ছবি: সংগৃহীত
যুদ্ধভূমি যখন ফুটবল মাঠ, আর সমরনায়ক যখন ডেক্লান রাইস —তখন গল্পটা আর কেবল খেলা থাকে না, তা রূপ নেয় এক মহাকাব্যে। ইউরোপের চ্যাম্পিয়নস লিগ মঞ্চ, এমিরেটস স্টেডিয়াম আর ৬০ হাজার গর্জে ওঠা গনার্স সমর্থক—সব মিলিয়ে এক রূপকথার আবহ। আর সেই রূপকথার নায়ক –ডেক্লান রাইস।
যেমন কুরুক্ষেত্রে অর্জুন দাঁড়িয়ে লক্ষভেদ করেছিলেন, তেমনই এমিরেটসের আলোঝলমলে রাত্রিতে দাঁড়িয়ে রাইস নিজের ধ্যানস্থ চোখে দেখেছিলেন প্রতিপক্ষ দেয়ালের ফাঁক। প্রথমবার, ৫৮ মিনিটে —বাঁ পায়ের কার্লে বল ছুঁয়ে গেল রিয়াল দেয়াল, থিবো কোর্তোয়ার গ্লাভস ছোঁয়ানোর আগেই ইতিহাসে ঢুকে পড়ল।
দ্বিতীয়বার, ৭০ মিনিটে —যেন এক পুনরাবৃত্তি, আবারও সময় স্থির, নিশানা নিখুঁত। আর তখনই রচিত হলো এক ঐতিহাসিক অধ্যায়: চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে প্রথমবার কোনো খেলোয়াড় নকআউট ম্যাচে দুইটি ফ্রি-কিক গোল করল।
৩৩৮টি ম্যাচেও কোনো ফ্রি-কিক গোল নেই যার! সেই রাইস মঙ্গলবার রাতে ৩৩৯তম ম্যাচেই দুইটি দুর্দান্ত ফ্রি-কিক গোলে স্তব্ধ করে দিলেন ইউরোপীয় ফুটবলের অন্যতম শক্তিশালী দল রিয়াল মাদ্রিদকে। আর ফলাফল—আর্সেনালের ৩-০ গোলের জয়, চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে তাদের অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স।
এই রাতের নাম লেখা থাকবে আর্সেনালের মহাকাব্যে, আর রাইস —এক নতুন যুগের মহাকাব্যিক নায়ক।
ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন রাইস
প্রথমার্ধে আর্সেনাল দাপট দেখালেও গোলের দেখা পাচ্ছিল না। রিয়ালও কিছু মুহূর্তে হুমকি তৈরি করেছিল, কিন্তু গোলরক্ষক ডেভিড রায়া ছিলেন অটল। দ্বিতীয়ার্ধে এসে বদলে গেল সব। ৫৮ মিনিটে ডান পায়ের কার্লে রাইস বল তুলে দিলেন কোর্তোয়ার বাঁ পাশে জালে। স্টেডিয়াম যেন বিস্ফোরিত হলো।
১২ মিনিট পর আবার রাইস। এবার একটু দূর থেকে, একটু বেশি কৌণিক জায়গা। কিন্তু একই গল্প—কার্ল, স্পিন, গোল। বল ছুঁয়ে গেল কিপারের হাতের ওপর দিয়ে পোস্টের কোনা। ওডেগার্ডের চোখে জল, আর্তেতার অবিশ্বাস!
চ্যাম্পিয়নস লিগের কোনো নকআউট ম্যাচে দুইটি ফ্রি-কিক গোল? এটা প্রথম। আর সেটাই করলেন এক এমন খেলোয়াড়, যার ফ্রি-কিক নেওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল হাতে গোনা!
জয়সূচক তৃতীয় গোল ও আর্তেতার মাস্টারক্লাস
৮৩ মিনিটে তৃতীয় গোলটি করে ব্যবধান নিশ্চিত করেন মিকেল মেরিনো, যিনি বদলি হিসেবে নেমে এসেই প্রতিপক্ষের রক্ষণকে ভেঙে দিলেন। ওডেগার্ডের নিখুঁত পাস আর মেরিনোর ফিনিশিং মিলিয়ে স্কোরলাইন দাঁড়ায় ৩-০।
আর্তেতা ম্যাচপরে বলেন, “আজকের রাত শুধু আর্সেনালের জন্য না, ইংলিশ ফুটবলের জন্যও গর্বের। রাইস? ওর মধ্যে নেতৃত্ব, সাহস আর আত্মবিশ্বাস—সব আছে।”
রিয়াল মাদ্রিদের হতাশা ও সমর্থকদের উচ্ছ্বাস
মাদ্রিদের দলে ছিলেন এমবাপ্পে, বেলিংহ্যাম, ভিনিসিউসের মতো তারকা। কিন্তু পুরো সময়টাই তারা যেন ছায়া হয়ে ছিলেন।
দর্শক সাঁড়িতে ছিলেন ব্রাজিল ও রিয়াল মাদ্রিদের কিংবদন্তি খেলোয়াড় রবার্তো কার্লোস। ক্যামেরার ফ্রেমে কার্লোসকে ধরতেই ধারাভাষ্যকার বলেন, ১৯৯৭ সালে ফ্রান্সের বিপক্ষে ব্রাজিল কিংবদন্তির সেই অবিস্মরণীয় ফ্রি কিকের চেয়ে রাইসের শট বেশি বেঁকেছে কি না, তা নিয়ে আলোচনা হবে।
আর্সেনাল সমর্থকরা খেলা শেষে গাইলেন ক্লাব অ্যানথেম। স্টেডিয়াম ছাড়ার সময় কেউ কেউ কাঁদছিল খুশিতে। ২০০৬ সালের পর চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল এতটা কাছে এসেছে—এটা তারা জানেন।
“ঐতিহাসিক রাত”
খেলা শেষে ১২ মিনিটের মধ্যে জোড়া ‘বজ্রপাতে’ রিয়ালকে পুড়িয়ে ফেলা রাইস আমাজন প্রাইমকে বলেছেন, ‘আমি জানি না এই ঘোর কাটবে কি না। ফ্রি–কিক থেকে প্রথম গোল করা ম্যাচটি এমনিতেই বিশেষ কিছু। দ্বিতীয়টি যখন পেলাম...আত্মবিশ্বাস ছিল। সত্যি বলতে, আমি ভাষাহীন। আমি শুধু বলবো—এটা একটা ঐতিহাসিক রাত।”
পরবর্তী লেগে কী হবে?
রিয়াল মাদ্রিদ কখনোই হাল ছাড়ে না। সান্তিয়াগো বার্নাবেউয়ে ফিরতি লেগে তারা চেষ্টা করবে ঘুরে দাঁড়াতে। তবে এই ৩-০ গোলের লিড এখন আর্সেনালের। আর যদি এমিরেটসের এই পারফরম্যান্সের ছায়া সেখানে দেখা যায়, তাহলে ইতিহাস নতুন করে লেখা হতে চলেছে।
এই ছিল এক রাতের মহাকাব্য —রাইসের বাঁ পায়ের কার্লে লেখা হল সাহস, আত্মবিশ্বাস, আর বিজয়ের গান। এমিরেটসে রাত্রির বাতাসে এখনো হয়তো ভেসে বেড়াচ্ছে সেই শব্দ— “গোল!!”