সংসদ সদস্য মির্জা আজম প্রকৌশলী ও চিকিৎসকদের নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, যা নিয়ে প্রতিবাদ-বিবৃতি চলছে, সে বিষয়ে একটি ব্যাখা দিয়েছেন সংসদ সদস্য নিজেই। একটি জাতীয় দৈনিকের কাছে তিনি তার বক্তব্য পরিষ্কার করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, ভিডিওতে তার খণ্ডিত বক্তব্য এসেছে।
এদিকে মির্জা আজমের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ), ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ (আইইবি) ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক সমিতি। অবিলম্বে ওই বক্তব্য প্রত্যাহার এবং দেশের প্রকৌশলী ও চিকিৎসকদের কাছে দুঃখ প্রকাশের জন্য মির্জা আজমের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
চিকিৎসক ও প্রকৌশলীদের দুই সংগঠন ও বুয়েট শিক্ষক সমিতি রবিবার পৃথক পৃথক বিবৃতি দিয়ে এই দাবি জানিয়েছে। বিএমএর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ১৯ জানুয়ারি জামালপুরে একটি সভায় মির্জা আজম বাংলাদেশের চিকিৎসক ও প্রকৌশলীদের ‘চোর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তার এই বক্তব্য অশালীন, আপত্তিকর, মানহানিকর, কল্পনাপ্রসূত ও অবমাননাকর। এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে চিকিৎসক সমাজকে হেয় করা হয়েছে। আর প্রকৌশলীদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান আইইবির বিবৃতিতে তিন দিনের মধ্যে মির্জা আজমকে এই বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
প্রতিবাদের মুখে মির্জা আজম বলেছেন, তিনি সব চিকিৎসক ও প্রকৌশলীকে নিয়ে ওই কথা বলেননি। বুয়েটের ছাত্র–শিক্ষক বা মেডিকেল শিক্ষার্থীদের নিয়েও কিছু বলেননি তিনি। সমাজের সামগ্রিক অবক্ষয় নিয়ে কথা প্রসঙ্গে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রকৌশলী ও চিকিৎসকদের সমালোচনা করেছেন। তবে ‘চোর’ শব্দটা বলাটা তার ঠিক হয়নি।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজমের বক্তব্যের একটি ভিডিও সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে তাকে বুয়েট থেকে পাস করে আসা প্রকৌশলী এবং বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ থেকে লেখাপড়া করে আসা চিকিৎসকদের নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়। তার ভাষ্যমতে, দেশের ‘সবচেয়ে মেধাবী’ শিক্ষার্থীরা বুয়েট–মেডিকেলে ভর্তি হন। কিন্তু সরকারি চাকরিতে আসার পর তারা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
তার এই বক্তব্য নিয়ে শনিবার বুয়েট শিক্ষক সমিতির কার্যনির্বাহী পরিষদের সভা হয়েছে বলে রবিবার এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। শনিবার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের নির্বাহী কমিটির সভায়ও এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।
বুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আবদুল হাসিব চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এ টি এম হাসান জোবায়ের স্বাক্ষরিত ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ১৯ জানুয়ারি জামালপুর জেলা প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিক সমিতির সঙ্গে এক আলোচনায় জামালপুর-৩ আসনের সাংসদ মির্জা আজম বুয়েটের স্নাতক প্রকৌশলী এবং বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকদের চোর সাব্যস্ত করে অত্যন্ত আপত্তিকর বক্তব্য দিয়েছেন। বুয়েট শিক্ষক সমিতি প্রকৌশলী ও চিকিৎসকদের সম্পর্কে মির্জা আজমের এমন অবমাননাকর বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানায়। একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও সাংসদের যেকোনো পেশাজীবী সম্পর্কে এমন ঢালাও মন্তব্য অবমাননাকর ও অগ্রহণযোগ্য। মেধাবীদের সম্পর্কে তিনি যেভাবে বক্তব্য দিয়েছেন, তা কাণ্ডজ্ঞানহীন ও দুর্ভাগ্যজনক।
বিবৃতিতে বলা হয়, দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে প্রকৌশলীদের বিশেষ করে বুয়েটের স্নাতকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বুয়েটের প্রকৌশলীরা শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরেও অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে তাদের পেশাদারি দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বুয়েটের স্নাতক গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সৎ প্রকৌশলী মো. দেলোয়ার হোসেনকে তাঁর সততার জন্য দুর্নীতিবাজদের হাতে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে। সাংসদ মির্জা আজমের ঢালাও মন্তব্য দেশের প্রকৌশলীদের সততা, দক্ষতা ও পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনে নিরুৎসাহিত করবে এবং প্রকৃত দুর্নীতিবাজদের কার্যত আড়াল করবে বলে তাদের আশঙ্কা।
মির্জা আজমকে অবিলম্বে তার বক্তব্য প্রত্যাহার এবং দেশের প্রকৌশলী ও চিকিৎসকদের কাছে দুঃখ প্রকাশের আহ্বান জানিয়েছে বুয়েট শিক্ষক সমিতি। তিন দিনের মধ্যে মির্জা আজম ক্ষমা না চাইলে বৃহত্তর আন্দোলনে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ।
আর বিএমএর সভাপতি মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও মহাসচিব মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘প্রকৌশলী–চিকিৎসকদের কটূক্তি করে মির্জা আজম যে ঔদ্ধত্য দেখিয়েছেন, তা নজিরবিহীন। অসত্য তথ্য দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করার অপপ্রয়াসে তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ ভঙ্গ করেছেন।’
মির্জা আজমের ব্যাখ্যা
প্রকৌশলী ও চিকিৎসকদের প্রতিবাদের প্রেক্ষাপটে মির্জা আজম রবিবার সন্ধ্যায় বলেছেন, ১০–১২ দিন আগে তার নিজের এলাকা জামালপুরে বেসরকারি ক্লিনিক মালিক সমিতির নেতারা এসেছিলেন সনদবিহীন ক্লিনিক বন্ধ করার দাবি নিয়ে। সেখানে বক্তব্যে সমাজের সামগ্রিক দুর্নীতি–অনিয়ম নিয়ে কথা বলার একপর্যায়ে প্রকৌশলী ও চিকিৎসকদের প্রসঙ্গ আসে। সব প্রকৌশলী ও চিকিৎসকদের নিয়েও তিনি ওই সব কথা বলেননি।
মির্জা আজম বলেন, ভিডিওতে তার খণ্ডিত বক্তব্য এসেছে। সমাজের সব পেশায় যেমন জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা, এমনকি কোনো অফিসে গেলে পিয়নকেও টাকা দিতে হয়—এসব নিয়েই তিনি কথা বলেছেন।
এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, বুয়েটের ছাত্র ও শিক্ষকদের উদ্দেশ করে তিনি কিছু বলেননি। সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা প্রকৌশল ও এমবিবিএস পাস করে চাকরিতে এসে যাঁরা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন, তাদের নিয়ে বলেছেন।
মির্জা আজম বলেন, তার জানামতে বর্তমানে সরকারি চাকরিতে যেসব প্রকৌশলী আছেন, তাদের ৮০ শতাংশের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ঠিকাদারেরা কাজ করার পর বিল তুলতে গেলে প্রকৌশলীদের নির্দিষ্ট হারে টাকা দিতে হয়। এসব সমস্যা রয়েছে।
আবার চিকিৎসকদের ক্ষেত্রেও নানা সমস্যা রয়েছে অভিযোগ করে এই সংসদ সদস্য বলেন, তার নির্বাচনী এলাকার একটি হাসপাতালে ২৪ জন চিকিৎসককে নিয়োগ দেওয়া হলেও মাত্র ৫–৬ জন দায়িত্ব পালন করেন। বাকিরা মাসে এক দিন এসে বেতনটা তুলে নিয়ে যান। এটা তো ঠিক নয়, জনগণকে সেবা বঞ্চিত করা হচ্ছে।
মির্জা আজম বলেন, মাদারগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একবার পরিদর্শনে গিয়ে তিনি দেখতে পেয়েছেন ৪০ জন রোগীর দুই বেলার খাবার তৈরি করা হচ্ছে। সেখানে মাত্র দুটি মুরগির মাংস দেওয়া হচ্ছে। পরে তিনি অনিয়মের কারণে খাবার সরবরাহের দায়িত্বে থাকা ঠিকাদারকে সেখান থেকে বিদায় করে দেন।
আবার হাসপাতালের বিছানাপত্র পরিষ্কার করার জন্য প্রতি মাসে বড় অঙ্কের বিল করা হলেও সেগুলো ঠিকমতো পরিষ্কার করা হয় না। হাসপাতালে গিয়ে রোগীদের ময়লা–রক্তমাখা বিছানা দেখতে পাওয়া যায়। এসব দেখার দায়িত্বে যেসব চিকিৎসক থাকেন,তারা সে দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছেন না। তাদের নিয়েও ওই সব কথা বলেছেন তিনি। ‘তবে চোর শব্দটা বলাটা আমার ঠিক হয়নি। যোগ করেন মির্জা আজম।