মে ২৫, ২০২৫, ০৭:১০ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
দৃশ্যত এটি ছিল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং দেশের তিন বাহিনীর প্রধানদের মধ্যে একটি রুদ্ধদ্বার নিয়মিত বৈঠক।
তবে ২০ মের এ বৈঠক এমন সময় অনুষ্ঠিত হয়েছে, যখন সরকারের ভেতরের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত এমন একাধিক কর্মকর্তা আল–জাজিরাকে জানান, ঢাকায় ক্রমবর্ধমান ক্ষমতার এক দ্বন্দ্ব চলছে। এ উত্তেজনাকে দেশের সামাজিক ও মূলধারার গণমাধ্যমে অন্তর্বর্তী প্রশাসন এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে একধরনের ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এই টানাপোড়েন এখন ইউনূসের নেতৃত্বের ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ৯ মাস আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে অপসারণের পর সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন তিনি।
শেখ হাসিনা তার ১৫ বছরের শাসনামলের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের মুখে ২০২৪ সালের আগস্টে ভারতে পালিয়ে যান। তার বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনা সংঘটনের অভিযোগ উঠেছে।
ইউনূস পদত্যাগ করার কথা ভাবছেন—এমন গুজব ছড়ানোর মধ্যে ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তবে গতকাল শনিবার উপদেষ্টা পরিষদের আরেক বৈঠকের পর পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা আমাদের সঙ্গেই আছেন, তিনি পদত্যাগের কথা বলেননি, অন্য উপদেষ্টারাও আছেন, আমরা আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছি।’
চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের রুদ্ধদ্বার একটি বৈঠকের পর ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এ বক্তব্য দেন। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ অচলাবস্থা এখনো কাটেনি।
দেশের সাম্প্রতিক অস্থিরতা এবং নির্বাচনী গণতন্ত্রে ফেরার ক্ষেত্রে দেশের অপরিপক্ব প্রচেষ্টার ওপর এর কী প্রভাব, তা খতিয়ে দেখা যাক:
সেনাবাহিনী ও সরকারের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে কেন
২০২৪ সালের জুলাই থেকে দেশে সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে। গণবিক্ষোভের জের ধরে পরের মাসে শেখ হাসিনা ক্ষমতা থেকে অপসারিত হন। সেই সময় বেসামরিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়ে। পুলিশ বাহিনী দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকে, বহু থানায় পুলিশ সদস্যরা অনুপস্থিত থাকেন ও জনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। এ অবস্থায় সেনাবাহিনী মোতায়েন অব্যাহত রাখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
যদিও গত আগস্টের মাঝামাঝি পুলিশ আবার কার্যক্রম শুরু করেছে, তারপরও দেশে চলমান অস্থিরতার কারণে বেসামরিক-সামরিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি বজায় রাখা হয়েছে।
গত বুধবার সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান খোলাখুলি আহ্বান জানিয়ে বলেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। তিনি সতর্ক করে বলেন, সেনাবাহিনীকে দীর্ঘ সময় ধরে বেসামরিক কাজে নিয়োজিত রাখলে তা দেশের প্রতিরক্ষা দুর্বল করতে পারে।
ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেনারেল ওয়াকার ঢাকার ক্যান্টনমেন্টে উচ্চপর্যায়ের এক সভায় বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। এটি শুধু একটি নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেই সম্ভব, অনির্বাচিত সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের মাধ্যমে সম্ভব নয়।’ সেনাপ্রধান এই বক্তব্য এমন এক ভাষণে দেন, যেখানে ৩০ মিনিট বক্তব্য দেন তিনি। পরে এক ঘণ্টার বেশি সময় প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ও জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশি মিশন থেকেও কর্মকর্তারা এতে ভার্চ্যুয়ালি ও সরাসরি অংশ নেন। সবাই পূর্ণাঙ্গ সামরিক পোশাকে ছিলেন, যা ঐক্য ও সংকল্পের বার্তা দেয়।
সেনাপ্রধান ওয়াকারকে উদ্ধৃত করে ডেইলি স্টার বলেছে, ‘সেনাবাহিনী দেশের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য, পুলিশের ভূমিকা পালনের জন্য নয়…নির্বাচনের পর আমাদের অবশ্যই ব্যারাকে ফিরতে হবে।’
সেনাপ্রধানের মন্তব্যে এ ভিন্নমতের ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে তিনি ইউনূস প্রশাসনের ঘোষিত অবস্থানের সঙ্গে একমত নন। অন্তর্বর্তী প্রশাসন বলেছে, ২০২৬ সালের মাঝামাঝির আগে কোনো নির্বাচন নয়। কেননা, প্রথমে রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সংস্কারের জন্য সময় দরকার, যাতে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা যায়।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর মতে, সেনাপ্রধান ওয়াকার অন্তর্বর্তী সরকারের বিবেচনাধীন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগেরও জোরালো বিরোধিতা করছেন। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জন্য একটি মানবিক করিডর খোলার এমন এক প্রস্তাব নিয়ে তিনি এটি বলেছেন বলে জানা যায়, ‘এখানে কোনো করিডর হবে না। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে কোনো আপস হতে পারে না।’ তিনি সতর্ক করে দেন, এমন কোনো পদক্ষেপ বাংলাদেশকে বিপজ্জনক একটি প্রক্সি সংঘাতে জড়িয়ে ফেলতে পারে। পত্রিকাটির কথায়, তিনি আরও বলেন, ‘এ ধরনের সিদ্ধান্ত শুধু জনগণের ভোটে নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারই নিতে পারে।’
জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের অনুমোদন ছাড়া আরও কয়েকটি বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সেনাপ্রধান, যেমন দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দর সম্ভাব্য বিদেশি ব্যবস্থাপনায় দেওয়া কিংবা ইলন মাস্কের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা স্টারলিংক চালু করা। তিনি বলেন, এসব পদক্ষেপে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। ডেইলি স্টার তাকে উদ্ধৃত করে বলেছে, ‘আমাদের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে কাউকে আপস করতে দেবে না সেনাবাহিনী।’
জেনারেল ওয়াকারের এসব বক্তব্য এমন এক সময় এল, যখন চারদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে ইউনূস প্রশাসন নাকি গত সপ্তাহে জেনারেল ওয়াকারকে পদচ্যুত করার চেষ্টা করেছিল; যদিও সরকার বা সেনাবাহিনীর কেউ এখনো এটি নিশ্চিত করেনি। এ গুজব নিশ্চিত না হলেও এটি জনমনে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে এবং অন্তর্বর্তী এ সময়ে বেসামরিক-সামরিক সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করেছে।
তাই জেনারেল ওয়াকারের এ প্রকাশ্য দৃঢ় বক্তব্য এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়া ও জাতীয় সার্বভৌমত্বের ওপর এর গুরুত্বারোপের সময়কালকে বিশ্লেষকেরা অন্তর্বর্তী সরকারের ক্রমবর্ধমান বেসামরিক উদ্যোগ নিয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে বাড়তে থাকা অস্বস্তির একটি ইঙ্গিত হিসেবে ব্যাপকভাবে দেখছেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও কি অন্তর্বর্তী সরকারের উত্তেজনা রয়েছে
হ্যাঁ, উত্তেজনা রয়েছে। গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন দিক থেকে ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে রয়েছে এটি। বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) দাবি করছে, জাতীয় নির্বাচন অবশ্যই ডিসেম্বরের মধ্যে হতে হবে। অন্যদিকে এ বছরের শুরুতে গঠিত ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং আরও কয়েকটি দল বলছে, যেকোনো নির্বাচনের আগে দেশজুড়ে ব্যাপক সংস্কার ও গত বছরের ছাত্র আন্দোলনে দমন-পীড়নের ঘটনায় জড়িত সাবেক আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
বিএনপি আরও কিছু দাবিতে একের পর এক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। সেসবের মধ্যে রয়েছে ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে কারচুপির মাধ্যমে পরাজিত করা তাদের (বিএনপি) প্রার্থীকে (ইশরাক হোসেন) আবার মেয়র পদে পুনর্বহাল করতে হবে।
বিএনপি গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলন করে বছরের শেষ নাগাদ নির্বাচন আয়োজন, দুজন ছাত্র উপদেষ্টা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেছে। দলটি সতর্ক করে দেয় যে এসব দাবি পূরণ না হলে ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে তাদের সহযোগিতা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
গতকাল মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপি ও দেশের আরেকটি বড় রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর বৈঠক হয়েছে।
ইউনূস কি পদত্যাগের কথা ভাবছিলেন
গতকাল উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর ঘোষণা দেওয়া হয়, ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে পদত্যাগ করছেন না।
তবে ক্রমবর্ধমান এ অস্থিরতার মধ্যে ইউনূস হয়তো পদত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছেন—এমন গুঞ্জন আরও জোরালো হয়ে ওঠে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে প্রকাশ পেতে শুরু করে, ইউনূস বৃহস্পতিবার বিকেলে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তিনি পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন এবং টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। এর আগে এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে চলে ব্যাপক আলোচনা।
ওই দিন সন্ধ্যায় জুলাই আন্দোলনের ছাত্রনেতা ও সদ্য গঠিত এনসিপির প্রধান নাহিদ ইসলাম অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় ইউনূসের সঙ্গে ছিলেন আরও দুই ছাত্র উপদেষ্টা। ইউনূসকে দায়িত্বে থেকে যাওয়ার অনুরোধ জানান নাহিদ ইসলাম।
বৈঠক শেষে নাহিদ বিবিসি বাংলাকে নিশ্চিত করেন, অধ্যাপক ইউনূস সত্যিই পদত্যাগের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছিলেন।
গত শুক্রবার সন্ধ্যায় অন্তর্বর্তী প্রশাসনের সূত্রগুলো আল–জাজিরাকে জানায়, ইউনূস এখনো তার সিদ্ধান্ত বিবেচনা করছেন।
ইউনূস কেন পদত্যাগ করতে চেয়ে থাকতে পারেন
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউনূস ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক চাপে পড়ে হয়তো পদত্যাগের কথা ভাবছিলেন।
দুজন উপদেষ্টাকে উদ্ধৃত করে স্থানীয় একটি পত্রিকা বলেছে, ইউনূস বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের জানান, গত বছর হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক দলগুলো ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করে রাষ্ট্রীয় সংস্কার ও দেশে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটানোর যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারা তা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
বিভিন্ন খবরে জানা যায়, ইউনূস এমন মন্তব্য করেছেন যে তার পক্ষে দায়িত্ব পালন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি নির্বাচনের জন্য চাপ বেড়েই চলেছে। তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা খুব কম।’ তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, (এমন পরিস্থিতিতে) যেকোনো নির্বাচন হলে তা হস্তক্ষেপ বা কারচুপির শিকার হতে পারে এবং তিনি এর দায় নিতে চান না।
পরে ইউনূস বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তার সরকারি বাসভবন যমুনায় তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ও এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের সঙ্গে বৈঠক করেন।
বৈঠকের পর বিবিসি বাংলাকে দেওয়া বক্তব্যে নাহিদ নিশ্চিত করেন, ইউনূস পদত্যাগের চিন্তা করছিলেন এবং বলেন, ইউনূস নিজেকে আন্দোলন ও রাজনৈতিক অচলাবস্থার কাছে ‘জিম্মি’ মনে করছেন।
‘তোমরা, সব রাজনৈতিক দল যদি কোনো অভিন্ন সিদ্ধান্তে না আসো, তবে আমি এভাবে কাজ চালিয়ে যেতে পারি না’, ইউনূসের বরাত দিয়ে বলেন নাহিদ। ইউনূসকে নাহিদ অনুরোধ করেন, যেন তিনি ‘দৃঢ় থাকেন’। সে সঙ্গে নাহিদ এ বিষয়ে গুরুত্ব দেন, আওয়ামী লীগ সরকারকে সরানোর পর জনগণ জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে তার (অধ্যাপক ইউনূস) ওপর কতটা আশা রেখেছে।
ইতিমধ্যে মুহাম্মদ ইউনূসের উচ্চাভিলাষী সংস্কার কর্মসূচি হোঁচট খাচ্ছে বলে জানা গেছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, পুলিশ, বেসামরিক প্রশাসনসহ রাষ্ট্রের প্রধান অঙ্গগুলো ক্রমেই বেশি অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, হোঁচট খাওয়া অনেকগুলো সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে এক উজ্জ্বল উদাহরণ হলো, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) দুটি প্রতিষ্ঠানে ভাগ করার প্রস্তাব। এটি দেশের কর ব্যবস্থাপনার প্রধান কর্তৃপক্ষ এবং আয়কর, মূল্য সংযোজন কর ও শুল্ক আদায়ের দায়িত্বে রয়েছে। সরকার বলেছে, এটি দেশের করব্যবস্থায় দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বাড়াতে করা হচ্ছে। এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে এনবিআরের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা তীব্র আপত্তি তুলেছেন। তাদের আশঙ্কা, এ প্রস্তাব কার্যকর হলে অভিজ্ঞ রাজস্ব কর্মকর্তারা কোণঠাসা হয়ে পড়বেন।
বিএনপি কী চায়
আল–জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিএনপির নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, তাদের দল কখনো ইউনূসের পদত্যাগ চায়নি। তিনি বলেন, ‘কেউ তার পদত্যাগ দাবি করেনি, আমরাও তা চাই না।’
‘মানুষ ভোট দেওয়া ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আশায় আছে। প্রায় দুই দশক ধরে তারা এ অধিকার থেকে বঞ্চিত’, বলেন আমীর খসরু। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই, ইউনূস একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। তিনিও ঠিক এ জন্যই এসেছেন।’
বিএনপির নেতা আমীর খসরু নির্বাচনের সময় নির্ধারণে বিলম্ব করা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, ‘এত দেরির কারণ কী? এ নিয়ে এখন দেশে ব্যাপক আলোচনা চলছে।’
আমীর খসরু বলেন, বিএনপি চায়, প্রশাসন যেন এখন তত্ত্বাবধায়কের রূপ নেয়, একটি ছোট পরিসরের উপদেষ্টা পর্ষদ গঠন করে এবং কয়েকজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে সরিয়ে দেয়, বিশেষ করে যাঁদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তিনি ছাত্র প্রতিনিধিদের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘তারা ইতিমধ্যে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন।’ তিনি বলেন, ‘অন্যরা (উপদেষ্টাদের কেউ কেউ) পক্ষপাতদুষ্ট বিবৃতি দিয়েছেন। যদি সত্যিই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চান, তবে এসব ব্যক্তিকে সরাতে হবে।’
আমীর খসরু সংস্কার ও নির্বাচনের মধ্যে কোনো ধরনের বিরোধ থাকার কথা নাকচ করে বলেন, দুটিই যুগপৎভাবে এগোতে পারে। ‘যেখানে ঐকমত্য আছে, সেখানে সংস্কার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই শেষ করা সম্ভব’, বলেন তিনি।
বিএনপির নেতা খসরু সুষ্ঠু ভোট নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা ও সেনাবাহিনীর ভূমিকার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। বলেন, ‘এখন আর শেখ হাসিনার যুগ নয়।’ এর মাধ্যমে বর্তমানে নির্বাচন আয়োজনের জন্য অধিকতর ইতিবাচক রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করার দিকে ইঙ্গিত করেন তিনি।
আওয়ামী লীগের নেতাদের বিচার করার প্রচেষ্টা প্রশ্নে খসরু বলেন, বিচারিক প্রক্রিয়া সমান্তরালভাবে চলতে পারে। ‘বিচার বিভাগ তাদের দায়িত্ব পালন করবে। যদি আরও কিছু প্রয়োজন হয়, তা নির্বাচিত সরকার করবে,’ বলেন তিনি।
আগের সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী ছিল বিএনপি—দাবি করে আমীর খসরু বলেন, ‘এই বিচার নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য রয়েছে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদও শুক্রবার এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে একই মত প্রকাশ করেন। বলেন, ‘যদি ইউনূস ব্যক্তিগতভাবে দায়িত্ব পালনে অক্ষম হন, তবে রাষ্ট্র বিকল্প ব্যবস্থা নেবে।’ তবে তিনি বলেন, ‘যেহেতু তিনি একজন আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত ব্যক্তি, আমরা আশা করি, তিনি পরিস্থিতি বুঝবেন ও ডিসেম্বরের মধ্যে একটি নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করবেন।’
অন্যান্য রাজনৈতিক দল কী চায়
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বিএনপির বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে আল–জাজিরাকে বলেন, ‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর সব রাজনৈতিক দলেরই অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন করার কথা ছিল, কিন্তু বিএনপি তাদের পুরোনো পেশিশক্তিনির্ভর কৌশলে অটল থাকে—এটাই সংকটের মূল কারণ।’
ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে এনসিপি নেতা আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘বিএনপি ও অন্যান্য সব দলকে জাতীয় স্বার্থে এক হতে হবে।’
ইতিমধ্যে ঢাকাজুড়ে বিক্ষোভ ও পর্দার আড়ালে বিভিন্ন বৈঠক চলতে থাকে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এনসিপিসহ পাঁচটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রধান মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিমের ডাকে দলটির প্রধান কার্যালয়ে এক জরুরি বৈঠকে অংশ নেন।
এ দলগুলো সব ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিকে’ এক হওয়ার, জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষার ও প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর ইউনূসের অধীনে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান জানায়। দলগুলোর কয়েকটি, যেমন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী যুক্তি দিয়েছে, মূল সংস্কার, যেমন সমানুপাতিক ভোটব্যবস্থা চালু এবং অতীতের স্বৈরাচারী আচরণের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে আগের খারাপ কর্মকাণ্ডের জবাবদিহি নিশ্চিত করা ছাড়া নির্বাচন আয়োজন করলে আগের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ ফেরার ঝুঁকি থাকবে। তাদের মতে, এসব পরিবর্তন না করে নির্বাচন আয়োজন করা হলে তা জনগণের আস্থা হারাবে ও আরেকটি রাজনৈতিক সংকটের ঝুঁকি তৈরি করবে।
জামায়াতে ইসলামীর প্রধান শফিকুর রহমান ফোনের মাধ্যমে ওই বৈঠকে যোগ দেন এবং তাতে গৃহীত প্রস্তাবে সমর্থন জানান। বৃহস্পতিবার তিনি ইউনূসকে সংকট নিরসনে সর্বদলীয় সংলাপ আয়োজনের আহ্বান জানান। এরপর শুক্রবার রাতে শফিকুর রহমান ইউনূসের সঙ্গে এক বৈঠকের অনুরোধ জানান, প্রস্তাব দেন গতকাল সন্ধ্যায় বৈঠক করার।
আল–জাজিরার সঙ্গে শুক্রবার রাতে কথা বলার সময় এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সরওয়ার তুষার বলেন, ‘গুজব যা–ই থাক, আমরা বিশ্বাস করি, মুহাম্মদ ইউনূস তার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রয়েছেন।’
‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও দেশের জনগণ—উভয়ের পক্ষ থেকে তার (ইউনূস) প্রতি ব্যাপক প্রত্যাশা রয়েছে,’ বলেন সরওয়ার তুষার।
দেশে রাজনৈতিক বিভাজন তৈরি হওয়ার কথা স্বীকার করে তুষার বলেন, ‘যদি সবাই দলীয় এজেন্ডা পেছনে ফেলে জাতীয় এজেন্ডায় মনোযোগ দেয়, তবে সংলাপের মাধ্যমেই সংকটের সমাধান সম্ভব।’
এখন আমরা কী আশা করতে পারি
রাজনৈতিক বিশ্লেষক রেজাউল করিম রনি আল–জাজিরাকে বলেন, ইউনূসের পদত্যাগ নিয়ে আলোচনা অন্তর্বর্তী সরকারের অভ্যন্তরীণ ঐক্যের অভাবে বাড়তে থাকা হতাশার প্রতিফলন হতে পারে। তিনি বলেন, ‘গণ অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে ঘিরে যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল, তা দৃশ্যত এখন ব্যক্তিস্বার্থে দুর্বল হয়ে পড়ছে। পদত্যাগের আলোচনা সম্ভবত সেই ঐক্য পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে একধরনের সংকেত।’
রেজাউল করিম মনে করেন, কিছু সরকারি নিয়োগ রাজনৈতিক দলগুলোকে (অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যাপারে) বিমুখ করে তুলেছে। প্রশ্ন উঠেছে, কিছু ব্যক্তি কি সরকারঘোষিত সংস্কার কর্মসূচির বাইরেও কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছেন? তিনি বলেন, ‘এটি সেই কারণ হতে পারে, যার জন্য সরকার বৃহত্তর রাজনৈতিক সহযোগিতা অর্জন ও কার্যকরভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে হোঁচট খাচ্ছে।’
এই বিশ্লেষক আরও বলেন, বর্তমানে নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নেওয়া প্রশাসনকে এমনভাবে উপস্থাপন করতে পারে যে তারা বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে একমত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, দেশকে নেতৃত্ব দেবে কে, সেটি নির্ধারণের অধিকার জনগণেরই থাকা উচিত।
তবে এনসিপির নাহিদ ইসলাম বিষয়টি অন্যভাবে দেখছেন। শুক্রবার রাতে এক ফেসবুক পোস্টে তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘গণতান্ত্রিক উত্তরণকে ব্যাহত করার ও আরেকটি ১/১১ ধরনের ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে।’
রাজনৈতিক অস্থিরতা চলার মধ্যে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি (১/১১) গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া স্থগিত করে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশে ক্ষমতা গ্রহণ করে ও দুই বছর শাসনকাজ চালায়।
‘বাংলাদেশকে বারবার বিভক্ত করা হয়েছে, জাতীয় ঐক্য নষ্ট করা হয়েছে, যাতে দেশ দুর্বল থাকে,’ নাহিদ লিখেছেন।
অধ্যাপক ইউনূসকে দায়িত্বে থাকার এবং সংস্কার, ন্যায়বিচার ও ভোটাধিকার বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি পূরণ করার আহ্বান জানিয়ে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘অধ্যাপক ইউনূস অবশ্যই তার দায়িত্বে থেকে সব রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করবেন।’
নাহিদ এনসিপির দাবিদাওয়াগুলোও তুলে ধরেছেন। এগুলো হলো—সময়মতো জুলাই ঘোষণা, ঘোষিত সময়সীমার মধ্যে নির্বাচন আয়োজন (ইউনূস বারবার বলেছেন, নির্বাচন ডিসেম্বর ২০২৫ থেকে জুলাই ২০২৬–এর মধ্যে হবে), নির্বাচনের আগে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সম্পন্ন করাসহ ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা, জুলাই হত্যাকাণ্ডের দৃশ্যমান বিচার এবং একযোগে গণপরিষদ ও জাতীয় সংসদের নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধানের রোডম্যাপ ঘোষণা।
এসবের মধ্যে জনগণের উদ্বেগ বাড়ছে। শুক্রবার সেনাবাহিনী একটি ফেসবুক সতর্কবার্তায় এক ভুয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সম্পর্কে বলেছে, এটি জনগণ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভ্রান্তি এবং বিভাজন সৃষ্টি করার স্পষ্ট চেষ্টা। বিবৃতিতে সতর্ক করে আরও বলা হয়, ‘গুজবে বিশ্বাস করবেন না। বিভ্রান্ত হবেন না।’ উল্লেখ্য, ভুয়া বিজ্ঞপ্তিটি এক দিন আগে ছড়ানো ও তাতে অবৈধভাবে সেনাবাহিনীর লোগো ব্যবহার করা হয়।
সময় গড়িয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে সবার দৃষ্টি এখন মুহাম্মদ ইউনূসের দিকে—তিনি কি পারবেন দৃঢ় অবস্থান নিতে? পারবেন কি গত বছরের নাটকীয় গণ–অভ্যুত্থানের পর দেশের দ্বিতীয় রূপান্তরকে সফলভাবে নেতৃত্ব দিতে নতুন ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে?
(নিবন্ধটি প্রথম আলো থেকে নেওয়া। অনুবাদ: মো. আবু হুরাইরাহ্।)