গঠনতন্ত্রে নিয়মিত সাধারণ সভা হওয়ার কথা থাকলেও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সেই সভা অনুষ্ঠিত হয় না। সভা হয় না বলে সেখানে আলোচনায়ও আসে না সংগঠনের নেতাকর্মীদের সমস্যা-সম্ভাবনার কথা। উপরন্তু বখে যাওয়া নেতাকর্মীদের প্রশ্রয় দিয়ে চলেন শীর্ষ নের্তৃত্বদের অনেকে। আর এসব কারণে সংগঠনের বখে যাওয়া নেতাকর্মীরা নানা অন্যায় করেও পার পেয়ে যান। ছাত্রলীগের ভুক্তভোগী নেতারা অভিযোগ করেন, নানা অপরাধ-অপকর্ম করে আলোচনায় আসা এমনই একজন হলেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক বেনজীর হোসেন নিশি। নিশির নৃশংসতায় বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ তো বটেই, নিজ সংগঠনের নেতাকর্মীরাও তটস্থ।
বছর খানেক আগে নিজ সংগঠনের এক জুনিয়রকে ব্যাপক মারধর করে আলোচনায় আসেন নিশি। এরপর সমানে চলতে থাকে তার ‘আলোচিত’ হবার মিশন। সংগঠনের ভুক্তভোগী নেতারা বলেন, শুধু মারপিট নয়, মাথাও ফাটিয়ে থাকেন নিশি!
সম্প্রতি ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে ফুল দিতে গিয়ে সংগঠনেরই আরেক নেতার মাথা ফাটিয়ে ফের আলোচনায় আসেন ছাত্রলীগের এই নেত্রী। নিশির বারবার একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তিকে সংগঠনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি বলছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা। তাদের অভিযোগ, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের পৃষ্ঠপোষকতায় বারবার জুনিয়র নেতাদের মারধর করে পার পেয়ে যাচ্ছেন এই নেত্রী। এর আগে জুনিয়র এক নেত্রীকে মারধরের ঘটনায়ও তিনি তাকে শাস্তির হাত থেকে রক্ষা করেছেন। গঠনতন্ত্র মেনে সংগঠন পরিচালিত না হওয়ায় কিছু নেতা-নেত্রী এমন আগ্রাসী হয়ে উঠছেন।
এর আগে রোকেয়া হলের ছাত্রলীগের এক নেত্রীকে মারধরের ঘটনায় তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। ওই ঘটনায় অভিযুক্ত বেনজীর হোসেন নিশিসহ পাচজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। অভিযোগ রয়েছে, সেই গ্রেফতারি পরোয়ানা থেকে বাঁচতে সহযোগিতা করেছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন সহ-সভাপতি, সম্পাদক, উপসম্পাদক দ্য রিপোর্টকে বলেন, কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের প্রশ্রয়েই নিশি এত বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। নিশিসহ আরও কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাকে দিয়ে ছাত্রলীগের বিভিন্ন ইউনিটে কমিটি বাণিজ্য পরিচালনা করান লেখক। যার কারণে বিভিন্ন সময় নানান অভিযোগ সামনে আসলেও তাদেরকে সাংগঠনিক বিচারের মুখোমুখি হতে হয় না। এমনকি মারধরের পরে শাস্তি থেকে মুক্তি পেতে সবধরনের সহযোগিতা করেছেন লেখক ভট্টাচার্য। সম্প্রতি শহিদ মিনারে নিশির ঘটানো কাণ্ড নিয়েও বিব্রত ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির একটি বড় অংশ।
শহিদ মিনারে নিশির মারধরের শিকার ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাবেক ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পাদক এহসানুল হক ইয়াসির ঘটনার পরপর সাংবাদিকদের বলেন, ‘শহীদ মিনারে আমরা মহানগর দক্ষিণ শাখা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ফুল দিতে যাই। সেখানে যাওয়ার সময় আমাদের পেছনে ধাক্কাধাক্কি হয়। এসময় হঠাৎ করে বেনজীর হোসেন নিশি এসে তার মোবাইল দিয়ে আমার মাথায় এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থাকেন। এতে মাথা ফেটে রক্ত বের হয়। তাৎক্ষণিকভাবে সঙ্গে থাকা পরিচিতরা আমাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসা নিই। কয়েকটি সেলাই লেগেছে আমার।’
নিশির এমন আচরণের পেছনে কেন্দ্রীয় সভাপতি, সাধারণ সম্পাদককে দায়ী করে উপ প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক মেশকাত হোসেন দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, 'সংগঠনে বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি চালু হয়েছে। এখানে তৃতীয় পক্ষের কোনো সুযোগ নেই। বারবার অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ায় নিশি আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। তিনি আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটির অনেকের সাথেও বাজে আচরণ করেন। এরকম চলতে থাকলে সংগঠনের ভাবমূর্তির জন্য এটি হুমকিস্বরূপ।
মেশকাত আরও বলেন, এর আগে যুবলীগের অনেক প্রভাবশালী নেতাও অপরাধ করে বিচারের আওতায় এসেছেন, বহিষ্কার হয়েছেন। যেটি ওই সংগঠনের ভাবমূর্তি উজ্জল করেছে। কিন্তু ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতার আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় নিশি বারবার পার পেয়ে যাচ্ছেন।
এর আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বরের রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদ প্রাঙ্গণে ফাল্গুনী দাস তন্বী নামে এক ছাত্রলীগ নেত্রীকে পিটিয়ে আহত করার অভিযোগ উঠেছিলো নিশির বিরুদ্ধে। সেই অভিযোগ মামলা পর্যন্ত গড়িয়েছিলো।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে আদালত এই ছাত্রলীগ নেত্রীসহ তার পাঁচ সহযোগীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। পরে তারা আদালতে হাজির হয়ে জামিন প্রার্থনা করলে তা মঞ্জুর হয়। সেই মামলা এখনও চলমান।
সেই ঘটনায় ছাত্রলীগ নিশির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এরপর জামিনে থাকা অবস্থাতেই গত ২১ তারিখ কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে ফুল দিতে গিয়ে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটান ছাত্রলীগের এই নেত্রী।
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় বারবার এমন অপরাধ করেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন নিশি; এমন অভিযোগ করে সংগঠনটির সহ-সভাপতি মাজহারুল ইসলাম শামীম বলেন, 'ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কোনো নেতা অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে পারে কেন্দ্রীয় সংসদের সভা। কিন্তু শহীদ মিনারে ছাত্রলীগের নেতাকে পিটিয়ে রক্তাক্তের ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি আগেও আরেক নারী নেত্রীকে মারধর করেছেন। তার বিরুদ্ধে যদি আগে ব্যবস্থা নেওয়া হতো তাহলে আজকে এ ঘটনা ঘটতো না।
নিশির এমন বেপরোয়া হওয়ার কারণ হিসেবে সংগঠনিক স্থবিরতাকে দায়ী করেন কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি ইয়াজ আল রিয়াদ ৷ তিনি বলেন, জয়-লেখক নেতৃত্বে আসার পর একটাও সাধারণ সভা হয়নি। গঠনতন্ত্রে প্রতি দুই মাসে একবার সাধারণ সভা আয়োজনের কথা বলা আছে। সংগঠনের গঠনতন্ত্র মেনে সাধারণ সভা হলে এগুলো আলোচনা হতো। এতে বেশিরভাগ অপরাধে সংশ্লিষ্টতা কমানো যেতো।
শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দদের নিয়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। যেখানে সংগঠনের নানাদিক নিয়ে আলোচনা হয়। যদিও ছাত্রলীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় এবং সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য দায়িত্ব নেওয়ার পর এ ধরণের কোন সভা অনুষ্ঠিত হয়নি।
অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে বেনজীর হোসেন নিশিকে ফোন করা হলে তিনি ফাল্গুনী দাস তন্বীর বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, সেটি বিচারাধীন রয়েছে। সে বিষয়ে আমার কিছু বলার নাই।
তবে অন্য অভিযোগগুলো অস্বীকার করেন ছাত্রলীগের এই নেত্রী। শহিদ মিনারের ঘটনায় নিজের সম্পৃক্ততা নেই দাবি করে নিশি বলেন, সে সময় আমি ছিলামই না। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে একটি মহল আমার নাম বলে বেড়াচ্ছে৷ তবে আমি শুনেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থীকে মহানগর ছাত্রলীগের কেউ শ্লীলতাহানি করেছিল। তাই তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেপেলেই মার দিয়েছে। নিশ্চয় সে এমন কিছু করেছে যার জন্য তাকে মার দেওয়া হয়েছে।
ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদকের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় বারবার অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন-- এমন অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে নিশি বলেন, এখানে পার পাওয়ার কিছু নাই।
কমিটি বাণিজ্যের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে কেউ অভিযোগ করতে পারে। তবে সেটি প্রমাণ করতে হবে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় এবং সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যকে বুধবার দুপুর ২টা ২০ মিনিটে ফোন করা হয়। তবে তারা কেউই সাড়া দেননি।
আরও পড়তে পারেন-