নভেম্বর ২৪, ২০২৪, ০৩:২২ পিএম
জাতিসংঘের কপ২৯ জলবায়ু সম্মেলন শেষ হতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে আরও ৩৩ ঘণ্টা বেশি সময় লেগেছে। এই দীর্ঘ সময় আলোচনার কারণ ছিল উন্নত ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে সমঝোতার অভাব। অবশেষে সম্মেলনে ধনী দেশগুলো দরিদ্র ও জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর জন্য প্রতিবছর ৩০০ বিলিয়ন ডলার অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দেয়।
ধনী দেশগুলোর এই প্রতিশ্রুতি কি আদৌ সংকটের সমাধান এনে দেবে, নাকি এটা কেবল দরিদ্র দেশগুলোর ভোগান্তিকে বৈধতা দিচ্ছে, সেই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
দরিদ্র দেশগুলোর প্রতি বৈষম্যমূলক দায়
জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মূলত দায়ী উন্নত দেশগুলোর দীর্ঘমেয়াদি শিল্পায়ন ও জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর অর্থনীতি। অথচ সংকটের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি সহ্য করতে হচ্ছে দরিদ্র দেশগুলোকে, যাদের দায় তুলনামূলকভাবে ন্যূনতম। এই ৩০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি কার্যত দরিদ্র দেশগুলোর ওপর এই অন্যায্য বোঝা বহনের দায়কেই বৈধতা দিচ্ছে।
জলবায়ু তহবিলের এই অর্থ মূলত দুর্যোগ মোকাবিলা ও অভিযোজন সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ব্যবহার হবে। তবে এই অর্থ সংকটের মূল কারণ, যেমন জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ, কিংবা নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার, সেসব ক্ষেত্রে বাস্তব অগ্রগতি আনতে ব্যর্থ।
বিশ্বের প্রায় ২০০ দেশের প্রতিনিধিরা এই চুক্তিতে সম্মত হলেও, অনেক দেশ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে। ভারতের প্রতিনিধি লীলা নন্দন চুক্তির প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, “আমাদের বাঁচার জন্য যা দরকার, তার জন্য এই চুক্তি মোটেও যথেষ্ট নয়।”
সুইজারল্যান্ড, মালদ্বীপ, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াসহ বেশকিছু দেশ প্রতিবাদ জানায়। তাদের অভিযোগ, জীবাশ্ম জ্বালানির বৈশ্বিক ব্যবহার কমিয়ে আনার জন্য চুক্তিতে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তা খুবই দুর্বল।
উন্নত দেশগুলোর শর্ত: অর্থের বিনিময়ে প্রভাব
যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো দেশগুলো অর্থায়নের শর্ত হিসেবে দরিদ্র দেশগুলোর ওপর জীবাশ্ম জ্বালানি কমানোর জন্য চাপ বাড়াচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে দরিদ্র দেশগুলোর অর্থনৈতিক কাঠামো এখনও অনেকটাই জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর। তাই এই শর্ত বাস্তবায়ন তাদের জন্য আরও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
এই সম্মেলনেও জীবাশ্ম জ্বালানি কমানোর বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেও হয়নি। এ নিয়ে সিদ্ধান্ত ২০২৫ সালে পরবর্তী সম্মেলনের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে। অথচ জলবায়ু সংকট সমাধানে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
জলবায়ু সংকটের সমাধান কি আদৌ হচ্ছে?
৩০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি শুনতে মহৎ মনে হলেও এটি কেবল অস্থায়ী প্রতিকার হিসেবে কাজ করবে। জলবায়ু সংকট সমাধানে বৈশ্বিক পদক্ষেপ দরকার, যা জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভরতা কমানো, নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের প্রসার, এবং উন্নত দেশগুলোর থেকে ন্যায্য সহযোগিতা নিশ্চিত করবে।
বর্তমানে ধনী দেশগুলো প্রতিবছর জলবায়ু তহবিলে ১০০ বিলিয়ন ডলার দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। গত শুক্রবার খসড়া চুক্তিতে তা বাড়িয়ে ২৫০ বিলিয়ন ডলার করার প্রস্তাব দেয়া হয়। এতে আপত্তি জানায় উন্নয়নশীল দেশগুলো। তাদের দাবি ছিল বছরে ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার।
ধনী দেশগুলো টাকা বাড়াতে রাজি না হওয়ায় শনিবার, ২৩ নভেম্বর বিকেলে নাটকীয়ভাবে সম্মেলন বর্জনের ঘোষণা দেয় উন্নয়নশীল এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বেশি ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলো। তবে পরে তারা আবার আলোচনায় ফেরে।
ছোট ছোট দ্বীপ রাজ্যগুলোর যে জোট তার প্রধান সেডিরক সুসটার ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, “দ্বীপগুলো ক্রমেই ডুবে যাচ্ছে, মোটেও বাড়িয়ে বলছি না। একটা দুর্বল চুক্তি নিয়ে আমরা আমাদের দেশের জনগণের কাছে কিভাবে ফিরে যেতে পারি।”
এই অর্থায়ন আসলে দরিদ্র দেশগুলোর ওপর চাপানো একটি বোঝা বৈধ করার পথে আরেকটি পদক্ষেপ। এটি সংকটের মূল কারণকে স্পর্শ না করে সমস্যাটিকে দীর্ঘায়িত করছে।
পরবর্তীতে জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় সমাধান খোঁজার চেয়ে, এই অর্থায়ন যেন উন্নত দেশগুলোর দায়মুক্তির অজুহাত হয়ে না দাঁড়ায়, সেটি নিশ্চিত করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
এবারে কপ২৯ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে। গত ১১ নভেম্বর থেকে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তবে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে আরও ৩৩ ঘণ্টা পরে সম্মেলন শেষ হয়।