নবাবি আমলের প্রাচীন পুরাকীর্তি দেখতে হলে যেতে মুর্শিদাবাদ। এই মুর্শিদাবাদের আছে বর্ণাঢ্য ইতিহাস। কখনও মাকসুদাবাদ, কখনওবা কর্ণসুবর্ণ। মুর্শিদাবাদের পথঘাট যেন ইতিহাসময়।
নবাব মুর্শিদকুলি খান ১৭১৭ সালে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন।
নবাবি আমলে নবাবরা মুঘল সম্রাটের দুর্বলতার সুযোগে অনেকটাই স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনা করতেন। মুর্শিদাবাদে দর্শনার্থীদের ভ্রমণের জন্য বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থান আছে। এসব স্থানে যাওয়ার উপায় নিয়েই আজকের আয়োজন।
কলকাতা থেকে সকাল ছয়টা ৫০ মিনিটে হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেসের আপ ট্রেনে চেপে মাত্র সাড়ে ৩ ঘণ্টায় পৌঁছে যাবেন মুর্শিদাবাদ।
শিয়ালদহ, ব্যারাকপুর, রাণাঘাট হয়ে মুর্শিদাবাদে দ্বিতীয় ক্লাস সিটিং রিজার্ভেশনের ভাড়া মাত্র ৯০ টাকা।
এছাড়া উত্তর ২৪ পরগনা বা নদীয়ানিবাসীদের জন্য রাণাঘাট স্টেশন থেকে সকাল নয়টা ২০ মিনিটে একটা মুর্শিদাবাদ স্পেশাল ট্রেন আছে। এখানে ভাড়া মাত্র ৩৫ টাকা। ট্রেনটি বনগাঁ থেকে রাণাঘাটে যায় স্পেশাল ট্রেন হিসেবে এবং এরপর এই ট্রেন রাণাঘাট-লালগোলা হয়ে সকাল ১১টা ৫০ মিনিটে মুর্শিদাবাদে পৌঁছে যায়।
মুর্শিদাবাদের ভেতরে ঘোড়ার গাড়ি ও নৌকায় করে ঘোরাঘুরি করা যায়। ঘোড়ার গাড়ি সারাদিনের জন্য মাত্র ১ হাজার টাকা দিয়ে রিজার্ভ করতে হয়। নৌকা ভাড়াও একেবারেই কম। সব মিলিয়ে অল্প কিছু টাকার মধ্যেই মুর্শিদাবাদে ভ্রমণ করা যায়।
মুর্শিদাবাদে তো গেলেনই। এবার আসুন, জেনে নিই নবাবি আমলের এই শহরে দেখার মতো কী কী আছে। কালের স্বাক্ষী হয়ে আছে মুর্শিদাবাদ। এই মুর্শিদাবাদ যেমন দেখেছে বিশ্বাসঘাতকতা আর ক্ষমতালোভীদের আস্ফালন, তেমনই শিখিয়েছে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে আনুগত্য প্রদর্শন করে মীর মদন, মোহন লাল, ফরাসি সেনাপতি সিনফ্রের মতো যোদ্ধাদের দেশপ্রেম। এই মুর্শিদাবাদেই আছে নবাবদের অনেক স্মৃতি। বিশ্বাসঘাতক-বংশের পুতুল নবাবদের দাপটের সাক্ষ্যও দেয় এই মুর্শিদাবাদ। একসময় যেখানে শহরটি বাংলার রাজধানী ছিল, সেখানে সেই একই শহর এখন সাদামাটা জৌলুসহীন মফঃস্বল শহর। একসময় যেখানে ঘোড়ার গাড়ি হাঁকিয়ে নবাব ও তার সঙ্গীসাথীরা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করতেন, সেখানে মোটরগাড়ি-বাস-টেম্পুর ভিড়ে সেই দৃশ্য এখন অনেকটাই অচেনা। যদিও মুর্শিদাবাদে এখনও অনেকে ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে নবাবি আমলের ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছেন।
মুর্শিদাবাদে দর্শনার্থীদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা হলো হাজারদুয়ারি প্রাসাদ। কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ যাওয়ার ‘হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেস’ নামে ট্রেনে চেপে এখানে যাওয়া যায়।
প্রাসাদটি মুর্শিদাবাদের নবাব হুমায়ূন জার আমলে নির্মিত হয়। ১৮২৯-১৮৩৭ সালের মধ্যে এই প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়।
এর নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৮২৯ সালের ৯ আগস্ট, আর শেষ হয় ১৮৩৭ সালের ডিসেম্বরে। প্রাসাদটির স্থপতি ছিলেন ডানকান ম্যাকলিওড কোম্পানি।
হাজারদুয়ারির ঠিক উল্টোদিকেই অবস্থিত ইমামবাড়া। সাদা রঙের সুবিশাল প্রাসাদ এটি। এখানে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত রয়েছে। শুধু হিজরি মুহাররম মাসে এটি খুলে দেওয়া হয়। তখন ইমামবাড়ায় অনেক লোকের সমাগম হয়। বিশেষ করে শিয়া মতাবলম্বীরা এখানে জমায়েত হন।
হাজারদুয়ারির মাঠেই ইমামবাড়া ও প্রাসাদের মধ্যে এই বড় ঘড়ি মিনার অবস্থিত। এই মিনারের ওপর বড় একটি ঘড়ি আছে। জনশ্রুতি আছে, এই ঘড়ির শব্দ শুনে মুর্শিদাবাদবাসী একসময় সময় জানতে পারতো।
আলীবর্দী খানের উত্তরাধিকারী হিসেবে তার সুযোগ্য দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলাকে নবাবি মসনদে বসানো হয় ১৭৫৬ সালে। তার সময়ের একমাত্র নিদর্শন হলো সিরাজউদ্দৌলার মদিনা। জনশ্রুতি আছে, নবাবের মা আমেনা বেগম মান্নত করেছিলেন যে তার ছেলে নবাব হলে মদিনার পবিত্র মাটি এনে বহু মূল্যবান রত্ন দিয়ে দরজা তৈরি করবেন। আরও জনশ্রুতি আছে, মীরজাফরের পর মীর কাসিম নবাব হলে রাজধানী মুঙ্গেরে স্থানান্তরের সময় মদিনার এই ধনরত্ন নিয়ে যান।
উল্লেখ্য, মদিনার এই দরজা শুধু মুহাররমে খোলা হয়। বছরের অন্য সময় বন্ধ থাকে।
নিমকহারামের দেউড়ি বলতে কোন জায়গার কথা বলছি সেটা হয় সচেতন দর্শক বুঝে গেছেন। হ্যাঁ, মীর জাফরের কথাই বলছি। যিনি নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি হওয়া সত্ত্বেও পলাশীর যুদ্ধে নিশ্চেষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। নিমকহারামের দেউড়িতেই ‘ক্লাইভের গাধা’ খ্যাত সিরাজ-পরবর্তী নবাব মীর জাফর বসবাস করতেন। এখানে মীর জাফর ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কবর আছে। তবে বড় ছেলে মীরন বিহারের রাজমহলে রহস্যজনকভাবে মারা গেলে সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়।
নিমকহারামের দেউড়িতে মীর জাফরের স্ত্রী শাহ খানম, বব্বু বেগম ও মুন্নী বেগমের সমাধি আছে। এছাড়া বড় ছেলে মীরনের প্রিয় কবুতর ও বাজপাখির সমাধিও এখানে আছে।
খোশবাগ শব্দের অর্থ ‘সুখের বাগান’ বা ‘আনন্দের বাগান’। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুশির্দাবাদে ভাগীরথী নদীর পশ্চিম তীরের প্রায় এক মাইল দূরে অবস্থিত বাংলার নবাবদের কবরস্থানের বাগান খোশবাগ নামে সমধিক পরিচিত। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে খোশবাগেই সমাহিত করা হয়েছে।
হাজারদুয়ারির উত্তরে একটি বাঁধানো বেদীতে বড় যে কামান দেখা যায়, তা ‘বাচ্চাওয়ালি তোপ’। কামানটি নবাব হুমায়ূন জার সময় নদী থেকে উদ্ধার করা হয়।
১৬৮৭ সালে জনার্দন কর্মকার এই কামান তৈরি করেছেন। এতে তিনটি চেম্বার আছে এবং কামান দাগার সময় ১৮ সের বারুদ প্রয়োজন হতো।
জনশ্রুতি আছে, কামানটি মাত্র একবার দাগা হয়েছিল এবং এর প্রচণ্ড শব্দ ১০ মাইল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। এর ভয়াবহতা এতটাই ছিল যে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের গর্ভপাত হয়ে যায়। ঠিক এই কারণে কামানটির নাম ‘বাচ্চাওয়ালি তোপ’। এর দৈর্ঘ্য ১৮ ফুট এবং ওজন ১৬ হাজার ৮৮০ পাউন্ড। এই ঘটনার পর থেকে এই কামান দাগা বন্ধ হয়ে যায়।
হাজারদুয়ারির পেছনের ফটক দিয়ে বেরিয়ে কিছুদূর হেঁটে যাওয়ার পথে ওয়াসেফ মঞ্জিল বা নিউ প্যালেস অবস্থিত। মুর্শিদাবাদের সরকারি দপ্তর হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয়। প্রাসাদটির চারপাশে বড় বাগান আছে। কিন্তু বাগানটি সেভাবে সাজানো-গোছানো নয়।
ওয়াসেফ মঞ্জিলের মতো চক মসজিদেও হাজারদুয়ারির পেছনের ফটক দিয়ে যেতে হয়। এর ভেতরে প্রবেশ করা না গেলেও বাইরে থেকে দর্শনার্থীদের ছবি বা ভিডিও করতে বাধা নেই।
১. আনন্দবাজার পত্রিকা;
২. নবাবের শহর মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ গাইড, আদার ব্যাপারী;
৩. আজ তক;
৪. ভ্রমণ;
৫. এনটিভি।