আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ঢাকায় বিভিন্ন দূতাবাসের কূটনীতিকরা নির্বাচন কমিশনে এলেও কোনো পরামর্শ দেননি বলে দাবি করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, ‘ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে তারা আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তবে তারা কিন্তু আমাদের কোনও পরামর্শ দেননি।’
রবিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশন (ইসি) আয়োজিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের নেতাদের সঙ্গে সংলাপের সময় তিনি একথা বলেন।
এর আগে জাসদের নেতারা তাদের প্রস্তাবে ‘কতিপয় বিদেশি কূটনৈতিক বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের কাজে কূটনৈতিক শিষ্টাচার পরিপন্থী এবং অযাচিতভাবে নাক গলিয়েছে’ বলে অভিযোগ তোলেন।
এসময় বিদেশি কূটনীতিকদের অযাচিত নাক গলানোকে প্রশ্রয় না দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) সতর্ক থাকতে বলেছে হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদ। এক্ষেত্রে দলটি মনে করে ইসি কোনো সালিশের প্রতিষ্ঠান নয়।
জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, “ডিপ্লোম্যাটদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। একটি গ্রুপ এখানে এসেছে, এছাড়াও পরে দুজন এসেছেন। তারা কিন্তু নির্বাচনের বিষয়ে কোনও পরামর্শ দেননি। বাইরে থেকে মনে হতে পারে..। একটা বড় গ্রুপ এসেছিল, তারা আমাদের নির্বাচন বিষয়ে শুধু অবহিত হয়েছেন। কিন্তু উনারা উনাদের পক্ষ থেকে কোনও পরামর্শ দেননি। আপনাদের (জাসদ) হয়তো দেখা হলে দিতে পারেন। কিন্তু আমাদের ওইভাবে কোনও পরামর্শ দেননি। আজ যতটুকু শুনেছি, এটা আগে থেকে একটি ধারাবাহিকতা। যখন নির্বাচন আসে তখন বিভিন্ন লোক এসে সাক্ষাৎ করে যায়। তারই অংশ হিসেবে হয়তো এটা হয়েছে।”
রাজনৈতিক বিষয়ে ইসিকে সালিশি না করার বিষয়ে জাসদের প্রস্তাবের জবাবে সিইসি বলেন, ‘আমরা প্রথম থেকে বলেছি, সবাইকে আহ্বান করে যাবো। কিন্তু আমরা সুস্পষ্টভাবে বলেছি কাউকে নির্বাচনে আসতে আমরা বাধ্য করতে পারবো না। এটা আমাদের দায়িত্বও নয়। আমাদের দায়িত্ব সুষ্ঠু, সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সবাইকে আহ্বান করা।’
নির্বাচনের প্রচারণা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে অনেক দায়িত্ব কমে যায় উল্লেখ করে সিইসি বলেন, “অনেক দল থেকে একই মঞ্চ থেকে বক্তব্য দেওয়ার প্রস্তাব এসেছে। বিদেশে এ ধরনের বিষয়টি দেখা যায়। এই প্রস্তাবটি আমার কাছে ভালো লেগেছে। অবশ্য আইনে এই বিষয়টি নেই।”
নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেশের প্রচলিত আইনে নির্বাচন কমিশন কোনও ঘাটতি দেখছে না উল্লেখ করে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘সংবিধান ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে আমাদের পর্যাপ্ত ক্ষমতা দেওয়া আছে। তারপরও কোনও ফাঁকফোকর থাকলে সেটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। এছাড়াও নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা ও আচরণ বিধিমালা রয়েছে। আমাদের ক্ষমতার খুব একটা অভাব আছে, সেটা ফিল করছি না। সবার সহযোগিতায় ক্ষমতাগুলো আইনানুগভাবে প্রয়োগ করতে পারি।”
সংলাপে দলের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এমপি লিখিত প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। এতে উল্লেখ করা হয়-
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ এবং নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রসঙ্গে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ মনে করে, জাতীয় নির্বাচনসহ অন্যান্য নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব নিয়ে কোনো সাংবিধানিক, আইনগত ও প্রশাসনিক ঘাটতি বা দুর্বলতা থাকলে তা দূর করার জন্য গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশসহ অন্যান্য নির্বাচনী আইনে কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজন বা চাহিদা থাকলে নির্বাচন কমিশনের উচিৎ তা সুনির্দিষ্টভাবে আইনসভায় অর্থাৎ জাতীয় সংসদের কাছে উত্থাপন করা। কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিও এমন প্রয়োজনবোধ করলে তা আইনসভায় অর্থাৎ জাতীয় সংসদের কাছে সুনির্দিষ্টভাবে উত্থাপন করতে পারেন।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় ইভিএম পদ্ধতি সংযোজনকে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে স্বাগত জানায়। ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণে বাস্তবে কিছু সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে। কিছু প্রশ্ন ও বিতর্কও তৈরি হয়েছে। জাসদ ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণের অভিজ্ঞতা থেকে চিহ্নিত সমস্যাসমূহ সমাধান করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছে। একই সঙ্গে ইভিএম পদ্ধতিতে কারিগরীভাবে ত্রুটিমুক্ত ও বিশ্বাসযোগ্য কাজ করার পাশাপাশি ব্যালট পদ্ধতিতেও ভোট গ্রহণের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।
ভোটার তালিকা প্রসঙ্গে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ মনে করে, বর্তমানে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি, সংযোজন, বিয়োজন, সংশোধনের সমগ্র প্রক্রিয়াটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ। জাসদ এই প্রক্রিয়াকে আরও সহজ এবং দ্রুতগতিসম্পন্ন করার দাবি জানাচ্ছে। জাসদ একই সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান ও সংশোধনের জটিল ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়াটিকে সহজ এবং দ্রুতগতিসম্পন্ন করার দাবি জানাচ্ছে। জাসদ ভোটার তালিকা ও জাতীয় পরিচয়পত্র একই তথ্যপঞ্জিতে সমন্বিত করা এবং হালনাগাদকৃত তথ্য সবসময় ওয়েবসাইটে প্রকাশিত রাখার দাবি জানাচ্ছে।
জাসদ প্রবাসী ভোটারদের ভোট প্রদানের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছে।
রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন প্রসঙ্গে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ গণপ্রতিনিধত্ব আদেশের কঠোর প্রয়োগ করে ধর্মভিত্তিক ও ধর্মীয় পরিচয়ে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল এবং এ ধরনের দলকে নিবন্ধন না দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে। গণপ্রতিনিধত্ব আদেশ অনুযায়ী কঠোরতা প্রয়োগ করে একই নাম বা কাছাকাছি নামে কোন রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন না দেওয়ার দাবিও জানাচ্ছে।
এছাড়া নির্বাচনে ধর্মের ব্যবহার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করার দাবি জানাচ্ছে। নির্বাচনী ব্যয়সীমা যৌক্তিকীকরণ এবং আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে অবৈধ অর্থের ব্যবহার বন্ধের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ, নির্বাচনকালে নির্বাচন কমিশনের চাহিদা মতো নির্বাহী বিভাগকে নির্বাচন কমিশনের অধীনে ন্যাস্ত, নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন ও অসদাচারণের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান, নির্বাচনকালে জনপ্রশাসনের কাজে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে বিচারিক ম্যাজিষ্ট্রেটদের অধীনে ব্যবহার করার দাবি করে জাসদ।
সংলাপে জাসদের নেতারা ছাড়াও প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি), চার নির্বাচন কমিশনার ও ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।