ছবি: সংগৃহীত
যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পর বন্ধ হতে যাচ্ছে গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা। বন্ধ হবে অবিরাম বোমাবর্ষণ ও গুলি। স্বাভাবিকভাবেই এই খবরে আনন্দিত ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিরা।
গাজার বাসিন্দা আব্দুল মাজিদ আবদ রাব্বো আল-জাজিরাকে বলেন, ‘এই যুদ্ধবিরতির জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ। রক্তপাত ও হত্যার অবসান। গাজার সব মানুষ খুশি…।’
গাজার আরেক বাসিন্দা খালেদ শাত বলেন, ‘রাস্তায় কিছুক্ষণ আগেও আনন্দ করতে দেখেছিলাম। এটা গণহত্যা ও হত্যা থেকে মুক্তির আনন্দ।’
তবে, ইসরায়েলের অতীত রেকর্ড বলছে, এই আনন্দের সঙ্গে থেকে যাচ্ছে শঙ্কাও।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার গোষ্ঠী ডনের ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিষয়ক পরিচালক মাইকেল শেফার ওমর-ম্যান আজ বৃহস্পতিবার আল-জাজিরাকে বলেছেন, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির শর্তা মেনে চলবে কিনা—সেটাই এখন উদ্বেগের বিষয়।
ওমর-ম্যান বলেন, ‘ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে, প্রকাশ্যে, নির্লজ্জভাবে এখন পর্যন্ত প্রতিটি যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করেছে।’
তার এই উদ্বেগের বাস্তবতাও ইতোমধ্যেই সামনে এসেছে। উস্কানিমূলক মন্তব্যের জন্য পরিচিত উগ্র ডানপন্থি ইসরায়েলি অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ বলেছেন, গাজা থেকে জিম্মিদের ফেরানোর পর হামাসকে ধ্বংস করতে হবে।
আজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ তিনি লিখেছেন, ‘জিম্মিদের ঘরে ফেরানোর পরপরই ইসরায়েল হামাসকে নির্মূল করতে এবং গাজাকে পুরোপুরি নিরস্ত্রীকরণের জন্য সর্বশক্তি দিয়ে প্রচেষ্টা চালাবে।’
তার অর্থ, শিগগির আবারও গাজায় হামলা চালাতে পারে ইসরায়েল। হামাসের হাতে থাকা জিম্মিদের মুক্ত করতে সেখানে চলমান বিক্ষোভ সামাল দিতেই হয়তো এই যুদ্ধবিরতি আপাতত মেনে নিয়েছে তারা।
একইসঙ্গে অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, এই যুদ্ধ বিরতির সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শান্তিতে নোবেল জয়ের আশার বিষয়টিও জড়িত থাকতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওয়াদি সাইদ বলেছেন, ‘ইসরায়েল আগেও যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভঙ্গ করেছে। ট্রাম্প নোবেল শান্তি পুরষ্কার পাওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। কাজেই শান্তিতে নোবেল পাওয়াই এই চুক্তির প্রেরণা, ফিলিস্তিনিদের গণহত্যা বন্ধ নয়।’
তার ভাষ্য, ‘যদিও আমরা অনেকেই অন্তত এই জন্য খুশি যে হত্যা ও সহিংসতা বন্ধ হবে।’
অবশ্য ওমর-ম্যানও মনে করেন, ‘কোনো ধরনের সমালোচনা না করে এই মুহূর্তটিকে স্বাগত জানাতে হবে। গাজার মানুষ হত্যা, তাদের অনাহার এবং মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের অবসান হলো। যদিও গত সাড়ে ২৩ মাসেরও যেকোনো সময় এটা করা যেত।’
শুরুর দিক থেকেই যুদ্ধ বন্ধ করলে সব জিম্মিকে মুক্তি দেওয়ার ঘোষণা হামাস দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মতোই একই ক্ষমতা বাইডেনের ছিল।’
টানা দুই বছর গাজায় ইসরায়েলের এই হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা করেছেন সান ফ্রান্সিসকো বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য অধ্যয়ন প্রোগ্রামের চেয়ারম্যান স্টিফেন জুনেসও।
আল-জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘নেতানিয়াহু যখন জানুয়ারিতে যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভঙ্গ করে সেই চুক্তির দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে না গিয়েই আবারও হামলা শুরু করেন, তখন আপত্তি না জানানো ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতা।’
ইসরায়েলকে অব্যাহত সমর্থন দেওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে ‘বেশ চড়া’ রাজনৈতিক মূল্য দিতে হচ্ছে উল্লেখ করে বলেন, ‘এটা সত্যিই আমেরিকার অবস্থানকে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কারণ, তাদের ক্ষমতা শুধু যুদ্ধবিমান, ট্যাঙ্ক বা অস্ত্রের ভিত্তিতে নয়, বরং সুনামের ওপর নির্ভর করে। এত দিন ধরে ইসরায়েলকে ব্ল্যাংক চেক দিয়ে রাখায় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সত্যিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
এই চুক্তির জন্য কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও অন্যান্য উপসাগরীয় রাষ্ট্রকেও কৃতিত্ব দিয়ে জুনেস বলেছেন, যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনার প্রথম থেকে ২০তম ধাপ পর্যন্ত নিশ্চিত করা ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’।
এই যুদ্ধবিরতিকে স্বাগত জানিয়েছেন সারা বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষ।
ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্রনীতি প্রধান কাজা কালাস গাজা চুক্তিকে ‘বড় কূটনৈতিক সাফল্য’ ও ‘গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি’ বলে অভিহিত করেছেন।
তিনি বলেন, ‘এটি একটি বড় কূটনৈতিক সাফল্য, এক ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের অবসান এবং জিম্মিদের মুক্তি দেওয়ার একটি বাস্তব সুযোগ।’
ইইউ-এর পক্ষ থেকে সম্ভব সকল সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়েছেন তিনি।
নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল গাজায় ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার জন্য পূর্ণ, অবাধ প্রবেশাধিকার চেয়েছে। তারা এই যুদ্ধবিরতির ঘোষণাকে ‘আশার ঝলক’ হিসেবে দেখছে।
গাজার একটি সাহায্য সংস্থা হিউম্যানস টু বি-এর প্রকল্প ব্যবস্থাপক লায়লা আল শানা বলেছেন, ‘আমি আশা করি তারা এই চুক্তি বজায় রাখতে পারবে। দুই বছর ধরে (শিশুদের) শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, অনেক শিশু তাদের পরিবারের সদস্য, তাদের বাবা-মা হারিয়েছে, এতিম হয়েছে। তাদের মানসিক সহায়তা দিতে হবে।’
গাজা চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তোনিও তাজানি বলেছেন, ‘শান্তি নিকটবর্তী’। বলেছেন, ‘গাজা পুনর্গঠনে অংশ নিতে’ তারা প্রস্তুত। এমনকি প্রয়োজনে ‘আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী তৈরির ক্ষেত্রেও সৈন্য পাঠাতে প্রস্তুত’ তার দেশ।
ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস গাজা চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন, এটি দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানে পৌঁছানোর একটি মাধ্যম হবে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেজেপ তায়িপ এরদোয়ান বলেছেন, যুদ্ধবিরতি চুক্তির ফলে যে আলোচনা হয়েছে তাতে তিনি ‘অত্যন্ত সন্তুষ্ট’।
ট্রাম্পকে ‘বিশেষ ধন্যবাদ’ জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমরা চুক্তির সূক্ষ্ম বাস্তবায়ন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করব এবং এই প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখব। একইভাবে, ১৯৬৭ সালের সীমান্তের ভিত্তিতে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা নিয়ে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাব।’
যুদ্ধবিরতিতে গাজায় হয়তো সাময়িকভাবে অবিরাম বোমাবর্ষণ বন্ধ হবে। কিন্তু তাদের মাঝে সত্যিকারের আনন্দ ও মৌলিক চাহিদা পূরণে প্রতিদিনের সংগ্রাম সহসা শেষ হবে না। হয়তো সন্তান ও নিকটজন হারানো মানুষগুলো শোকের আবহ খানিক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবারও কোনো ঠুনকো অজুহাতে শুরু হতে পারে ইসরায়েলি হামলা।