যেভাবে ইতিহাসে ঠাঁই করে নেয় মুজিবনগর সরকার

হাসনাত আসিফ কুশল

এপ্রিল ১৬, ২০২৪, ০৮:৩২ পিএম

যেভাবে ইতিহাসে ঠাঁই করে নেয় মুজিবনগর সরকার

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম

১৯৭০ সালের নির্বাচনই পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম ও শেষ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত নির্বাচন। এর আগে ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক নির্বাচন হয়েছে। তা যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন নামে ইতিহাসে সমধিক পরিচিত। ‘৭০’র নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে টালবাহানা করতে থাকে। এই টালবাহানার কারণে পাকিস্তানের রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগ নেতারা ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার দাবি তুলতে থাকেন। কিন্তু ষড়যন্ত্র করতে থাকেন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো।

আরও পড়ুন: মুর্শিদাবাদ-কথা: যেভাবে যাবেন, যা দেখবেন

১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের দাবি তোলেন। কিন্তু শেখ মুজিবের এই দাবি মেনে নিতেও ইয়াহিয়া খানের অনীহা ছিল। নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমানের দাবি অনুযায়ী জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকলেন। এদিকে অধিবেশন ডাকার পরেও নাজুক পরিস্থিতির সুযোগ খুঁজছিলেন ইয়াহিয়া। পেয়েও গেলেন। ২৮ ফেব্রুয়ারি জুলফিকার আলী ভুট্টো এক সংবাদ সম্মেলনে বলে উঠলেন, ‘৩ মার্চ যদি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হয়, তাহলে পরিষদ কক্ষ কসাইখানায় পরিণত হবে।’ এছাড়া তিনি আরও বলেন, ‘৩ মার্চ অধিবেশন হলে করাচি থেকে খাইবার পর্যন্ত আগুন জ্বলবে।’

মুজিবনগর সরকারের সদস্যরা

কাঙ্ক্ষিত সুযোগ লুফে নিয়ে ১ মার্চ, ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন ইয়াহিয়া খান। ঠিক একই দিন দুপুর দুইটার দিকে ঢাকার মতিঝিলে হোটেল পূর্বানীতে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক করছিলেন শেখ মুজিব। ইয়াহিয়ার এই ঘোষণার খবর পাওয়া মাত্রই তিনি ২ মার্চ থেকে পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে ২ মার্চ অর্ধদিবস ও ৩ মার্চ পূর্ণদিবস হরতাল ঘোষণা করা হয়। এছাড়া ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রথম স্বাধীন বাংলার মানচিত্রখচিত লাল-সবুজ পতাকা উত্তোলন করেন ডাকসুর তদানীন্তন সহ-সভাপতি (ভিপি) আ স ম আবদুর রব। এই পতাকার নকশা আঁকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের (বর্তমান শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ১১৬ নং কক্ষে রাত ১১টার দিকে শিবনারায়ণ দাস। স্বাধীনতাউত্তর জাতীয় পতাকার গোলার্ধে মানচিত্র বাদ দিয়ে নতুন করে নকশা তৈরি করেন পটুয়া কামরুল হাসান।

আরও পড়ুন: পূর্ব পাকিস্তানে আলোচনার নামে কালক্ষেপণ

১৯৭১ সালের ২-৬ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে ধারাবাহিকভাবে হরতাল পালিত হয়। এ সময় পাকিস্তানি কারাগার থেকে বন্দী পলায়ন ঘটতে থাকে। পাকিস্তানি প্রশাসনের এমনই নাজেহাল অবস্থার মুখে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ঐতিহাসিক ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৯ মার্চ পল্টন ময়দানে যুগান্তকারী ভাষণ দেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।

আরও পড়ুন: অপারেশন সার্চলাইট কার চক্রান্তে?

২২-২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে বৈঠকের নামে ইয়াহিয়া খান কালক্ষেপণ করতে থাকেন। একদিকে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক, অন্যদিকে ঢাকা শহরে সেনাবাহিনীর অস্বাভাবিক গতিবিধি পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণকে শঙ্কিত করে তোলে। ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের নির্দেশ দিয়ে অতি গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন ইয়াহিয়া খান।

শপথ নেওয়ার পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়

‘৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১১টার দিকে অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ফার্মগেটে ছাত্র-জনতার মিছিলকে লক্ষ্য করে শুরু হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রথম আক্রমণ। এরপর রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, তোপখানা রোড, নাজিমুদ্দিন রোড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গণহত্যা চলতে থাকে। ২৬ মার্চ দিবাগত রাত একটার দিকে টেলিগ্রাম সহযোগে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ ঘটনার অব্যবহিত সময় পরেই তিনি গ্রেপ্তার হন। ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান ও তদানীন্তন মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।

‘৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার ভবেরপাড়া এলাকায় শপথ গ্রহণ করেন এই সরকারের মন্ত্রীরা। সেদিন থেকে বৈদ্যনাথতলা ইতিহাসে ‘মুজিবনগর’ হিসেবে ইতিহাসে ঠাঁই করে নেয়।

মুজিবনগর প্রবাসী সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা হলেন:
রাষ্ট্রপতি: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান;
উপ-রাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি): সৈয়দ নজরুল ইসলাম;
প্রধানমন্ত্রী: তাজউদ্দিন আহমেদ;
অর্থমন্ত্রী: ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী;
স্বরাষ্ট্র, কৃষি এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী: এ এইচ এম কামারুজ্জামান;
পররাষ্ট্রমন্ত্রী: খন্দকার মোশতাক আহমেদ;
সেনা প্রধান: এম এ জি ওসমানী।

Link copied!