কেমন আছে ঊনিশ শতকে আহসান মঞ্জিলের প্রতিদ্বন্দ্বী এই ভবন?

আফছার মুন্না

জুলাই ১২, ২০২৩, ০৩:৩৩ এএম

কেমন আছে ঊনিশ শতকে আহসান মঞ্জিলের প্রতিদ্বন্দ্বী এই ভবন?

সাল ১৮৮৮! লর্ড ডাফরিন ঠিক করলেন, সরকারি সফরে ঢাকায় আসবেন। ভারতের গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয়ের আদর আপ্যায়নে কমতি হওয়া কোন মতেই চলে না। তাইতো, তার আগমনকে সামনে রেখে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন এই অঞ্চলের দায়িত্বে থাকা ইংরেজ কর্মকর্তারা। ইংরেজ সাহেবরা ঠিক করলেন— অন্যান্য আয়োজনের সাথে ডাফরিনের মনোরঞ্জনের জন্য থাকবে বল নাচের ব্যবস্থা। 

কিন্তু, বল নাচের সাথে এই এলাকার মানুষের তখনও পরিচয় হয়ে উঠেনি। তাই স্বভাবতই এই অঞ্চলে বল নাচের উপযোগী কোন হল ঘরও তৈরি হয়নি। এই সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে? ঠিক করা হলো— তৎকালীন ঢাকার সবচেয়ে সুরম্য অট্টালিকায় এই নাচের আয়োজন করা হবে। অবশ্য প্রাসাদটি হতে হবে এমন, যেখানে থাকবে বিরাট আকারের হলঘরের সুবিধা। ইংরেজ সাহেবরা সবাই সবার পছন্দমত নাম প্রস্তাব করলেন। দু’টি নামই সবচেয়ে বেশিবার ঘুরে ফিরে সাহেবদের মুখে উচ্চারিত হয়েছে।  

সিদ্ধান্ত হলো, এ দুইটি ঘরের মধ্যে যেটি বেশি সুন্দর সেখানেই আয়োজন হবে বল নাচের। তৎকালীন ঢাকার একটি ক্লাবে এ বিষয়ে বৈঠক হলো, অংশ নিলেন সাহেবরা। কিন্তু, বৈঠকে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি, শেষে তা কি-না গিয়ে ঠেকেছিল ভোটাভুটিতে। প্রতিদ্বন্ধিতা হয়েছিল আহসান মঞ্জিল ও রূপলাল হাউজের মধ্যে। 
রূপলাল হাউজের রূপই ইংরেজ বাবুদের বেশি আকৃষ্ট করেছিল। ভোটে অধিকাংশ সাহেব মত দিলেন— ডাফরিনের জন্য বল নাচের আয়োজন করা রূপলাল হাউজে। 

দু’শো টাকার বিনিময়ে ইংরেজরা নাচের আয়োজনের জন্য দুই দিনের জন্য ভাড়া করল এই হাউজটি। তারপর তাদের পছন্দমতো সাজিয়ে নিয়েছিল পুরো হাউজ। রূপবাবুর রঙ্গমহলকেই বল নাচের স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হল। 

এছাড়া বাকি রুমগুলো অভ্যর্থনা আর আহারের স্থান হিসেবে নির্দিষ্ট করা হল। নিচতলায় জমিদারের অফিসের একপাশে বিশেষ শৌচাগারের ব্যবস্থা করা হল। এইরূপ আরও নানা পরিবর্তন আনা হলো হাউজটিতে। বহুদিনের পরিকল্পনামাফিকই পুরো ঘরটি সাজিয়েছেন ইংরেজরা। 

যাইহোক, সেদিনের সেই আয়োজনের বিবরণ অনেকটা কটাক্ষ করেই প্রকাশ করেছিল এই অঞ্চলের পত্রিকাগুলো। তাদের লেখাগুলো দেখে মনে হলো; এই এলাকার মানুষ তার আগমনে খুব সন্তুষ্ট হতে পারেনি। আগেই বলেছিলাম এই অঞ্চলের মানুষ বল নাচের সাথে পরিচত নয়, তাই বোধকরি বল নাচের বর্ণনা দিয়েই শুরু করেছিল পত্রিকাটি। তবে সেই বর্ণনায় ছিল শ্লেষ আর কটাক্ষে ভরপুর, “এ বল গায়ের বল নয়। যার গায়ে বল নাই, এ বলে সেও নাচে গো, সেও নাচে। এ দেশে পার্বত্য জাতিরা দলে দলে স্ত্রী-পুরুষে জুটিয়ে নাচিয়া থাকে। 

আমরা সেই নাচকে অসভ্যতা বলি, আর বলবান সত্য জাতিরা সেই নাচ নাচিলে তাহার নাম হয় ‘বল’।” 
সংবাদ ভূমিকার পরেই পত্রিকাটি অনুষ্ঠানের বর্ণনায় আরো লিখেছিল, “নবাব ও গৃহপতিদ্বয়কে লইয়া শতাধিক সাহেব ও মেম মিলিয়া নাচিয়াছিলেন। গভর্নর জেনারেল বাহাদুর বৃদ্ধ হইলেও শুনিয়াছি প্রত্যেক মেম সাহেবের সঙ্গে নাচিয়া তাহাদের সম্মান রক্ষা করিয়াছিলেন। নাচের সঙ্গে সঙ্গে রীতিমত মদ, মাংস, চা-কফী, সকল প্রকার চর্ব্য- চোষ্য- লেহ্য- পেয় প্রচুর পরিমাণে চলিয়াছিলো। লর্ড ডাফরিন চলিয়া গেলেও অবশিষ্ট রাত্রি সাহেবেরা আমোদ-প্রমোদে কাটাইয়াছিলেন। এই সময়খানি তাঁহারা একান্ত মদবিহ্বল হইয়া গালাগালি, হুড়াহুড়ি, সোরা সারবৎ এত করিয়াছিলেন, যাহাতে নিকটবর্তী লোকেরা আতঙ্ক ও জুগুপ্সা প্রকাশ না করিয়া পারে নাই। যাহা হউক, আমরা তত শুচিবাই বিশিষ্ট নহি যে, সাহেবদিগের দেশাচারসম্মত এই সাময়িক আমোদ প্রমোদে আমরা কোন অনৌচিত্য প্রদর্শন করিতেছি।” 

১৮৮৮ সালে যেই ভবনে এমন সোৎসাহে গভর্নর তোষণ চলেছিল সেই ভবনই কি-না ঊনিশ শতকের শেষের দিকে অবহেলিত হতে থাকে! এই বিষয়ে সত্যেন সেন লিখেছেন, “ভূমিকম্পের সময় (১৮৯৭) ইহার চূড়া ভাঙ্গিয়া যাওয়ায়, ভাগের মা গঙ্গা না পাওয়ার মত, ইহার আর মেরামতি হয় নাই”। তারপর, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় রূপলালের বংশধররা ওপার বাঙলায় পড়ি জমালে এই হাউজটি মানুষ দখল করে নেয়।

ভালো নেই রূপলাল হাউজ 

ঊনিশ শতকের শুরুর দিকে পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীদের মধ্যে বেশ নামডাক ছিল রূপলাল দাস ও রঘুনাথ দাসের। সেসময় এই দুই ভাই ঠিক করলেন, তাদের সামাজিক মর্যাদার সাথে যায় এমন একটি বাড়ি কিনবেন। অবশেষে ১৮৪০ সালের দিকে তারা আর্মেনিয়ান জমিদার আরাতুনের প্রায় এক দশক কিংবা তারও কিছু পুরোনে বাড়ি কিনে নেন। 

রূপলাল দাস তার অংশ পুনর্নিমানের কাজ দেন কলকাতার বিখ্যাত ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি মার্টিন অ্যান্ড কোংয়ের হাতে। বিশাল নির্মাণযজ্ঞে ব্যবহার করা হয় স্থানীয়ভাবে পোড়ানো ইট আর প্রচুর লোহা। নির্মাণ কাজ চলেছিল দীর্ঘসময়। বিলাসী রূপলাল দশক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শুধু উপমহাদেশের ব্রিটিশ ভাবধারাই নয় বরং ইউরোপিয়ান স্থাপত্য হালচাল এর সর্বশেষ সব স্টাইল একটু একটু করে জুড়ে দিয়েছেন তার শখের বাড়িতে। সেকালে প্রায় ৪৫ হাজার টাকা খরচ করেছিলেন বলে শোনা যায়। 

যাইহোক, ঊনিশ শতকের ঢাকায় নবাবদের আহসান মঞ্জিলের সাথে যেই ভবনের জাঁকজমক ও চমৎকারীত্বের তুলনা হতো বিংশ শতকে সেই ভবনের অবস্থা পুরো উল্টে যায়। সত্যেন সেনের বর্ণনায় এই ভবনের মূল দু’টি আকর্ষণের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেগুলোর মধ্যে প্রথমটি হলো, গ্রিক স্থাপত্যরীতির অনুকরনে এখানে তৈরি ডরিক কলাম অন্যটি হলো এর ঠিক মাঝে থাকা প্রকাণ্ড ঘড়ি। যা দিয়ে উপকৃত হতো বুড়িগঙ্গায় যাতায়াত করা প্রতিটি মানুষও। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে সেই ঘড়িটির অংশ ভেঙে যায়। তারপর আর তার মেরামত করা হয়নি। অবহেলার শুরুটা সম্ভবত তখন থেকেই। রূপলালের বংশধরদের দেশত্যাগের পর তো এই অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। 

রূপলালের বংশধররা দেশ ছাড়েন ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময়। তারপর ভবনটির মালিকানা চলে যায় সরকারের কাছে। কিন্তু, সরকার তার যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণে মনোযোগী হয়েছিলেন কি না তা নিয়ে প্রশ্ন করার যথেষ্ট সুযোগ থেকেই যায়। যাইহোক, বেশ কয়েকবার মালিকানা হাতবদল হয়েছে, এই যুক্তিতে বর্তমানে এর মালিকানা দাবি করে বেশ কয়েকটি পক্ষ। এ নিয়ে একটি মামলা এখনও চলমান। 

মালিকানা যাদের হাতেই থাকুক না কেন, তাদের হাতে যে এই ভবন যে ভালো নেই তা সেখানে গেলেই বোঝা যায়। পুরোনোকে যারা হাঁতড়ে বেড়ান, বাড়িটির রূপের কথা শুনে বাড়িটি স্বচক্ষে দেখার ইচ্ছা তাদের স্বভাবজাত। গুগল ম্যাপের সহযোগীতায় সদরঘাটের চাঁদপুর জেটির কাছে পৌঁছালাম— ম্যাপ বলছে বাড়িটি সেখানেই। কিন্তু, তেমন কোন স্থাপনা দেখতে না পেয়ে স্থানীয়দের সহায়তা নিলাম। 

একজন বাড়িটিতে ঢোকার পথ দেখিয়ে দিলেন, ‘এই দোকানের ভেতরর দিয়ে গেলেই সামনে পৌঁছাবেন’। তার কথামতো সেই রসুনের গুদামের মাঝ দিয়ে গিয়ে উঠলাম ভবনের সামনের অংশে। দেখা মিলল পানের আড়তের। ছবি তুলতে গেলে আড়তের লোকেরা একটু বিরক্তিভরা চোখেই তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন পান সাজানোর কাজে— এই ফাঁকে দু’টো ছবি তুলে নিলাম। 

রূপলাল হাউজের রূপের কিছুই অবশিষ্ট নেই বাড়িটির এই অংশে। অবশ্য, ভালো করে দেখা গেলো না কিছুই। তেরপালের ছাউনির কারনে দেয়াল ছাড়া কিছুই দেখা যায়নি এই পাশ থেকে। 

যাইহোক, এবারে বাড়ির পেছনের অংশ ঘুরে দেখবার পালা। ভবনের ভেতর দিয়েই সেখানে যাওয়ার একটি পথ রয়েছে। সেইপথ ধরতেই দেখা মিলল সাদা কলামের। সাদা সেসব কলামের পলেস্তরা খসে পড়ে দৃশ্যমান হয়ে আছে লাল ইটগুলো। আরেকটু সামনে বাড়লাম, কক্ষগুলোর ভেতরে তাকাতেই দেখলাম সেখানে রসুন, পিয়াজ, আদা, পানসহ বিভিন্ন পণ্যের আড়ৎ, মুদি দোকান। 

সেই পথ ধরে বাড়ির অন্য অংশে আসতেই প্রথমে চোখ গেল দুইটি বোর্ডের দিকে। সেখানে লেখা, ‘এতদ্বার্থে সর্বসাধারণের অবগতির জন্য জানানো যাইতেছে যে, ১১নং ফরাশগঞ্জ রোড স্থিত ‘জামাল হাউজ’ বাড়ীটি একখানা নালিশী সম্পত্তি। বর্তমানে ইহার মালিকানা লইয়া মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট আপিল ডিভিশনে একখানা মামলা চলমান রহিয়াছে…’। আর দোতলায় ঝুলানো অন্য একটি বোর্ড লেখা, ‘রূপলাল হাউজ আবাসিক এলাকা।’ তার নিচেই লেখা আছে, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী’। 

সেখানে গড়ে উঠা সব দোকানের ফাঁক-ফোকর দিয়েই চোখদুটো প্রকাণ্ড সেই ভবনের সৌন্দর্য উপভোগ করছিল। 
ডরিক কলামগুলোর চূড়ায় খোদাই করা কারুকাজ দেখে মুগ্ধ হবেন যে কেউই। ভবনের সামনের অংশ থেকে পেছনের অংশে আসার সেই পথের উপরেই রয়েছে দোতলা জুড়ে দোচালা একটি ঘর। আর রঙবেরঙের কাঁচগুলো এখনও শোভা পাচ্ছে ভবনটির জানালায়। সেসব দেখা শেষে ভবনের ভেতরের অংশে যেতে পা বাড়াতেই একজন বৃদ্ধ এসে জানালেন, ‘ভেতরে যাওয়া নিষেধ।’ 

বেশ কয়েকবার অনুরোধের পর অনুমতি মিলল ভেতরে ঘুরে দেখার। কিন্তু, উপরে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা এখনও বিদ্ধমানই থাকল। শ্যাতশ্যাতে দেয়ালের মাঝ দিয়ে সামনে যেতেই দেখা মিলল ঘরের ভেতরে একটি ছোট্ট আঙিনার। আঙিনার চারদিকের ছোট ছোট জানালয় ঝুলছে ভেজা কাপড়চোপড়। শ্যাতশ্যাতে দেয়ালগুলো দখল করে আছে আগাছা। 

লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে আবারও উপরে যাওয়ার অনুমতি চাইলাম। এবারে একপ্রকার বাধ্য হয়েই অনুমতি দিলেন সেই বৃদ্ধ। কাঠের সিঁড়ি ভেঙে দ্বিতল ভবনের ছাদে উঠে যেতেই প্রাণ জুড়ে গেল। ছাদ থেকে এই ভবনের ‘ই’ আকৃতির ভূমির কিছুটা বোঝা যায়। দেখা যায় প্রায় কোরিন্থিয়ান ধারায় খাঁজ কাটা সুউচ্চ স্তম্ভমালার উপর স্থাপিত বিশাল একটি ছাদ এবং এর উপরে আছে রেনেসাঁ যুগীয় বৈশিষ্ট্যমন্ডিত পেডিমেন্ট। নেমে আসতে আসতে বলঘরটি ঘুরে দেখার ইচ্ছা যে হয়নি, তা কিন্তু নয়। কিন্তু, সেখানে নিয়ে যেতে একবারেই অমত দিলেন সেই বৃদ্ধ।
পিনপতন নিরব রূপলাল হাউজ থেকে বের হতেই বাইরের কোলাহল অনেকটা কর্কশই হয়ে ধরা দিল। চারদিকে কুলির হাঁকডাক, ক্রেতার দরদাম, বিক্রেতার ব্যবসা সামলানো- সব মিলিয়ে তুমুল ব্যস্ত পরিবেশ। প্রতি মুহূর্তে সারিবদ্ধ ট্রাক থেকে লোড-আনলোড হচ্ছে মালামাল। এই সব কিছুর মধ্যেই যেন চাপা পড়ে গেছে এক সময়ের বিখ্যাত ‘রূপলাল হাউজ’। 

লেখক: সাংবাদিক

Link copied!