যুক্তরাজ্যের আবাসন খাতেই হাসিনা-ঘনিষ্ঠদের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ: গার্ডিয়ান

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ডিসেম্বর ১, ২০২৪, ০৩:৫৬ পিএম

যুক্তরাজ্যের আবাসন খাতেই হাসিনা-ঘনিষ্ঠদের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ: গার্ডিয়ান

ছবি: সংগৃহীত

৫ আগস্ট বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে করে আকাশপথে যখন দেশ থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময়ে বাংলাদেশের বিক্ষুব্ধ জনতা তার বিলাসবহুল বাসভবন ‘গণভবনে’ গিয়ে হামলে পড়েছিল।  

শেখ হাসিনার একটানা প্রায় ১৬ বছরের রেজিমের অবসান ঘটে এক রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মাধ্যমে। জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাজারের অধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে, আহত হয় আরও অসংখ্য ছাত্র-জনতা। গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার।

অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, হাসিনার গত ১৬ বছরের রেজিমে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। বাংলাদেশের ব্যাংক খাত থেকে শুরু করে সামগ্রিক অর্থনীতি পঙ্গু করে ফেলেছে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ঘনিষ্ঠ বলয়ের মধ্যে থাকা সাবেক মন্ত্রীসহ রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীরা।

কেবল যুক্তরাজ্যের আবাসন খাতে এসব লুটেরাদের বিনিয়োগ করা সম্পত্তির পরিমাণ ৪০ কোটি পাউন্ডের বেশি, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। প্রকৃতপক্ষে এর পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে। বাংলাদেশ থেকে পাচার করা অর্থ দিয়ে এসব সম্পত্তি কেনা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম অবজারভার ও বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের যৌথ অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

৩০ নভেম্বর, শনিবার যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান এই অনুসন্ধান নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।  

অবজারভার ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের অনুসন্ধানে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যে শেখ হাসিনা–ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের নামে প্রায় ৩৫০টি সম্পত্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। এসবের মধ্যে যেমন সুরক্ষিত আবাসিক ফ্ল্যাট রয়েছে, তেমনি রয়েছে সুবিশাল অট্টালিকা বা বিলাসবহুল ম্যানশন। যুক্তরাজ্য ও দেশটির বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ অফশোর কোম্পানির নামে এগুলো কেনা হয়েছে। 

আরও পড়ুন: দেউলিয়া হওয়ার পথে শতাধিক দেশ 

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে কেনা ওই সম্পত্তির অনেকগুলোর মালিকানায় রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের পরিবারের সদস্যরা। এ ছাড়া সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার ও তাদের পরিবারের সদস্যদেরও অনেক সম্পত্তির মালিকানা রয়েছে।

অনুসন্ধানে বিভিন্ন ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানের নিয়ম-কানুন নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে প্রধান ব্যাংক, আইন সংস্থা এবং রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠানগুলো। যারা হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি লেনদেনে সহায়তা করার জন্য বড় অঙ্কের ফি উপার্জন করে। 

সাবেক মন্ত্রী সালমান এফ রহমান বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান। ধারণা করা হয়ে থাকে, তিনি ছিলেন হাসিনা সরকারের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অন্যতম। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর নৌপথে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে তিনি কারাবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগে তদন্ত করছে বাংলাদেশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। এ ছাড়া সালমান ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-বিএফআইইউ।

অনুসন্ধান অনুযায়ী, সালমানের পরিবারের সদস্যদের লন্ডনের মেফেয়ার এলাকার গ্রোসভেনর স্কয়ারে সাতটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের মালিকানা বা মালিকানায় অংশীদারত্ব রয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগই অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে কেনা। এর মধ্যে ২০২২ সালের মার্চ মাসে ২ কোটি ৬৭ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ডে একটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছিলেন সালমানের ছেলে আহমেদ শায়ান রহমান। সেখানে ৩ কোটি ৫৫ লাখ পাউন্ডে কেনা তাঁর একটি ফ্ল্যাটও রয়েছে। ২০২২ সালে খবর বেরিয়েছিল, লন্ডনে শায়ান রহমানের একটি বাড়িতে বিনা ভাড়ায় থাকতেন শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা।

গ্রোসভেনর স্কয়ারে এবং এর কাছাকাছি এই পরিবারের আরেক সদস্য আহমেদ শাহরিয়ার রহমানের আরও চারটি সম্পত্তি রয়েছে। এর মূল্য ২ কোটি ৩০ লাখ পাউন্ড। অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে এসব সম্পত্তি কেনা। এ বিষয়ে শায়ান রহমান ও শাহরিয়ার রহমানের আইনজীবীরা বলেছেন, মানি–লন্ডারিং আইনসহ আর্থিক বিধিবিধান পরিপূর্ণভাবে মেনেই সম্পত্তিগুলো কেনা হয়েছে।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যের ভূমি নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁর পরিবারের ৩০০টির বেশি সম্পদ রয়েছে। এগুলোর মূল্য অন্তত ১৬ কোটি পাউন্ড। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বৈশ্বিক সম্পত্তি নিয়ে গত সেপ্টেম্বরে ‘দ্য মিনিস্টার্স মিলিয়নস’ শিরোনামের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিদেশে থাকা তাঁর সম্পত্তির মূল্য আনুমানিক ৫০ কোটি মার্কিন ডলার। 

আরও পড়ুন: ভিওএ জরিপ: ৪৪.৭% মানুষ মনে করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তী সরকার ‘আগের সরকারের তুলনায় খারাপ করছে’  

বাংলাদেশে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ব্যাংক হিসাবও জব্দ করেছে বিএফআইইউ। তার ও তার পরিবারের সদস্যদের স্থাবর সম্পত্তি জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ওপর দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। এ ছাড়া অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ অর্জনের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

গার্ডিয়ান বলেছে, রাজনীতিকদের বাইরে বাংলাদেশের ধনী ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদেরও যুক্তরাজ্যে সম্পত্তি রয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যের সারে এলাকায় বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের পরিবারের সদস্যদের দুটি সম্পত্তি রয়েছে। ১ কোটি ৩০ লাখ পাউন্ড দিয়ে অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে এসব সম্পত্তি কেনা হয়েছে। এ ছাড়া এলাকাটি পরিদর্শনের সময় আহমেদ আকবর সোবহানের এক ছেলের মালিকানাধীন একটি অট্টালিকার সন্ধান পেয়েছে অবজারভার।

গত ২১ অক্টোবর আহমেদ আকবর সোবহানসহ তার পরিবারের ছয় সদস্যের ওপর দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এ ছাড়া তাঁদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বিএফআইইউ। এ বিষয়ে গার্ডিয়ান–এর সঙ্গে কথা বলেছেন বসুন্ধরা গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ও আহমেদ আকবর সোবহানের ছেলে সাফওয়ান সোবহান। তিনি বলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে তোলা সব অভিযোগ দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করছে তাঁর পরিবার।

এদিকে নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগে তদন্ত করছে সিআইডি। দেশটিতে তাঁর সম্পত্তিও জব্দ করা হয়েছে। লন্ডনের কেনসিংটনে তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা কীভাবে ৩ কোটি ৮০ লাখ পাউন্ডের পাঁচটি সম্পত্তি কিনেছেন তা খতিয়ে দেখতে চায় বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তবে নজরুল ইসলাম মজুমদারের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, অবৈধ উপায়ে এসব সম্পত্তি কেনার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি।

Link copied!