জুলাই ৮, ২০২৫, ০১:১০ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
ভবিষ্যতে রাজনীতিতে যোগ দিতে অথবা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে কি আপনি আগ্রহী, এমন প্রশ্নের জবাবে ৮২ দশমিক ৭ শতাংশ তরুণ বলেছেন, তারা আগ্রহী নন।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) ও একশনএইডের একটি জরিপে তরুণদের এই মনোভাব উঠে এসেছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তরুণদের ভাবনা-সম্পর্কিত এই জরিপ গতকাল সোমবার প্রকাশ করা হয়।
জরিপে ৩৪ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, দেশের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তরুণদের সংযোগ ‘অকার্যকর’ বলে মনে করেন তারা। আর এই সংযোগ ‘খুবই অকার্যকর’ বলে মনে করেন ১৬ দশমিক ১ শতাংশ উত্তরদাতা।
তরুণদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর করণীয় বিষয়ে জরিপে কিছু মত দিয়েছেন উত্তরদাতারা। এগুলো হলো যুব বা ছাত্র নেতৃত্বাধীন শাখাগুলোর সংযোগসংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন। দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তরুণদের অনুপাত বাড়ানো। প্রান্তিক যুবসমাজের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। দলের এজেন্ডায় যুবকেন্দ্রিক আরও বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্ততা বাড়ানো।
জরিপে কারা অংশ নিয়েছেন
গতকাল রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে বলা হয়, গত ২০ মে থেকে ৩১ মে পর্যন্ত মিশ্র পদ্ধতিতে জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এটি ছিল পরিমাণগত জরিপ ও গুণগত সাক্ষাৎকার। আগামী অক্টোবর-নভেম্বরে ‘ফলোআপ’ জরিপ পরিচালনা করা হবে।
পরিমাণগত জরিপে ‘টার্গেট গ্রুপ’ ছিলেন ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণেরা। ২ হাজার তরুণ (নারী ও পুরুষ) জরিপে অংশ নেন। গ্রাম-নগর ও নারী-পুরুষের অনুপাত ছিল ৫০: ৫০। এ ছাড়া জরিপে অন্তত ১০ শতাংশ অমুসলিম প্রতিনিধিত্ব ছিল। দেশের আট বিভাগে—প্রতি বিভাগের দুটি জেলা ও প্রতিটি জেলার দুটি উপজেলায় জরিপটি পরিচালিত হয়।
গুণগত সাক্ষাৎকারের ক্ষেত্রে ছিল ১৭টি কেস স্টাডি। এতে আট বিভাগে বিভিন্ন পেশা, ধর্ম ও আকাঙ্ক্ষার মানুষের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। প্রতিটি বিভাগ থেকে অন্তত দুটি কেস স্টাডি নেওয়া হয়েছে।
নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার বিষয়ে আশাবাদ
জরিপে আগামী নির্বাচন নিয়ে তরুণদের মতামত জানতে চাওয়া হয়। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে বলে আপনি কতটা আত্মবিশ্বাসী, এমন প্রশ্নে ৪০ দশমিক ৮৯ শতাংশ উত্তরদাতা মোটামুটি আশাবাদের কথা বলেছেন। খুবই আশাবাদী ২৭ দশমিক ৯১ শতাংশ উত্তরদাতা। আর পুরোপুরি আশাবাদী ১১ দশমিক ৯৩ শতাংশ উত্তরদাতা। ৬ শতাংশ উত্তরদাতা মোটেও আশাবাদী নন।
প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়ে তারুণ্যনির্ভর দলগুলোর মাধ্যমে রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসার বিষয়ে কি আপনি আশাবাদী, এমন প্রশ্নে ৪২ দশমিক ১৪ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তাঁরা আশাবাদী। ৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, খুবই আশাবাদী। অর্থাৎ প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়ে তারুণ্যনির্ভর দলগুলোর মাধ্যমে রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসার বিষয়ে প্রায় অর্ধেক উত্তরদাতা আশাবাদী।
বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কী? এই প্রশ্নে ৫৬ শতাংশ ৪ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, সংস্কারের মাধ্যমে এটি ধীরে ধীরে উন্নত হতে পারে। সংস্কার হোক বা না হোক, এটা একই রকম থাকবে বলে মনে করেন ১৩ দশমিক ১ শতাংশ উত্তরদাতা।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চার উন্নতি হবে, এ বিষয়ে আপনি কতটা একমত, এমন প্রশ্নে ৩৮ দশমিক ২৪ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তারা কিছুটা উন্নতির সম্ভাবনা দেখেন। অবশ্যই উন্নতি হবে বলে মনে করেন ১০ দশমিক ৪৩ শতাংশ উত্তরদাতা। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক উত্তরদাতা মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চার উন্নতি হবে।
দেশ ও তরুণদের আরও ভালো সেবা দেওয়ার জন্য আপনি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে কী ধরনের সংস্কার আশা করেন, এই প্রশ্নে ৬০ শতাংশ উত্তরদাতা পৃষ্ঠপোষকতা, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক সহিংসতার অবসানের কথা বলেছেন। নিয়মিত অভ্যন্তরীণ নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক কাঠামোর কথা বলেছেন, ৫৪ শতাংশ উত্তরদাতা। ব্যক্তি বা উত্তরাধিকারের রাজনীতির চেয়ে নীতিভিত্তিক রাজনীতির পক্ষে মত দিয়েছেন ৫২ দশমিক ৭ শতাংশ উত্তরদাতা। দলীয় তহবিল ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতার কথা বলেছেন ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশ উত্তরদাতা। এ ছাড়া ৪৩ দশমিক ৬ শতাংশ উত্তরদাতা দলগুলোর নেতৃত্বের পর্যায়ে আরও বেশি তরুণ ও নারীদের অন্তর্ভুক্তির পক্ষে বলেছেন।
জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, দেশের জাতীয় রাজনীতি সম্পর্কে একেবারেই সচেতনতা নেই ১৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ পুরুষ ও ২৪ দশমিক ২৭ শতাংশ নারী উত্তরদাতার। আঞ্চলিক রাজনীতি সম্পর্কে একেবারেই ধারণা নেই ১২ দশমিক ৩৮ শতাংশ পুরুষ ও ১৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ নারী উত্তরদাতার।
জরিপ বলছে, ৮৭ দশমিক ৪ শতাংশ উত্তরদাতা সাধারণত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে পান। ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ উত্তরদাতা টেলিভিশন, ১৩ শতাংশ সংবাদপত্র ও ১ দশমিক ৪ শতাংশ রেডিওর কথা বলেছেন।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিষয়ে মতামত
ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিষয়ে জরিপে মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল। প্রশ্ন ছিল, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য সহায়ক বলে মনে করেন কি না—এই প্রশ্নে ৪৮ দশমিক ২৩ শতাংশ উত্তরদাতা ‘হ্যাঁ’ সূচক উত্তর দিয়েছেন। ‘না’ সূচক উত্তর দিয়েছেন ৫১ দশমিক ৭৭ শতাংশ উত্তরদাতা। মুসলমানদের মধ্যে ৫৮ দশমিক ১৪ শতাংশ এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ১২ দশমিক ২৩ শতাংশ উত্তরদাতা ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে দেশের উন্নয়নের জন্য সহায়ক মনে করেন। আর এমনটা মনে করেন না মুসলমানদের মধ্যে ৪১ দশমিক ৮৬ শতাংশ উত্তরদাতা এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ৮৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ উত্তরদাতা।
জরিপে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি নিয়ে আপনি কতটা উদ্বিগ্ন? ৩৮ দশমিক ৩ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তাঁরা উদ্বিগ্ন। খুবই উদ্বিগ্ন ৮ দশমিক ৯ শতাংশ উত্তরদাতা। আর কখনো কখনো উদ্বিগ্ন বা নিরপেক্ষ ৩০ শতাংশ উত্তরদাতা।
কত দিন পর বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি? এমন প্রশ্নে ২২ দশমিক ৮ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল কখনোই ক্ষমতায় আসবে না। পাঁচ বছরের মধ্যে ধর্মভিত্তিক দল ক্ষমতায় আসবে বলে মনে করেন ১১ দশমিক ৬ শতাংশ উত্তরদাতা। ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে ক্ষমতায় আসতে পারে বলে মনে করেন ১২ দশমিক ২ শতাংশ উত্তরদাতা। আর ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা দেখেন ১৪ দশমিক ১ শতাংশ উত্তরদাতা।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মানুষ নিরাপদ বলে বিশ্বাস করেন কি না, এই প্রশ্নে ৭৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ উত্তরদাতা ‘হ্যাঁ’ বলেছেন। মুসলমানদের মধ্যে ৮৪ শতাংশ উত্তরদাতা আর অন্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ৪৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মানুষ নিরাপদ।
বর্তমানে মানুষ ভয় বা কোনো বিধিনিষেধ ছাড়াই নিজেদের ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন ও নিরাপদ কি না? এমন প্রশ্নে ৩৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন ‘খুবই নিরাপদ’। ২৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন ‘নিরাপদ’। মুসলমানদের মধ্যে ৪৩ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, ‘খুবই নিরাপদ’। আর ৩২ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন ‘নিরাপদ’। তবে অন্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ৩৯ দশমিক ২১ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, বর্তমানে মানুষ ভয় বা কোনো বিধিনিষেধ ছাড়াই নিজেদের ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন ও নিরাপদ নন। আর ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তারা ‘খুবই অনিরাপদ’।