আপনি জেনে অবাক হবেন যে ভারতের সর্বপ্রথম আইসিএস কর্মকর্তা হিসেবে অর্থাাৎ ভারতের প্রথম সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে যার নাম বিভিন্ন ম্যাগাজিনে আওড়ানো হয়, তিনি হলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সম্পর্কে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মেজদাদা।
ঠাকুর বাড়ির এমনই অনেক নাম আছে, যারা স্বমহিমায় দীপ্তিময় ছিলেন। সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় ঠাকুর বাড়ি সম্পর্কে খানিক বিবরণ পাওয়া যায়।
‘অসিতকুমার হালদারকে লেখা ঠাকুরকবাড়ির অপ্রকাশিত চিঠি’ প্রবন্ধে বলা হয়েছে: ‘কলকাতা আর্ট স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন ১৯০৬-১১ সময়কালে অসিতকুমারের সঙ্গে জোড়াসাঁকো-গৃহে আত্মীয়জনদের সম্পর্ক নিবিড়তর হয়ে উঠেছিল। সেখানেও অবনমামা ছিলেন তার শিল্পগুরু। বড়দাদা মশায় দ্বিজেন্দ্রনাথ (১৮৪০-১৯২৬), মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ (১৮৪২-১৯২৩), নতুনদাদামশায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মতো রবীন্দ্রনাথও ছিলেন তার চিত্রকলার অনুরাগী সমালোচক’ (শারদীয় ১৪১৮)।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম সদস্য। ১৮১৭ সালের ১৫ মে কলকাতায় তার জন্ম।
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য-প্রবেশক বইয়ে ঠাকুর বাড়ির ইতিহাস প্রসঙ্গে উঠে এসেছে: ‘কুশারীরা হলেন ভট্টনারায়ণের পুত্র দীন কুশারীর বংশজাত; দীন মহারাজ ক্ষিতিশূরের নিকট কুশ নামক গ্রাম (বর্ধমান জিলা) পাইয়া গ্রামীণ হন এবং কুশারী নামে খ্যাত হন। দীন কুশারীর অষ্টম কি দশম পুরুষ পরে জগন্নাথ।’
রবীন্দ্রনাথের পরিবারের সদস্য হিসেবে নয়, বরং উনবিংশ শতাব্দীর সামাজিক নবজাগরণ পর্বের অন্যতম পুরোধা পুরুষ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। অনেকেরই মতে, বিশেষত ধর্মসংস্কারের ক্ষেত্রে তিনি রামমোহনের পরে দ্বিতীয় ‘সৃজনশক্তি’ (আনন্দবাজার পত্রিকা)। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ও সারদা দেবীর ১৫ সন্তান। তার মধ্যে বড় ছেলে হলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ তাদের ১৪তম ছেলে। তার মেজ দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অগ্রজ হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৪-১৮৮৪)। রবীন্দ্রনাথের বড় দিদি সৌদামিনী দেবী, মেজ দিদি শ্রীমতি জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। এই জ্ঞানদাই সেকালের সবচেয়ে আধুনিক নারী হিসেবে সমাদৃত। রবীন্দ্রনাথের আরেক অগ্রজ হলেন বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৫-১৯১৫)। এ ছাড়া তার অন্যান্য দিদিদের মধ্যে সুকুমারী দেবী (১৮৪৯- ১৮৬৪), শরৎকুমারী দেবী (১৮৫৬-১৯২০), স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৮-১৯৩২) ও বনকুমারী দেবী (১৮৫৯-১৯৩৪) অন্যতম (সাপ্তাহিক দেশ, সামহোয়্যার ইন ব্লগ)।
সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় বলা হয়েছে: ‘রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ হেমেন্দ্রনাথের (১৮৪৪-১৮৮৪) দশম সন্তান, সপ্তম কন্যা ছিলেন সুষমা দেবী, অসিতকুমারের সুষমামাসি। তিনি ছিলেন সৌন্দর্যময়ী, পিয়ানোবাদনে কৃতী ও অসাধারণ বক্তা। ১৯২৭-এ তিনি অসীম সাহসিকতা নিয়ে একলা আমেরিকায় যান এবং রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা-পরিকল্পক মিস্টার পন্ড-এর সহায়তায় সে দেশের বিদ্বজ্জনদের সামনে নারীশিক্ষা, ভারতে নারীজাগরণ, নারীপ্রগতি, রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গাঁধী, বেদান্ত ও স্বামী বিবেকানন্দ শীর্ষক ৩৮টি বক্তৃতা দেন। নিখুঁত ইংরেজিতে তার যুক্তিসিদ্ধ বক্তব্য সেদেশের শ্রোতাদের তারিফ পেয়েছিল। স্বভাবত তার স্নেহের অসিতকুমারের মনেও ইচ্ছে জেগেছিল আমেরিকায় শিল্পকলা বিষয়ে বক্তৃতা-ভ্রমণের, যদিও তা কার্যত ফলপ্রসূ হয়নি। শান্তিনিকেতনে অসিতকুমারের কর্মজীবনের অনিশ্চয়তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন সুষমা দেবী। ঠাকুর পরিবারের ব্যতিক্রমী এই চরিত্র সুষমা দেবীর পাঁচ পুত্রের মধ্যে তিনজনই সন্ন্যাসজীবন বেছে নিয়েছিলেন (রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী বৈকুণ্ঠানন্দ, ওই মিশনের গৃহী-সন্ন্যাসী লোকেন্দ্রনাথ এবং দক্ষিণদেশের শংকর সম্প্রদায়ভুক্ত শ্রীনিবাস আচার্য)।’
রবীন্দ্রনাথের একজন অগ্রজ হলেন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬০-১৯২৩)। এছাড়া তার ছোট ভাই অর্থাৎ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সবচেয়ে ছোট ছেলে বুধেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মাত্র ১ বছর বয়সেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথ ‘ঠাকুর’ নাকি ‘কুশারী’: রবীন্দ্রনাথের নামের শেষে যদি কুশারী থাকতো, তবে কেমন হতো? কেন এমন বলছি? কারণ রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষের পদবীতে তিন অক্ষরের এই শব্দ যুক্ত ছিল। তাহলে কীভাবে তারা রীতিমতো ঠাকুর হয়ে বসলেন?
প্রকৃত অর্থে রবীন্দ্রনাথের পরিবার ছিল পিরালী ব্রাহ্মণ। এই জাত ছিল ব্রাহ্মণকুলের মধ্যে সবচেয়ে পতিত। কিন্তু কীভাবে তারা পতিত হলেন সেটা নিয়ে আছে এক ইতিহাস। আর এই ইতিহাসের গল্প জানতে হলে তাদের আদিপুরুষের কথা জানতে হবে। রঘুনাথ আচার্যকে রবীন্দ্রনাথের বংশের আদিপুরুষ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। তারই এক বংশধর জয়কৃষ্ণের দুই ছেলের মধ্যে একজন দক্ষিণানাথ। দক্ষিণানাথের চার ছেলে- কামদেব, জয়দেব, রতিদেব ও শুকদেব। সামান্য রসিকতার পরিণতি হিসেবে কামদেব ও জয়দেবকে কামাল খাঁ ও জামাল খাঁ নাম নিয়ে ইসলাম ধর্ম অবলম্বন করতে হয়। ঠিক এ কারণেই রবীন্দ্রনাথের পরিবার সংকীর্ণ একটি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন।
যাই হোক, যশোর জেলার চেঙ্গুটিয়া পরগনার জমিদারি করতেন ঠাকুরবাড়ির পূর্বপুরুষরা। এই পরগনায় খান জাহান আলী যখন কতৃত্ব লাভ করেন, তখন তাহের খাঁ নামে এক ধর্মান্তরিত মুসলিমকে নিয়ে আসেন। নবদ্বীপের (অধুনা নদীয়া) পিরল্যা গ্রামে তিনি বসবাস করেছিলেন বলে পিরল্যা খাঁ নামে সমধিক পরিচিত।
জনশ্রুতি আছে, একবার রোজার মাস চলাকালীন একটি লেবুর গন্ধ শুকছিলেন। তখন কামদেব ঘ্রাণেনং অর্ধভোজনম- প্রবাদটি আওড়েছিলেন। রোজা নষ্ট সংক্রান্ত রসিকতা করার সূত্র ধরে একদিন গো-মাংসের স্বাদ ও গন্ধ অনুভব করিয়ে তাদেরকে সমাজে পতিত করে দেন তাহের খাঁ। ব্রাহ্মণদের পক্ষে ঘোষণা করে দেওয়া হয়, কামদেব ও জয়দেব মুসলিম হয়েছেন। সুযোগ সন্ধানীরা অনেকে তাদের আত্মীয়দের সবাইকেই ‘পিরালি থাকের ব্রাহ্মণ’ আখ্যা দিয়েছিল। ‘পির’ অর্থাৎ মুসলিম সংসর্গ হয়েছিল বলে ‘পিরালি ব্রাহ্মণ’। অনেকে আবার ধারণা করেন পিরল্যা খাঁর কারণেই পিরালির অন্তর্ভুক্তি। এ সম্পর্কে শ্রী প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন, ‘যেসব পরিবার কুলাচার্যের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হইয়া সমাজে পতিত থাকিয়া গেল, তাহাদেরই অন্যতম হইতেছে পীরালী ব্রাহ্মণগণ।’ আর জয়দেবের অন্য দুই ভাই দক্ষিণডিহির বাড়িতেই বসবাস করতেন। কিন্তু স্থানীয়দের অত্যাচারে ঘর ছাড়তে বাধ্য হন তারাও। এ ঘটনার জেরে তারা অতিকষ্টে অনেক অর্থব্যয় করে, কখনও ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে পরিবারের মেয়েদের পাত্রস্থ করতেন (বঙ্গদর্শন)।
শুকদেবের মেয়ের বিয়ে হয়েছিল পিঠাভোগের জমিদার জগন্নাথ কুশারীর সঙ্গে। তবে তদানীন্তন কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের রোষে পড়ে পিঠাভোগ ছেড়ে দক্ষিণডিহিতে এসে বসবাস শুরু করেন। ঠাকুর বংশের আদি-পুরুষ হলেন এই জগন্নাথ কুশারী। প্রশ্ন হলো- কুশারী থেকে ঠাকুর পদবী এলো কীভাবে? জগন্নাথের ছোট ছেলের নাম ছিল পুরুষোত্তম। তার সম্পর্কে তারিখহীন এক চিঠিতে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর জ্ঞানদানন্দিনীকে জানিয়েছিলেন যে এই পুরুষোত্তম নাকি এক মুসলিম রাজকুমারীকে বিয়ে করে সমাজে আবার পতিত হয়েছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই সত্যটিকে বিশ্বাস করেছিলেন। তবে এই সম্পর্কে আর কোনোকিছু জানা সম্ভব হয়নি (বঙ্গদর্শন)।
পুরুষোত্তমের নাতি রামানন্দের মহেশ্বর ও শুকদেব। সামাজিক অশান্তি এড়ানোর জন্য তারা কলকাতার দক্ষিণে গোবিন্দপুরে এসে বসবাস শুরু করেন। তাদের গৃহদেবতা ছিল শিব। অর্থাৎ তারা শিবঠাকুরের পূজা করতেন। গঙ্গাতীরে জমি কেনা এবং বাড়ি শিবের প্রতিষ্ঠা থেকেই তাদের পৌত্তলিক পরিচয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে (বঙ্গদর্শন)।
একই সময় ব্রিটিশদের বাণিজ্যতরী এসে ভিড়ত গোবিন্দপুরের গঙ্গায়। কুশারীদের উত্তরপুরুষ পঞ্চানন কুশারী সেই সময় ইংরেজ কাপ্তেনদের খাদ্যসামগ্রী, জল সরবরাহের কাজ করতেন। ওই শ্রমসাধ্য কাজে পঞ্চাননকে সাহায্য করতেন এলাকার খেটে খাওয়া মানুষজন। আচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণসন্তান বলেই, পঞ্চাননকে তারা ‘ঠাকুরমশাই’ বলে ডাকতেন। সেই থেকে ধীরে ধীরে কুশারী পদবী হারিয়ে গেল ‘ঠাকুর’ সম্বোধনের আড়ালে (বঙ্গদর্শন)।
পঞ্চাননের দুই ছেলে- জয়রাম ও জয়সন্তোষ। জয়রামের চার ছেলে- আনন্দীরাম, নীলমণি, দর্পনারায়ণ ও গোবিন্দরাম ১৭৬৪ অব্দে কলকাতা গ্রামে পাথুরিয়াঘাটা অঞ্চলে জমি কিনে বসতবাড়ি তৈরি করেন ও বাবার নির্দেশে ১৩ হাজার টাকার কোম্পানির কাগজ কিনে তখনকার গৃহদেবতা শ্রী রাধাকান্ত জিউয়ের নামে ব্রহ্মোত্তর সম্পত্তিতে রূপান্তর করে দেন। সেই টাকার সুদে করা হয় দেবপূজার আয়োজন। নীলমণি এক লাখ টাকা ও লক্ষ্মীজনার্দনের দায়িত্ব গ্রহণ করে পাথুরিয়াঘাটার বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। জোড়াবাগানে বৈষ্ণবচরণ শেঠের কাছ থেকে বর্তমান জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির এক বিঘা ব্রহ্মোত্তর জমি পেয়েছিলেন। তখন সেই অঞ্চল ‘মেছুয়াবাজার’ হিসেবে পরিচিত ছিল। ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণেই নীলমণির পরিবারকে সবাই ‘মেছুয়াবাজারের গোঁড়া’ বলে ডাকতে থাকে। পিরালী থাকের ব্রাহ্মণ হয়েও রাধাকান্ত জিউ, লক্ষ্মীজনার্দন ও শালগ্রামশিলার নিষ্ঠাবান উপাসক হিসাবেই হিন্দু সমাজে সদ্য মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিল ঠাকুর পরিবার। অন্দরমহলে ছিল প্রবল বৈষ্ণবীয় আবহাওয়া। নিরামিষ ছাড়া খেতেন না, ঠাকুরবাড়ির সেই আমলের নারী-পুরুষ। মহাসমারোহে পূজাপার্বণ অনুষ্ঠিত হতো (বঙ্গদর্শন)।
রবীন্দ্রনাথ যেভাবে ব্রাহ্মসমাজের অন্তর্ভুক্ত হলেন: ঠাকুর পরিবারের ইতিহাস সামাজিক মূলস্রোতের বাইরে গিয়ে নতুন চিন্তাধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সময় থেকেই তাদের পরিবারের ধর্মজীবনে বইতে থাকে পরিবর্তনের হাওয়া। প্রিন্স দ্বারকানাথ ও মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী ছিলেন। অবশ্য অনেকে রবীন্দ্রনাথকে সনাতন ধর্মাবলম্বী হিসেবে চিহ্নিত করলেও প্রকৃত অর্থে তিনি ছিলেন ব্রাহ্ম। পিতা-পিতামহের দেখানো পথেই হেঁটেছেন রবীন্দ্রনাথ। তবে ঠাকুর বাড়িতে জোর করে কাউকে ধর্ম চাপিয়ে দেওয়া হতো না। অর্থাৎ নিজ নিজ ধর্ম পালনে তাদের স্বাধীনতা ছিল। বিশেষ করে এই পরিবারের মেয়েরা যেকোনো ধর্ম অবলম্বন করতে পারতেন। ঠিক সেই কারণেই ঠাকুর বাড়ির সদস্যরা হয়ে উঠেছেন তদানীন্তন কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের আলোকবর্তিকা।