ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৫, ০৩:১০ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ‘নির্দিষ্ট সরকারকেন্দ্রীক’ হওয়া উচিত নয় বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।
ওমানের মাস্কাটে অনুষ্ঠিত অষ্টম ভারত মহাসাগর সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠকের পর তৌহিদ হোসেন বলেন, আগামী এপ্রিলে বিমসটেক সম্মেলনের সাইডলাইনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক হতে পারে।
গতকাল সোমবার ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব (২০০৬-২০০৯) দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে পরীক্ষার মুখে ফেলা একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। যার মধ্যে আছে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, শেখ হাসিনার ভারত থেকে দেওয়া বক্তব্য, সীমান্ত হত্যা, জেলেদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার এবং আদানির বিদ্যুৎ প্রকল্প সংক্রান্ত বিষয়ও।
সাক্ষাৎকারের শুরুতেই দুই দেশের সম্পর্কে উত্তেজনার মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে তৌহিদ হোসেনের সাক্ষাৎ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়।
জবাবে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘সত্যি বলতে সম্পর্ক খুবই উত্তেজনাপূর্ণ ছিল (যখন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে)। কারণ ভারত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে একটি নির্দিষ্ট ধরনের সম্পর্কে অভ্যস্ত ছিল এবং হঠাৎ করেই এতে একটা ছন্দপতন আসে। নতুন বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়তো কিছুটা সময় লেগেছে, যার ফলে সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক মনোভাব ও অস্বস্তি তৈরি হয়েছিল। তবে ছয় মাস পর, আমার মনে হয় সে সময়টা পেরিয়ে গেছে এবং এখন আমাদের এমন একটি পরিবেশ দরকার যেখানে পারস্পরিক স্বার্থে কাজ করা সম্ভব। ছয় মাস আগের তুলনায় এখন আমরা অবশ্যই আরও ভালোভাবে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি।’
যুক্তরাষ্ট্রে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাক্ষাৎ এবং দেশটির পররাষ্ট্র সচিবের মতে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের কিছু উদ্বেগ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। জয়শঙ্করের কাছে এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জানতে চেয়েছেন কি না- জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, তিনি জানতে চাননি। এটা ভারতের ব্যাপার (কোন দেশের সঙ্গে তারা কী আলোচনা করবে)।
তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় না তেমন কোনো উদ্বেগের কারণ আছে। আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করা উচিত, যা ইতোমধ্যে কিছু ক্ষেত্রে ঘটছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। বাণিজ্যে অল্প সময়ের জন্য কিছুটা জটিলতা ছিল, কিন্তু তা আবার গতি ফিরে পেয়েছে। এতে বোঝা যায় যে, দুই দেশের মানুষ অন্তত বেসরকারি খাতে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে আগ্রহী। এর অর্থ হলো, উভয় দেশেরই একে অপরের প্রতি আগ্রহ রয়েছে এবং আমাদের এটি আরও ভালোভাবে দেখভাল করা উচিত।’
বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হয় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে যে শেখ হাসিনার বিষয়ে ভারত কী করবে বলে আপনারা আশা করছেন?
জবাবে তৌহিদ হোসেন বলেন, তার (শেখ হাসিনার) বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে এবং আমরা ভারতে অনুরোধ করেছি তাকে বিচারের মুখোমুখি করতে ফেরত পাঠানোর জন্য। যতক্ষণ ভারত সরকার সেটা না করছে আমরা আশা করব তারা অন্তত তার উপর কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে যাতে তিনি উস্কানিমূলক এবং মিথ্যা বক্তব্য না দেন যা জনগণের মধ্যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। কারণ বিষয়গুলো এখনও খুবই সংবেদনশীল। গত ১৫ বছর ধরে তিনি ক্ষমতায় ছিলেন এবং মানুষ তার কর্মকাণ্ড নিয়ে খুবই ক্ষুব্ধ। তাই তারা চাইবে না তিনি বাংলাদেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করুন।’
শেখ হাসিনার বক্তব্যের কারণে একটা ‘মবকে’ শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ভাঙচুরের অনুমতি দেওয়ার পক্ষে কী যুক্তি দেবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মব তো অনেক কিছুই করতে পারে কিন্তু তাতে সরকারের কোনো সমর্থন নেই।
আপনার সরকার এখনও পর্যন্ত কেবল একটি নোট ভারবাল (কূটনৈতিক নোট) পাঠিয়েছে শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ করে। কোনো আনুষ্ঠানিক প্রত্যর্পণের অনুরোধ করা হবে কি- এর জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমাদের একটা প্রত্যর্পণ চুক্তি আছে, এবং আমরা অনেক অভিযুক্তকে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য ভারতে ফিরিয়ে দিয়েছি, এবং আমি মনে করি ভারত তাকে (হাসিনা) বাংলাদেশে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য ফেরত দিতে পারে।
পররাষ্ট্রনীতির একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে এবং বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে বিশেষ করে ২০০৯ সালের পর ভারত-বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে, আপনি কি মনে করেন দুই দেশ আগের মতো সেই সম্পর্কে ফিরে যেতে পারবে?
এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, অতীতে কেবল ১৫ বছর কেন দেখতে হবে? বিএনপির সময় (১৯৯৬-২০০১) এমনকি দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ব্যাপকভাবে বেড়েছিল। আমি মনে করি না যে সম্পর্কটি ‘নির্দিষ্ট সরকারকেন্দ্রীক’ হওয়া উচিত। ১৯৯৬-৯৭ সালে আমরা গঙ্গা পানি চুক্তি করেছি। তাই আমি মনে করি, যেই সরকার বা যে রাজনৈতিক দলই দুই দেশের ক্ষমতায় থাকুক না কেন তা আমাদের সম্পর্ককে প্রভাবিত করা উচিত নয়, কারণ নির্বাচন পারস্পরিক স্বার্থ ও সম্মানের ভিত্তিতে হয় এবং আমি বিশ্বাস করি যে আমাদের উভয় পক্ষই বুঝতে পারে তাদের স্বার্থ কী এবং আমরা ভারতের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে পারি।