রাখাইনের প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান

‘তৃষ্ণার্ত অবস্থায় পানি চাইলে প্রস্রাব পানে বাধ্য করে তারা’

বিবিসি

জুন ৭, ২০২৪, ০৮:১০ পিএম

‘তৃষ্ণার্ত অবস্থায় পানি চাইলে প্রস্রাব পানে বাধ্য করে তারা’

ছবি: সংগৃহীত

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি গ্রামকে টার্গেট করে গত সপ্তাহে অন্তত ৫০ জন বাসিন্দাকে হত্যা করেছে মিয়ানমারের সেনা সদস্যরা। স্থানীয় বাসিন্দা ও বিরোধী বাহিনী সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, দেশটির সেনা অভিযানে আড়াই দিন ধরে গ্রামটির বাসিন্দারা আতঙ্কে ছিলেন। এই সময়ে গ্রামবাসীকে চোখ বেঁধে পেটানো, গরম পেট্রোল গায়ে ঢেলে দেওয়া, অনেককে প্রস্রাব খেতে বাধ্য করছে মিয়ানমারের সেনারা। আরাকান আর্মি সমর্থকদের খুঁজতেই মূলত গ্রামবাসীও ওপর নির্যাতন চালায় তারা।

ক্ষমতাচ্যুত বেসামরিক সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) এক বিবৃতিতে জানায়, ১৫-৭০ বছর বয়সের ৫১ জনকে ‘সহিংস নির্যাতন ও হত্যা করা হয়েছে’। এদিকে আরাকান আর্মির ধারণা, মিয়ানমার সেনার হাতে নিহতের এই সংখ্যা ৭০ জনের ওপরে হবে।

মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন জান্তা সরকারের চালিয়ে যাওয়া নির্মম নির্যাতনের অভিযোগ তুলে একজন নারী বিবিসিকে জানান, সেনা সদস্যরা গ্রামে ঢুকে পুরুষদের জিজ্ঞাসা করছে যে এই গ্রামে আরাকান আর্মি আছে কিনা। এই প্রশ্নের যে জবাবই দেওয়া হোক না কেন, তারা তাদেরকে মারধর করতে থাকে।

এদিকে ৩ বছর ধরে চলতে থাকা মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধকালীন নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে ক্ষমতাসীন জান্তা সরকার।

মাত্র ৬ মাসের মধ্যে রাখাইন রাজ্যের বেশির ভাগ এলাকা দখলে নিয়ে জান্তা সরকারকে পিছু হটতে বাধ্য করেছে আরাকান আর্মি। গত বছর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধবিরতি শেষে এবং ২০২১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতা দখলকারী জান্তা সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে দেশের অন্যান্য সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেয় আরাকান আর্মি।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নারী বলেন, “আমি নিজের চোখে দেখেছি, আমার স্বামীকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমার ছেলেকেও আমাদের দুজনের কাছ থেকে আলাদা করা হয়েছে। আমি জানি না এখন আমার ছেলে কোথায় আছে। আমি এটাও জানি না, আমার স্বামী ও ছেলে বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে।”

গ্রামটির সবাইকে দুই দিন ধরে খোলা একটি জায়গায় রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় সূত্র। প্রখর রোদে তাদের সবাই ভীষণ অসুবিধায় পড়েছে। তাদের খাবার ও পানি দেওয়া হচ্ছে না। ডজনখানেক পুরুষের হাত-চোখ বেঁধে রাখে তারা। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের কয়েকজনকে ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হয়। যাদের অনেকেই এখনও ফেরেনি।

বিবিসিকে ওই নারী আরও বলেন, “সারা দিন রোদে দাঁড়িয়ে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় পানি চাইতাম। কিন্তু সেনারা পানির বোতলে প্রস্রাব করে পুরুষদের হাতে দিতো।”

এছাড়া ওই নারী ‘প্রচুর গোলাগুলির শব্দ’ শুনেছেন বলেও জানিয়েছেন। তবে ‘মাথা নিচু রাখায়’ কাকে গুলি করা হয়েছে সেটা দেখতে সক্ষম হননি। তিনি বলেন, “আমি তাকানোর সাহস পাইনি। তারা আমার কাছে দাঁড়িয়ে তাকা একজনকে ডাকে। তারপর আমি গুলির শব্দ শুনি। যাকে ডেকেছিল, তিনি আর ফিরে আসেননি।

বিবিসিকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ওই নারী সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। স্বামী ও ছেলেকে নিয়ে চিন্তিত ওই নারী বলেন, “আমি জানি না, তারা মরে গেছে, নাকি বেঁচে আছে। আমি তাদের জন্য প্রার্থনা করছি, বুদ্ধ, দয়া করে তাদের রক্ষা করুন।”

এখনও যারা বেঁচে আছেন, তারা জানান, মরদেহ কবর দিতে সেনা সদস্যরা কোদাল চাইছিল। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, তাদের মধ্যে অনেকে মদ্যপ ছিলেন।

এদিকে বুধবার শতাধিক সেনা সিত্তওয়ে রাজ্যের রাজধানীর উপকণ্ঠে বিয়াই ফিউ গ্রামে অভিযান চালিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

স্থানীয়রা জানায়, আরাকান আর্মির সমর্থনে যেসব পুরুষ তাদের শরীরে ট্যাটু বা উল্কি এঁকেছিল তাদের বিশেষভাবে নির্যাতনের জন্য আলাদা করা হয়েছে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, সেনারা উল্কি আঁকা চামড়া কেটে সেখানে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।

গত বছরের শেষদিকে একজন সেনা কর্মকর্তা শান রাজ্যের কথা উল্লেখ করে গ্রামবাসীকে বলেছেন যে তিনি প্রতিশোধ নিতে এসেছেন।

আরাকান আর্মি, মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি ও তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা থ্রি-ব্রাদারহুডের কাছে একের এক এক এলাকা থেকে পিছু হটছে জান্তা সরকার। প্রত্যক্ষদর্শীদের এসব বয়ানেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তারা সামনে আরও কী ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে।

Link copied!