জুন ২৩, ২০২২, ১১:৫০ পিএম
পদ্মা সেতুর প্রাক্-সম্ভাব্যতা যাচাই হয় দেশীয় অর্থায়নে। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা নদীতে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ১৯৯৯ সালের মে মাসে পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য প্রাক্-সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা (প্রি-ফিজিবিলিটি স্টাডি) শুরু হয়। বলা যায়, এটাই দালিলিকভাবে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের প্রথম সূত্রপাত। এ হিসেবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের যাত্রা প্রায় দুই যুগের।
এরপর ২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রাক্-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে আরপিটি-নেডকো-বিসিএল নামের যৌথ উদ্যোগের একটি প্রতিষ্ঠান। তারা ১৯৯৯ সালের মে থেকে ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কাজ করে প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিষ্ঠানটি পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া এবং মাওয়া-জাজিরা—এ দুটি পথ দিয়ে সেতু নির্মাণের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে।
প্রকল্প অনুমোদনই করতে পারেনি বিএনপি
জাপানের আন্তর্জাতিক সংস্থা জাইকার অর্থায়নে ২০০৩ সালের মে থেকে তৎকালীন সরকারের সময়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষার কাজ শুরু হয়। সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা শেষ হয়েছিল ২০০৫ সালে। পরের বছর ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশগত প্রভাব মোকাবিলায় করণীয় নিয়ে পরিকল্পনা করা হয়। সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষার সময় জাপানি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিপ্পন কোই সেতুর একটি প্রাথমিক নকশা তৈরি করে। তবে তারা জানিয়ে দেয় যে সেতু নির্মাণের আগে পূর্ণাঙ্গ নকশা প্রণয়ন করতে হবে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার। এতে মোট ব্যয় ধরা হয় ৮ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা। ২০০৫ সালের ১৯ অক্টোবর ডিপিপি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। তবে তখনকার সরকার ডিপিপি অনুমোদন করে যেতে পারেনি।
চূড়ান্ত পরামর্শক নিয়োগে আটকেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার
পদ্মা সেতুর বিশদ নকশা প্রণয়ণে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগে ২০০৭ সালে দরপত্র আহ্বান করে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ওই বছর আগস্টে পদ্মা সেতু নির্মাণে একটি ডিপিপি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন পায়। এতে ব্যয় ধরা হয় ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। ডিপিপিতে ২০১৫ সালের মধ্যে সেতু নির্মাণের লক্ষ্য ঠিক করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বাছাইয়ের কাজটি চূড়ান্ত করলেও নিয়োগ দিতে পারেনি।
প্রাক্-সম্ভাব্যতা ও সম্ভাব্যতা যাচাই কেন করতে হয়, সেই কৌতূহল জাগতে পারে। বিষয়টি অনেকটা এরকম:
১. পদ্মা নদীতে সেতু কেন দরকার
২. নির্মাণে ব্যয় কত হতে পারে
৩. কোন জায়গায় সেতু নির্মাণ করলে ব্যয় কম হবে
৪. সেতু নির্মাণে বিনিয়োগ অর্থনৈতিকভাবে কতটা যৌক্তিক হবে।
সমীক্ষায় এসব বিষয় পর্যালোচনা করা হয়। এরপর সেতু নির্মাণের বিষয়ে প্রস্তাব দেয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। দেখা যায়, মাওয়া-জাজিরা এবং পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ— এই দুই পথেই মূল সেতুর দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে ৬ কিলোমিটারের কিছু বেশি। তবে মাওয়া প্রান্তে নদীর তীর স্থিতিশীল। এ কারণে নদীশাসনে ব্যয় কম পড়বে। তারা দেখায় যে পাটুরিয়ার তুলনায় মাওয়া দিয়ে সেতু নির্মাণ করা হলে যাতায়াত খরচ কমবে, পুনর্বাসনে ব্যয় কম হবে এবং নদীশাসন সহজ হবে। প্রক্ষেপণ অনুসারে, মাওয়া-জাজিরা দিয়ে সেতু নির্মিত হলে যানবাহন বেশি চলবে।
ক্ষমতায় এসেই পদ্মা সেতু নিয়ে ভাবনা
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয় লাভ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। এ সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের ১৩ দিনের মাথায় ২০০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি সেতুর নকশা প্রণয়ণে পরামর্শক নিয়াগ প্রস্তাব অনুমোদন পায়। যুক্তরাষ্ট্র-নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান MAUNSEL-AECOM-এর সঙ্গে এ সংক্রান্ত চুক্তি সই হয়। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে কাজ শুরু করে। তারা ১৮ মাসের মধ্যে সেতুর বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন, প্রি-কোয়ালিফিকেশন ডক্যুমেন্ট ও মূল টেন্ডার ডক্যুমেন্ট প্রণয়ন ও পরিচালনা করে।
ওই সময় পদ্মাসেতুতে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। সেতু বিভাগের নিজস্ব প্রকৌশলী এবং সড়ক ও জনপথ অধিদফতর থেকে অভিজ্ঞ কিছু প্রকৌশলী পদ্মাসেতু প্রকল্পে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেতুর গুরুত্ব ও ব্যাপকতার কারণে কাজ তদারকি ও পরামর্শের জন্য দেশি-বিদেশী ১১ জন বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে গঠন করা হয় এক্সপার্ট প্যানেল। ওই প্যানেলের প্রধান ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ও বিশেষজ্ঞ প্রয়াত অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী।
ওই সময় পদ্মাসেতুর চার লেনের সড়কপথের নকশা ডেনমার্কের একটি সেতুর আদলে ডাবল-ডেক করার সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। এই নকশায় ওপরে রয়েছে চার লেন সড়ক পথম নিচে সিংগেল লাইন রেলপথ। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে পদ্মাসেতুর সংশোধিত ডিপিপি একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। নতুন নকশা অনুযায়ী প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা।
ওই বছরই বিশ্বব্যাংকের কাছে বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতির অভিযোগ যায়। অভিযোগের তীর তখনকার যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে। একপর্যায়ে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়। এসময় বিশ্বব্যাংকে ফেরাতে সরকার প্রায় দেড় বছর বছর চেষ্টা চালায়। এজন্য বিশ্বব্যাংকের শর্ত অনুযায়ী তখনকার সেতু সচিব ও একজন প্রকৌশলীকে দুনীতি দমন কমিশনের (দুদক) নালিশে কারাগারেও নেওয়া হয়। মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয় সৈয়দ আবুল হোসেনকে।
বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে তোলা দুর্নীতির অভিযোগের সুরাহা সহজে হয়নি। উল্টো এই অভিযোগের কারণে আটকে যায় পদ্মাসেতু নির্মাণ প্রকল্প। ২০১২ সালের জুনে বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতুর ঋণ চুক্তি বাতিল করে দেয়।
তারপরও বিশ্বব্যাংকে ফেরাতে সরকার তাদের সব শর্ত মেনে যেতে থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্পে অর্থায়ন না করার বিষয়ে একেবারেই অনড় থাকলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নেন, নিজস্ব অর্থায়নেই হবে পদ্মাসেতু। তবে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের সেই মামলাটিও কানাডার আদালতে প্রমাণ না হওয়ায় খারিজ করে দেওয়া হয়। পদ্মাসেতুকে ঘিরে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ থেকেও মুক্তি পায় বাংলাদেশ।
২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে। এরপর ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজের উদ্বোধন হয়। প্রমত্ত পদ্মাকে বাগে এনে একে একে নদীর বুকের বসতে থাকে পিলার। পিলারগুলো বসতে থাকার পাশাপাশি চলছিল স্প্যান তৈরির কাজ। শেষ পর্যন্ত ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর প্রথম স্প্যানটি বসলে পদ্মার বুকে সড়কপথের প্রথম দেড়শ মিটার দৃশ্যমান হয়। এরপর দেখতে দেখতে তিনটি বছর ধরে মোট ৪২টি পিলার বসেছে, সেই পিলারগুলোর ওপর এখন বসেছে ৪১টি স্প্যান। ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বরে বসে সর্বশেষ স্প্যানটি।
এরমধ্যেই সেতুর শতভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ২০২২ সালের ২৫ জুন উদ্বোধন হচ্ছে বহুল কাঙ্খিত পদ্মা সেতুর। সর্বশেষ ২৬ জুন সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে সেতুটি।