ্রুত মিশর, লিবিয়া ও ইয়েমেন এবং সিরিয়ার মতো দেশে ছড়িয়ে পড়ে। যেসব দেশে দীর্ঘদিন ধরে কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী শাসন এবং দুর্নীতি বহাল ছিল। এক বোয়াজিজির আত্মাহুতিই যেন গোটা আরব বিশ্বের রাজনীতির চাকা ঘুরিয়ে দেয়। সামাজিক ন্যায়বিচারের দাবিতে শুরু হয় গণআন্দোলন। তবে আরব বসন্ত যেমন সম্ভাবনার বিষয়টা সামনে এনেছে, তেমনই এনেছে নানান অমীমাংসিত প্রশ্ন। আরব বসন্তের কারণে সিরিয়া ও ইয়েমেনে দেখা দিয়েছে নানামুখী রাজনৈতিক জটিলতা। সেদিক থেকে দেখতে গেলে বাংলাদেশেরও নিশ্চিন্তে ঘুমালে চলবে না। বরং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। কেননা কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেরিতে হলেও যে তরুণ প্রজন্মের জাগৃতি আমরা দেখতে পেয়েছি, তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে আরও অনেকগুলো অন্ধকারাচ্ছান্ন সত্য। আর সেগুলো হলো নাগরিকদের চলাফেরার স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় ক্ষমতাসীন সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপ। সেলফ সেন্সরশিপের মাধ্যমে আজকে বাংলাদেশকে করদ রাজ্য বানিয়ে রাখা হয়েছে। সাংবাদিকদের হাত-পা বেঁধে রাখা হয়েছে। ডিজিটাল বা সাইবার সিকিউরিটি আইনের অপপ্রয়োগ করে যে সাধারণ নাগরিকদের মুখ বুজে রাখা হয়েছে এবং এই অবস্থায় বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিক মুখে বুজে আছে মানে এই না যে তারা সরকারে এই অন্যায্যতা মেনে নিয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকারকে মনে রাখতে হবে, গণনীরবতা গণবিস্ফোরণের সংকেত দেয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন তার প্রমাণ।
পরিবর্তনের অনুঘটক হিসেবে সবসময় তরুণরাই এগিয়েছে। সেটা আরব বসন্তের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনই সত্য বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রেও। এক কোটা সংস্কারের দাবিতেই কিন্তু থেমে নেই শিক্ষার্থীরা। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে যারা নিহত হয়েছেন, তাদের বিচারের দাবি এবং অন্যান্য সাম্যের দাবি নিয়ে এখনও মাঠে অবস্থান করছে তরুণ শিক্ষার্থীরা। প্রশ্ন হলো- সরকার কি এবারেও দমন-পীড়নের আশ্রয় নেবে?
লেখক: সাংবাদিক