এক সকালে রাজধানীর ব্যস্ত ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। ফল বিক্রেতার কাছে ঘুরে দাঁড়িয়ে এক মা তাঁর সন্তানের জন্য আপেল কিনছেন। ঠিক পাশেই, একটি ছোট খাবারের দোকানের সামনে দেখা গেল বিশাল গ্যাস সিলিন্ডারসহ একজন ব্যবসায়ী দোকান সাজিয়ে বসে আছেন এবং আরেকদিকে একটি ছোট পোশাকের দোকান, ইলেকট্রনিক্সের পণ্যের ভিড়—সব কিছু যেন ফুটপাতকে ব্যবসায়ীদের মেলা হিসেবে রূপান্তরিত করেছে। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত ছিল, কিছু বাইক চালক ফুটপাতকে রাস্তার মতো ব্যবহার করছে। দিব্যি হর্নও বাজাচ্ছে। এমন দৃশ্য দেখে মনে প্রশ্ন হলো, পথচারীদের স্থান কোথায়? আবার দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য যে সব ফুটপাথে ব্রেইল-ট্র্যাক আছে সেসব স্থান এমন বেদখল হয়ে থাকলে, সমাজের এই জনগোষ্ঠীর অধিকার হননের দায় ভার কার ওপর বর্তাবে?
আবার মনে হলো, ফুটপাতের এই অবস্থা কি শুধু একটি সমস্যা, নাকি এর পিছনে আরও গভীর একটি গল্প রয়েছে? এই অব্যবস্থাপনার ফলে প্রতিদিন হাজারো পথচারী অসুবিধার শিকার হচ্ছেন, যার ফলে কিছু মানুষ বাধ্য হয়ে মূল সড়ক দিয়ে চলাচল করছে, যেখানে দুর্ঘটনার ঝুঁকি তাদের প্রতিটি পদক্ষেপে।
ফুটপাতের এই অরাজকতার ফলে নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের ভিড়ে পথচারীরা সঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এদিকে ফুটপাতে ব্যবসায়ীদের থেকে নিত্যদিনই মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায়ের অভিযোগ তো আছেই। ফুটপাতে বিভিন্ন দোকানের কারণে খাবারের ঠোঙা ও প্লাস্টিকের আবর্জনা পড়ে থাকে। এতে পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। অগোছালো, অযাচিত দোকানের কারণে দেশের বাহ্যিক সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক মহলে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে অনেক ব্যবসায়ী রোজগার হারাচ্ছেন, বিশেষ করে বৃষ্টির দিনে। তাদের মালামাল ভিজে নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথাও জানা যায়।
ফুটপাত ব্যবসার সঠিক ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য। আমি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান থেকে নিম্নোক্ত সমাধানটি সাজিয়েছি। আমার উদ্দেশ্য ফুটপাত ব্যবসায়ীদের বিলুপ্ত করা নয়, বরং তাদেরকে একটি ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসা, যাতে তাদের জন্য চাঁদাবাজিমুক্ত নিরাপদ জায়গার ব্যবস্থা করা যায়।
এবছরের শুরুর দিকে এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকা শহরে ফুটপাথের পরিমাণ ঢাকার দক্ষিণ সিটিতে প্রায় ১৪০ কিলোমিটার ফুটপাত রয়েছে অপরদিকে উত্তর সিটিতে রয়েছে ৩২৫ কিলোমিটার। ধরা যাক, ঢাকাসহ দেশে মোট ফুটপাত ব্যবসায়ীর সংখ্যা ৫ লাখ। প্রতিমাসের রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ যদি গড়ে ৩,০০০ টাকা (দৈনিক হিসেবে ১০০ টাকা) হিসেবে যদি সংগ্রহ করা যায় (যা পূর্বে চাঁদাবাজদের দিতে হতো), তাহলেও বছরে ১৫০ মিলিয়ন ডলার রেভিনিউ সংগ্রহ করা সম্ভব বলে আশা করা যায়। যদি দৈনিক ১০০ টাকার পরিবর্তে ৩০০ টাকা করে নেওয়া যায়, তবে এর পরিমাণ কতো হতে পারে? কমপক্ষে ৪৪৫ মিলিয়ন ডলার, যা প্রায় অর্ধ বিলিয়ন। এই পরিমাণ টাকা দিয়ে কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের সমান খরচ অনায়াসে উঠে আসবে।
এক নতুন সূচনা
ফুটপাত ব্যবসার সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সরকার যেমন রেভিনিউ কালেক্ট করতে পারবে, তেমনি ব্যবসায়ীরা পাবেন চাঁদাবাজিমুক্ত নিরাপদ জায়গা। এই উদ্যোগ লাখো বেকারের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে। সরকারের এই পদক্ষেপ শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকে নয়, সামাজিক দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আসুন, আমরা ফুটপাতের সৌন্দর্য ফিরিয়ে এনে মানুষের চলাচলের স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করি এবং একটি সুস্থ ও সুশৃঙ্খল নগর জীবনের ভিত্তি তৈরি করি। ফুটপাতের এই পরিবর্তন আমাদের সবার জন্য একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে।
*লেখক: শিক্ষার্থী, সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়