কফি হাউস। নামটা শুনলেই মানসপটে ভেসে ওঠে একটি চিত্রনাট্য। আর এই চিত্রনাট্য যাকে ঘিরে তৈরি তার নাম ও ছবিও ভেসে ওঠে মনের পর্দায়। ধ্রুপদী সঙ্গীত থেকে বাংলা আধুনিক গান, ভক্তিগীতি, কীর্তন কিংবা কবিগান, কীর্তন, এমনকি রবীন্দ্র সংগীত ও নজরুল গীতি --বাংলা গানের জগতের সব শাখাতেই রয়েছে তার স্পর্শ। তার সুরের মূর্ছনায় দেশের ভৌগলিক সীমানা ছাড়িয়েও শ্রোতারা আচ্ছন্ন ছিল, আছে ও থাকবে। তিনি আর কেউ নন, ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী মান্না দে, বাঙালি তথা উপমহাদেশের গর্ব, আবেগ ও ভালোবাসার এক অন্য নাম।
ইংরেজ শাসনামলে ভারতের কলকাতায় জন্ম যে ছেলেটির নাম ছিল প্রবোধ চন্দ্র দে, তিনিই আজকের জগতখ্যাত মান্না দে। কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলিজিয়েট স্কুল ও স্কটিশ চার্চ কলেজে শিক্ষালাভ করেছিলেন। সেই খুদে বালকটিই যে একদিন সংগীত জগতের একজন ভার্সেটাইল শিল্পী হিসেবে আলো ছড়াবেন, কেইবা জানতো! তার গান যেনো আয়নায় দেখা বাস্তব জীবনেরই প্রতিচ্ছবি।
আমাদের বাস্তব জীবনে প্রেম, ভালবাসা, স্নেহ, ভক্তি, বন্ধুত্ব, উন্মাদনা সবরকম অনুভূতির প্রকাশই আমরা তার গাওয়া গানগুলির মধ্যে পেয়ে থাকি। প্রতিভার কোনো সীমা ছিল না মান্না দের। কাওয়ালি, গজল, ক্লাসিকাল, সেমিক্লাসিক্যাল, আধুনিক, রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল গীতি শ্রোতাদের মন জয় করেছেন। এমনকি রক এন্ড রোলসহ সব রকম গানেই ছিলেন সমান পারদর্শী। শুধু বাংলায় নয় তিনি হিন্দি, মারাঠি, ভোজপুরি, পাঞ্জাবি, ওড়িয়া, সিন্ধি, নেপালি, অসমি, কোঙ্কনি, গুজরাটি, মাগধী, মালয়ালম ইত্যাদি ভাষায়ও গান গেয়েছেন।
১৯৪৩ সালের ঘটনা। তামান্না ছবিতে ভারতীয় চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ও সংগীত শিল্পী সুরাইয়ার সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে গান গেয়ে দারুন পরিচিত পান। ১৯৫০ সালে মুক্তি পাওয়া ‘মশাল’ ছবিতে শচীন দেব বর্মণের গীত রচনায় ‘ওপার গগন বিশাল’ নামে একক গান পরিবেশন করেন। তারপর আর থেমে থাকেননি তিনি। দীর্ঘ সাত দশক ধরে বিভিন্ন ভাষায় গান গেয়ে মুগ্ধ করেছেন, এখনও করে চলেছেন কোটি কোটি শ্রোতাকে।
১৯৬৯ সালের ঘটনা। ওই বছর মুক্তি পায় আশুতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘তিন ভুবনের পারে’ চলচ্চিত্র। এই ছবিতে মান্না দের কন্ঠে গাওয়া ‘আবার হবে তো দেখা’ কিংবা ‘জীবনে কি পাবো না’ গান দুটি প্রেমের অসম্ভব আবেগময়ী বক্তব্যকে যেনো বাস্তবের মতোও রূপ দেয়। শুধু প্রেম নয়, জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারফেক্ট অলংকার হিসেবে গানটিকে সামনে আনা যায়।
রোমান্টিক বাংলা চলচ্চিত্রের নায়ক হিসেবে উত্তম কুমারের পরেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে বিবেচনা করা হয়। এই সৌমিত্র ও তনুজার (বলিউড অভিনেত্রী কাজলের মা) ঠোঁটে মেলানো ‘হয়তো তোমারই জন্য’ গানটি প্রেমিক বাঙালির হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা আর রোমান্টিসিজমের ভাবনার মধ্যে সবার উপরের দিকে থাকবে।
সৌমিত্র-তনুজা জুটির ওপর দৃশ্যায়িত এই গানটি অনাদিকাল ধরে বাঙালি প্রেমিক-প্রেমিকাদের স্মার্ট চয়েজ হয়ে রয়েছে। প্রেমিকেরা তাদের প্রেমিকাদের মান ভাঙ্গাতে বা তাদের মধ্যকার ভালবাসা দৃঢ় করতে মান্না দে’র এই গানটি যে কতবার শুনিয়েছে তার পরিসংখ্যান হয়তো নেই।
গান গাওয়ার ফলাফল যে সবসময় ইতিবাচক বা মধুর হয়েছে এমনটিও নয়। তারপরেও এমন রোমান্টিক বাংলা গান খুব কমই আছে বলে সংগীতবোদ্ধারা মনে করে থাকেন।
সারাজীবন গেয়েছেন মান্না দে। গানে খুঁজতে চেয়েছেন বৈচিত্র্য, সুরের রং, ঢং ও নাটকীয়তা। তিনি যেমন গান গেয়ে শ্রোতাদের নাচিয়েছেন, তেমনি একই কন্ঠে বিরহের গান গেয়ে তাদের কাঁদিয়েছেনও। এমনই একটি গান হল, “সে আমার ছোট বোন বড়ো আদরের ছোট বোন।” এই গানটি শুনলে আজও শ্রোতাদের ও দর্শকদের চোখ থেকে পানি চলে আসে। স্নেহ, মায়া মমতা ভালোবাসার এক অসামান্য মেলাবন্ধন এই গানটি।
বেঁচে ছিলেন ৯৪ বছর বয়স পর্যন্ত। এই দীর্ঘ সময়ে মাত্র ৪ হাজারের মতো গান গেয়েছেন। সব গানই শ্রোতাপ্রিয়। তার সময়টাতে মোহাম্মদ রফি, কিশোর কুমার, মুকেশ চন্দ্র মাথুর ছিলেন খুবই জনপ্রিয় শিল্পী। হিন্দি ছবির গানে কণ্ঠ দিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদেরই ডাকতেন সংগীত পরিচালক ও সুরকাররা। এদের জনপ্রিয়তা যখন তু্ঙ্গে, ওই সময় নিজের জন্য আলাদা ও টেকসই জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করা তার জন্য ভীষণ চ্যালেঞ্জের ছিল। আর তিনি এই চ্যালেঞ্জে দারুনভাবেই সফল হয়েছিলেন। তাদের মতোই সমানে সমান জনপ্রিয় ছিলেন মান্না দে।
হিন্দি চিলচ্চিত্রে তাকে কম ডাকা হতো, ব্যাপারটি মান্না দে-ও জানতেন। বিষয়টি নিজের আত্মজীবনী ‘আমি নিরালায় বসে’ বইয়ে তিনি জানিয়ে গিয়েছেন। সেখানে তিনি লেখেন, “শ্রোতারা আমাকে অত্যন্ত ভালোবাসেন বলেই এমন মনে হয়, আমি বেশি গান গাইবার সুযোগ পাইনি। আমার নিজের তো ধারণা আমি আমার যোগ্যতার অনেক বেশি পেয়েছি-মানুষের এতো স্বীকৃতি, এত ভালবাসা।”
তারপরেও জাত শিল্পী ও রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে এক ধরণের খারাপ লাগা তার মধ্যে বিরাজ করছিল। মান্না দে’র আত্মজীবনী ঘাটলে আমরা তারও প্রমাণ পাই। ‘আমি নিরালায় বসে’ বইয়ের এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, “প্রতিভা থাকাটাই বোধহয় প্রতিষ্ঠা পাওয়ার শেষ কথা নয়। যোগাযোগ এবং সেই সঙ্গে কমার্শিয়াল অ্যাটিচুড থাকাটাও বোধহয় প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য অবশ্যই একটা মেজর ফ্যাক্টর।”
সংগীত নিয়ে পথ চলার দীর্ঘ ইনিংসে তিনি হয়তো অনেক গান গেয়ে যেতে পারেননি। আরও কয়েক হাজার গান তার কাছ থেকে শ্রোতারা হয়তো পেতে পারতেন। তা নিয়ে শ্রোতাদের আক্ষেপ হয়তো নেই, তবে যেসব গান গেয়ে হিমালয় সমান সফলতা পেয়েছেন, তা হয়তোবা অনেক বিখ্যাত শিল্পীও পাবেন না। তাইতো হিন্দি চলচ্চিত্রের মেগাস্টার প্লেব্যাক সিংগার মোহাম্মদ রফি একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “আপনারা আমার গান শোনেন, আর আমি শুধু শুনি মান্না দের গান।”
মান্না দে’কে বলা হয়ে থাকে ‘একটি প্রতিষ্ঠান’। বর্তমান সময়ে স্টেজে গান গাইবার সময় শিল্পীরা গীতিকার ও সুরকারদের নাম বলে তাদের শ্রদ্ধা জানিয়ে থাকেন। এই রীতি প্রচলন করেন মান্না দে। মান্না দে-ই প্রথম শিল্পী যিনি তাঁর স্টেজ শোগুলোতে কোনও গান গাইবার আগে সেই গানের গীতিকার-সুরকারের কথা নিয়ম করে উল্লেখ করতেন। এটা মান্না দে'র আগে ঠিক কেউ করেননি।
বর্ণাঢ্য সঙ্গীত জীবনে মান্না দে ভারতের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের ‘পদ্মশ্রী’, ‘পদ্ম ভূষণ’ ও ‘পদ্ম বিভুষণ’ সম্মাননা পেয়েছেন। এছাড়া সিনেমা জগতে ভারতের সর্বোচ্চ সম্মাননা দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি।
এছাড়া তিনি দুইবার ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, সাতবার বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট’স অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ড, একবার ফিল্মফেয়ার এবং ফিল্মফেয়ারে আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন।
যুগের পরিবর্তনের সাথে বাঙালি অনেক অভ্যাস বাদ দিলেও তাদের গান শোনা আর আড্ডা দেওয়ার অভ্যাসটা এখনও অটুট রয়েছে। তাইতো বেঁচে আছে কলকাতার বই পাড়ার সেই কফি হাউসের আড্ডাটা। কফি হাউসের আড্ডা আছে, নেই শুধু মান্না দে। মাত্র ৮ বছর আগের এই দিনে (১৯১৩ সালের ২৪ অক্টোবর) না ফেরার দেশে চলে গেলেও সংগীতাকাশে তিনি এখনও ধ্রুবতারা হয়ে আছেন।