সেপ্টেম্বর ১, ২০২২, ০১:৪০ পিএম
উপসাগরীয় দেশ কাতার যখন ২০২২-এর বিশ্বকাপে স্বাগতিক দেশ হিসেবে নির্বাচিত হয়, তখন অনেকেই ভুরু কুঁচকেছিলেন, দেশটির মানবাধিকার রেকর্ড নিয়ে উদ্বেগ থেকে শুরু করে এই প্রতিযোগিতা আয়োজনের প্রকৃত চ্যালেঞ্জগুলো দেশটি মোকাবিলা করতে পারবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল সে সময়। এ ছাড়া যে দেশে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়, সেখানে খেলোয়াড় এবং দর্শকেরা গরম কীভাবে সামলাবেন? যেখানে টিকে থাকাই দায়, সেখানে ফুটবলের মতো খেলা কী করে হবে?
একটা সমাধান ছিল টুর্নামেন্ট শীতকালে সরিয়ে নেওয়া। কিন্তু মরু অঞ্চলের ধনী দেশটি এখনও এই নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাকে একটা কিংবদন্তী কর্মযজ্ঞের পর্যায়ে নিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। এবং সেদিকেই যাচ্ছে তারা। প্রযুক্তিকে এমনভাবে কাজে লাগাচ্ছে যার মাধ্যমে এমনকি সবচেয়ে উষ্ণ আবহাওয়ার দেশগুলোর জন্য সারা বছর যে কোন সময়ে বড়ধরনের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন করা সম্ভব হবে। কাতারের স্থানীয় ফুটবলার হাজার সালেহ বলছেন, ওই এলাকার তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা খেলার জন্য বিশাল একটা চ্যালেঞ্জ।
কাজেই, বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যয় না করে খেলোয়াড় এবং দর্শকদের জীবন তারা কীভাবে স্বস্তিদায়ক করবেন? কাতারে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা খুব বেশি হতে পারে। সমুদ্র থেকে গরম হাওয়া ছোট এই দ্বীপ রাষ্ট্রটির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় হরহামেশাই।
প্রথম চ্যালেঞ্জ হল গরম বাতাস বের করে দেওয়া। আল জানউব স্টেডিয়ামের ছাদ এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যাতে বাতাস এর চারপাশ ঘিরে এবং ছাদের খোলা অংশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ছাদের রঙও হালকা রাখা হয়েছে যাতে সূর্যের আলো তাতে প্রতিফলিত হয় এবং ছাদ শীতল রাখে।
পিচ এবং স্ট্যান্ডগুলো ঠাণ্ডা রাখার জন্য আরও কিছু উদ্ভাবনী সমাধান নেওয়া হয়েছে। চলুন জেনে নিই সেসব বিষয়ে।
যেদিন ম্যাচ হবে, ভেতরের স্ট্যান্ডগুলো ৪০ হাজার মানুষে ভর্তি থাকবে। আর প্রতিটি মানুষের শরীর থেকে তাপ আর আর্দ্রতা তৈরি হবে। একদিকে কাতারের আবহাওয়ার উত্তাপ আর অন্যদিকে ভেন্যুর ভেতর মানুষের শরীর থেকে সৃষ্ট তাপ যুক্ত হওয়ায় সেখানে কার্যকর একটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রয়োজন।
স্ট্যান্ডে ফুটবল দর্শকদের প্রত্যেকের আসনের নিচে ভেন্টিলেটার বসিয়ে সেখান দিয়ে হাওয়া চালিয়ে আসন শীতল রাখা হচ্ছে।
শাওয়ারের ঝারিমুখ দিয়ে যেমন পানির ধারা বেরোয়, তেমনভাবে সূক্ষ্ম ঝারি দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস ছাড়া হবে, যা দর্শকদের চারপাশ থেকে ঘিরে রাখবে।
বাতাসের এই প্রবাহ হবে খুবই মৃদু। বিমানে আসনের ওপর থেকে বাতাস ছাড়ার যে ভেন্ট থাকে, সেখান থেকে যেভাবে জোরে বাতাস ছাড়া হয় সেভাবে এটা কাজ করবে না।
ফুটবল ভক্তরা এতে অবশ্যই খুশি হবেন, কিন্তু পিচে খেলোয়াড়দের অবস্থা কেমন হবে? আজকের ফুটবল খেলোয়াড়রা একটা ম্যাচের সময় ১০ কিলোমিটারের বেশি দৌড়ান, ফলে তাঁদের শরীর থেকে তিন লিটার পর্যন্ত ঘাম নির্গত হয়। কাজেই তাঁদের শরীর ঠাণ্ডা করার এবং শরীরে পানির প্রয়োজন হয়।
কাতারের আবহাওয়া আর্দ্র, ফলে সেখানে ঘাম সহজে শুকায় না। সে কারণে শরীরের তাপমাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে যেতে পারে এবং অতি গরমে মানুষ অবসন্ন হয়ে পড়তে পারে।
ফলে, কাতার বিশ্বকাপের সময় পিচের ওপর একটা শীতল আস্তরণ তৈরিতে সাহায্য করতে বড় বড় ঝারিমুখ দিয়ে স্টেডিয়ামে ঠাণ্ডা বাতাস সঞ্চালন করা হচ্ছে।
এই প্রযুক্তি তৈরিতে সহায়তা করেছেন শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞ ড. সাউদ আবদুল গানি। তিনি বলছেন, ভেন্টগুলো যে কোণা থেকে বসানো হয়েছে এবং তার ফলে ঠাণ্ডা বাতাস যেভাবে এবং যেখানে গিয়ে জমা হচ্ছে, তাতে খেলোয়াড়রা বুঝতেই পারবেন না যে একটা বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে।
এতে স্টেডিয়ামের ভেতর ১৮ থেকে ২৪ ডিগ্রি তাপমাত্রার একটা ঠাণ্ডা হাওয়ার বুদ্বুদ তৈরি হবে। আর সেটা কখনই মাটি বা আসনের স্ট্যান্ড থেকে দু'মিটারের বেশি ওপরে উঠবে না। কখনই মনে হবে না মরুভূমির আকাশে ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝটকা ছাড়া হচ্ছে। দেখা যাক, এর পর কী হবে?
ঠাণ্ডা বাতাস যখন আবার গরম হয়ে উঠবে, তখন এক্সট্রাক্টার ফ্যান ওই গরম বাতাস টেনে নিয়ে যাবে মধ্যবর্তী একটা এলাকায়।
সেখানে ওই বাতাসকে ফিল্টার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আবার শীতল করা হবে এবং স্টেডিয়ামে পুনঃসঞ্চালন করা হবে। এর মধ্যে দিয়ে বাতাসের সঞ্চালন চক্র সম্পূর্ণ হবে।
স্টেডিয়ামকে স্বস্তিদায়ক রাখতে বাতাস কীভাবে শীতল করা হবে? আরেকটু বিস্তারিতভাবে দেখা যাক।
স্টেডিয়ামের প্রতিটি কোণে বসানো হিট এক্সচেঞ্জারগুলোর মধ্যে শীতল পানি-ভর্তি যে পাইপগুলো থাকবে, গরম হাওয়া ওই পাইপগুলোর পাশে বসানো ফানেলের মাধ্যমে ঠাণ্ডা করা হবে।
ঠাণ্ডা পানি বাতাসের তাপ শুষে নেবার পর ৪০ হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন মজুত ট্যাঙ্কের ভেতর ওই পানি পাম্পের মাধ্যমে চলে যাবে। তিন কিলোমিটার দূরে বসানো ট্যাঙ্কটিতে ওই পানি আবার শীতল করা হবে, যাতে পরের দিনের ম্যাচের জন্য ঠাণ্ডা পানি প্রস্তুত থাকে।
পুরো শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাটি চালানো হবে কাতারের রাজধানী দোহার কেন্দ্রস্থল থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে সম্প্রতি তৈরি একটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত জ্বালানি ব্যবহার করে।
পুরো ব্যবস্থাটা যিনি উদ্ভাবন করেছেন, ড. সাউদ আবদুল গানি, তিনি বলেছেন যে কাতার একটা উত্তরাধিকার তৈরি করতে চায়। ফুটবলাররা যে যার দেশে ফিরে যাবার পরেও এই উদ্ভাবনের সাথে যেন কাতারের নাম চিরকাল জড়িয়ে থাকে।
দোহায় ২০২২-এর এপ্রিল মাসে আল জানউব স্টেডিয়াম ঠাণ্ডা করার ব্যবস্থা গণমাধ্যমকে ঘুরিয়ে দেখান ড. সাউদ আবদুল গানি। তিনি বলছেন, তার ভাষায় ''তাপমাত্রার স্বাচ্ছন্দ্য" দিতে বহু বছর ধরে এই গবেষণার কাজ চালানো হয়েছে। এর মাধ্যমে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হয়েছে যা সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের জন্য আরামদায়ক হবে। ২০১৯ সালে কাতারে ওয়ার্ল্ড অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতায় যোগ দেওয়া অ্যাথলেট এবং ভক্তদের সাথে কথাবার্তা বলা হয়েছে, যা এই ওয়ার্ল্ড কাপে দর্শক ও খেলোয়াড়দের জন্য আরামদায়ক পরিবেশ সৃষ্টির নকশা তৈরিতে সাহায্য করেছে।
একজন খেলোয়াড়ের দৃষ্টিকোণ
এ বিষয়ে কথা বলেছেন কাতারের জাতীয় নারী ফুটবল দলের একজন ডিফেন্ডার, হাজার সালেহ-র সাথে। ১১ বছর বয়স থেকে তিনি খেলেন। চরম আবহাওয়ার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ স্তরের খেলাধুলার চাহিদাগুলো সম্পর্কে তিনি পুরোই ওয়াকিবহাল। তিনি বলছেন, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল আর্দ্রতার মোকাবিলা।
গরম আমরা সহ্য করতে পারি, কিন্তু গরমের সাথে যখন আর্দ্রতা মেশে তখন পরিস্থিতি অনেক বেশি কঠিন হয়। দুটি নতুন ভেন্যু, খালিফা এবং এডুকেশনাল সিটি স্টেডিয়াম, যেখানে নতুন এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবস্থা বসানো হয়েছে, সেখানে খেলার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছে।
তিনি বললেন, নতুন ভেন্যুতে খেলার অভিজ্ঞতা একেবারে আলাদা - বিশেষ করে জুন মাসে, যখন কাতারে বছরের সবচেয়ে বেশি গরম পড়ে।
এই পদ্ধতি কি টেকসই?
কাতার ২০২২-এর আয়োজকরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, স্টেডিয়ামগুলো পুরোটা শীতল করতে যে জ্বালানি খরচ হবে, তা বাড়তি কোন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করবে না, কারণ এর জন্য বিদ্যুৎ আসবে নতুন বসানো সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে।
বিশ্বকাপ অনুষ্ঠান আয়োজনের যে আবেদনপত্র কাতার দিয়েছিল, গোড়া থেকেই তার অন্তর্ভুক্ত ছিল স্টেডিয়ামগুলো ঠাণ্ডা করার জন্য সৌর শক্তিচালিত, শূন্য কার্বন নিঃসরণকারী প্রযুক্তির অংশ হিসেবে সৌর প্যানেলের ব্যবহার। তবে কার্বন নিঃসরণের মাত্রার হেরফের না করে পুরো টুর্নামেন্ট আয়োজন নিশ্চিত করা অনেক সাহসী একটা আকাঙ্ক্ষা।
স্টেডিয়ামগুলো নির্মাণের সময় যে কার্বন নির্গত হয়েছে, যেটা ছিল 'নির্মাণ সংশ্লিষ্ট কার্বন', সেটাই ভেন্যুগুলোর সার্বিক কার্বন ব্যবহারের ৯০%। ভেন্যুগুলো তৈরিতে আবহাওয়ামণ্ডলে নির্গত হওয়া গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ ছিল আনুমানিক ৮ লাখ টন। যেটা মার্কিন পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থার নিঃসরণ গণনা মতে, একটা গাড়ি নিয়ে সারা বিশ্ব ৮০ হাজার বার প্রদক্ষিণ করলে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয় তার সমপরিমাণ।
স্টেডিয়ামগুলো ছাড়াও রয়েছে ওয়ার্ল্ড কাপ ভেন্যুগুলোতে যাতায়াতের জন্য ব্যবহৃত পরিবহণের প্রভাব, আরও আছে দেশটিতে ফুটবলপ্রেমীদের বিমানে উড়ে যাবার প্রভাব।
ফিফা বলছে, টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়েছে বেশ অল্প এলাকার ভেতরে। কাতারে ভেন্যুগুলো তৈরি করা হয়েছে কাছাকাছি দূরত্বে। ফলে একটা সাইট থেকে আরেকটা সাইটে যেতে যে কার্বন নির্গমন হবে, তা ২০১৮ সালে রাশিয়া আয়োজিত টুর্নামেন্টে নির্গত কার্বনের চেয়ে এক-তৃতীয়াংশ কম।
কাতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ইতোমধ্যেই যে পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গত হয়ে গেছে, অন্য ক্ষেত্রে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমিয়ে সেই ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়া হবে।
তবে সেটা তাঁরা কীভাবে অর্জন করবে বলে আশা করছে তা এখন পর্যন্ত খুব পরিষ্কার নয়। ফিফা বলছে, বিশ্বকাপ আয়োজনের ফলে তারা যে কার্বন নিঃসরণ করেছে সেই ক্ষতি পুষিয়ে দিতে তাঁরা ভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে - যার মধ্যে রয়েছে জ্বালানি সাশ্রয়, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার এবং সম্ভবত, গাছ লাগানো। তবে চূড়ান্ত পর্যায়ে কোন প্রকল্পগুলো বাছা হয়েছে তা নিশ্চিত করা হয়নি।
এ ধরনের প্রকল্প ব্যবহার করে কার্যকর কার্বন ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে কয়েক দশক লেগে যেতে পারে। সম্প্রতি বিবিসির এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, কার্বন নির্গমনে ভারসাম্য আনতে বনায়নের বিষয়টি কাগজে কলমেই থেকে গেছে।
ফলে কাতার তার পরিবেশ রক্ষার লক্ষ্য আসলেই অর্জন করেছে নাকি তাদের এই দাবি শুধুই ফাঁকা বুলি, তা সত্যিকার অর্থে বিচার করে দেখতে সময় লাগবে।
স্টেডিয়ামগুলো নির্মাণে ৩০ হাজার অভিবাসী শ্রমিক নিয়োগ করে কাতারকে মানবসম্পদের জন্য যে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে, তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা দেশটিকে সামাল দিতে হচ্ছে। বিপুল সংখ্যক শ্রমিক একাজ করতে গিয়ে হয় প্রাণ হারিয়েছে, নয় গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। এছাড়াও বাধ্যতামূলক শ্রম, অমানবিক কর্ম পরিবেশ, ঘিঞ্জি বাসস্থান, বেতন না দেওয়া এবং পাসপোর্ট জব্দ করার নানা অভিযোগও উঠেছে।
কাতারের সরকার এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং জোর দিয়ে বলেছে যে ২০১৭ সাল থেকে তাঁরা যেসব পদক্ষেপ চালু করেছে, তাঁর মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত গরমে অভিবাসী শ্রমিকদের যাতে কাজ না করতে হয় সে বিষয়ে সুরক্ষা, তাদের কর্ম ঘণ্টা সীমিত রাখা এবং শ্রম শিবিরগুলোর অবস্থা উন্নত করা। তবে, শুধু ২০২১ সালেই বিশ্বকাপের সাথে জড়িত বিভিন্ন প্রকল্পে যাঁরা কাজ করেছে, তাঁদের মধ্যে কাতারে মারা গেছেন ৫০ জন শ্রমিক, গুরুতর আহত হয়েছেন আরও ৫০০-এর বেশি। এই তথ্য সংগ্রহ করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, আইএলও। মাঠের বাইরে এসব ক্ষেত্রে কাতারের রেকর্ড নজরে রাখা হয়েছে।
সূত্র: বিবিসি