আনিসুল হক সড়ক: তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ড সংলগ্ন অসুস্থ পরিবেশ ও নিরাময়ের পথ

মো: তুহিন আলম

নভেম্বর ১৮, ২০২৪, ১০:৪৮ পিএম

আনিসুল হক সড়ক: তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ড সংলগ্ন অসুস্থ পরিবেশ ও নিরাময়ের পথ

ছবি: লেখকের সৌজন্যে

আপনি যখন তেজগাঁওয়ের আনিসুল হক সড়ক দিয়ে চলতে বের হবেন, তখন মনে হবে আপনি যেন এক যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করছেন। রাস্তার দু‍‍`পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল ট্রাকগুলো যেন অশুভ আত্মার মতো, রাস্তার মাঝখানে একে অপরের বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটি সময় শহরের অন্যতম ব্যস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ সড়কটি, আজ যেন এক অসহনীয় বিপর্যয়ের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাস্তার সিংহভাগ অংশে বিশাল সব ট্রাক গিজগিজ করে দাঁড়িয়ে আছে, আর বাকি কিছু জায়গায় চলাচল করছে রিকশা, লেগুনা, প্রাইভেট কার। একটি জনবান্ধব সড়ক কার্যত হয়ে উঠেছে এক অদৃশ্য যুদ্ধক্ষেত্র—একদিকে যানবাহনের সমস্যা, অন্যদিকে পরিবেশের বিপর্যয়, আর এর মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে থাকা জনদুর্ভোগ। এই স্থানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে যানজট, যার প্রধান কারণ ট্রাক স্ট্যান্ডের অস্বাভাবিক ব্যবস্থাপনা।

উক্ত সড়কের এই অব্যবস্থাপনার কারণে সাধারণ জনগণ প্রতিদিন বেশ কিছু ভয়াবহ সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে:

১. যানজটের অসহনীয়তা: সিংহভাগ জায়গাজুড়ে ট্রাক থাকায় অত্র এলাকার যানজট এতটাই দুঃসহনীয় হয়ে পড়েছে, যা অনেক সময় স্বৈরাচারী আচরণের মতো মনে হয়। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো ট্রাক আড়াআড়ি অবস্থানে থাকার কারণে রাস্তা সরু হয়ে যানজট সৃষ্টি হয়। আবার কখনো ট্রাক ঘুরানোর বা পার্কিংয়ের সময় পুরো রাস্তায়ই জ্যাম সৃষ্টি হয়। এই কারণে সাধারণ মানুষ নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, যেমন: নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছানো, রিকশাচালকদের আয় কমে যাওয়ায় অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ ইত্যাদি।

২. ছিনতাইকারীর কবলে পড়ার ভয়: ফুটপাত দখল করে রাখা ট্রাকের পিছনের অংশের কারণে উক্ত স্থানের ফুটপাত দিয়ে নাগরিকদের হেঁটে চলাচল অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে ওঠে। বিশেষত, পায়ে হেঁটে চলাচলকারী নাগরিকরা হর হামেশাই ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে। সন্ধ্যার পর এসব ফুটপাত আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, ফলে মানুষ নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে চরম চিন্তিত হয়ে পড়েন।

৩. ময়লা-আবর্জনা ও পরিবেশ দূষণ: ট্রাকগুলো দীর্ঘ সময় সড়কের এক জায়গায় থেমে থাকায় সেখানে ময়লা-আবর্জনা জমতে থাকে। অধিকাংশ জায়গা জুড়ে ট্রাক থাকার কারণে, ট্রাকের আড়ালে জমে থাকা ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করতে অক্ষম পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। এতে করে এই ময়লাগুলো পঁচে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

সমাধান:

বিশ্বমানের পদ্ধতির সাথে মিল রেখে এবং কার্যকরী পরিকল্পনার মাধ্যমে এই সমস্যাগুলোর সমাধান করা সম্ভব। উন্নত দেশগুলোর মেগাসিটিতে যে ধরনের রাস্তা ব্যবস্থাপনা এবং পরিবহন ব্যবস্থা দক্ষতার সাথে পরিচালিত হয়, তেমন একটি মডেল প্রয়োগ করে তেজগাঁওয়ের এই সড়কটি পুনরায় জনবান্ধব করা সম্ভব।

পদ্ধতি-১: ট্রাকগুলো রাখার জন্য উক্ত সড়ক থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে উন্নতমানের স্ট্যান্ড গড়ে তোলা, যার দৃষ্টান্ত বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর রয়েছে, যেখানে অল্প জায়গাতেই অনেক বেশি গাড়ি পার্কিং করা সম্ভব। তবে, কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উক্ত ট্রাক স্ট্যান্ড পরিচালনা করতে হবে। প্রতিষ্ঠানটি সরকারি বা আধা-সরকারি হতে পারে। উক্ত ট্রাক স্ট্যান্ড থেকে প্রতি ঘণ্টা অনুসারে যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করা সম্ভব, সেই অর্থ দিয়ে দেশকে আরও বেশি সমৃদ্ধ করা এবং বেকারত্বের সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে। সেই সাথে জনদুর্ভোগের সমাধান হবে।

পদ্ধতি-২: যদি নিতান্তই রাস্তার পাশে ট্রাক পার্কিং করতে হয়, সেক্ষেত্রে কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করার মাধ্যমে উপরোক্ত সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব। ট্রাকগুলো রাস্তার পাশে রাখতে চাইলে, নির্দিষ্ট বর্ডার এবং নির্দিষ্ট দূরত্ব অবলম্বন করে রাস্তার সাথে মিল রেখে সারিবদ্ধভাবে রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, গাড়িগুলো কোনোভাবেই যেন নির্দিষ্ট বর্ডার ক্রস না করে। এক্ষেত্রে একটি বর্ডার থেকে অন্য আরেকটি বর্ডারের দূরত্ব কমপক্ষে ৪-৫ ফুট হতে হবে, যাতে করে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে চলা ব্যক্তিগণ এবং যানবাহনে চলাচলকারী ব্যক্তিগণ একে অপরকে খেয়াল রাখতে পারে। এতে ছিনতাইকারীর আক্রমণ হবে না এবং ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর ডাস্টবিন বসাতে হবে। কোনো ব্যক্তি যেন যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা না ফেলে সে বিষয়ে সতর্কতামূলক বাণী লিখতে হবে। ট্রাকগুলো যেন বর্ডার ক্রস না করে, তার জন্য কঠোর নজরদারি করতে হবে।

বাস্তবায়ন: এই বিষয়গুলো কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে একটি দক্ষ দল গঠন করা জরুরি, যার মূল লক্ষ্য হবে:

  • গাড়িগুলো যেন কোনো অবস্থাতেই বর্ডার ক্রস না করে, সেদিকে খেয়াল রাখা। অন্যথায় জরিমানা আদায় করা।
  • গাড়িগুলো প্রথম এক ঘণ্টা বিনামূল্যে পার্কিং করতে পারবে এবং পরবর্তী সময়ের জন্য প্রতি ঘণ্টায় নির্দিষ্ট চার্জ গ্রহণ করা।
  • কেউ যেন ময়লা বা আবর্জনা যেখানে-সেখানে না ফেলে, সে বিষয়ে ২৪ ঘণ্টা নজরদারি করা এবং অবাধ্য হলে জরিমানা আরোপ করা।
  • পাশাপাশিভাবে নিয়মিত টহল দেওয়া, যাতে ছিনতাইকারীরা কোনো ধরনের আধিপত্য স্থাপন করতে না পারে।
  • কমিউনিটি পুলিশিং জোরালো করা যেতে পারে।

উপরোক্ত পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করতে পারলে, পরিবেশদূষণ, যানজট, ছিনতাইকারীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার পাশাপাশি দেশকে আরও বেশি সমৃদ্ধ, পরিচ্ছন্ন এবং সুবিন্যস্ত রাখা সম্ভব। সেই সঙ্গে দেশের বেকারত্ব সমস্যা দূর করা যাবে।
একটি পূর্ণাঙ্গ মডেল অবলম্বন করে সারা দেশব্যাপী এই সমস্যার সমাধান যেমন সম্ভব, ঠিক তেমনি অনেক কর্মসংস্থান (সরাসরি ১০,০০০ লোকের এবং হাজার কোটি রেভিনিউ সংগ্রহ) তৈরি করা এবং পরিবেশবান্ধব শহর গড়ে তোলা সেটাও সম্ভব।

পূর্বে অনেক চেষ্টার পরও জনগণকে এই অভিশাপ থেকে মুক্তি দেওয়া যায়নি। খোদ যার নামে তেজগাঁওয়ের এই সড়ক, তিনি নিজেও চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু চরম বাস্তবতা হলো, তিনি বিগত হওয়ার পর থেকে দেখা যায়, আগের অবস্থাতে ফিরে গেছে তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ড। শুধু বারবার হেরে যাচ্ছেন সাধারণ জনগণ।

*লেখক: শিক্ষার্থী, সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয় 

  • লেখায় প্রকাশিত মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব। লেখাটি  দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের সম্পাদকীয় অবস্থানের প্রতিফলন ঘটায় না।
Link copied!