অক্টোবর ৩, ২০২৫, ০১:০৪ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিনের গাজা অভিমুখে যাত্রা করা ত্রাণবাহী নৌবহর ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’র একটি বাদে সব কটি নৌযান আটকানোর ঘটনায় বিশ্বজুড়ে ব্যাপক নিন্দা জানানো হয়েছে। ইউরোপ থেকে অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকা পর্যন্ত দেশে দেশে বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নেমে ইসরায়েলের পদক্ষেপের তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং দেশটির বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞার দাবি তোলেন।
ফ্লোটিলা আটকানোর ঘটনায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘আন্তর্জাতিক জলদস্যুতার’ অভিযোগ তুলেছেন ফিলিস্তিনি এক আইনজীবী। খবর এএফপি ও আল-জাজিরা।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা ইসরায়েলের নৌ অবরোধ ভেঙে সমুদ্রপথে গাজায় ত্রাণ নিয়ে যাওয়ার একটি বৈশ্বিক প্রচেষ্টা। গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার প্রথম বহর ৩১ আগস্ট স্পেনের বার্সেলোনা থেকে যাত্রা শুরু করে।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, প্রায় দুই বছরের যুদ্ধ শেষে গাজায় দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এই নৌবহরের উদ্দেশ্য ছিল অবরুদ্ধ গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানো এবং অবরোধকে চ্যালেঞ্জ জানানো।
একজন ইসরায়েলি কর্মকর্তা বলেছেন, ৪১টি জাহাজে চার শতাধিক যাত্রী ছিলেন। তাদের মধ্যে রাজনীতিক ও জলবায়ু আন্দোলনের কর্মী গ্রেটা থুনবার্গও আছেন। গত বুধবার থেকে ইসরায়েলি নৌবাহিনী একটি বাদে নৌবহরের সব নৌযান আটকে দেয়।
বার্সেলোনা থেকে ডাবলিন পর্যন্ত বিক্ষোভ
স্পেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বার্সেলোনার পৌর পুলিশ জানিয়েছে, প্রায় ১৫ হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে ইসরায়েলের এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছেন। তারা স্লোগান দেন—‘গাজা, তুমি একা নও’; ‘ইসরায়েলকে বর্জন করো’ এবং ‘ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা চাই’।
স্পেনের সরকারি টেলিভিশনে প্রচারিত ফুটেজে দেখা যায়, বিক্ষোভকারীরা ব্যারিকেড টপকে ওঠার চেষ্টা করছিল। দাঙ্গা পুলিশ একপর্যায়ে লাঠিপেটা করে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
সুমুদ ফ্লোটিলায় থাকা একটি নৌযানে বার্সেলোনার সাবেক মেয়র আডা কোলাউ ছিলেন। তার পাশাপাশি ছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি ম্যান্ডলা ম্যান্ডেলাও। তাদের সবাইকে ইসরায়েল থেকে বহিষ্কার (ডিপোর্ট) হওয়ার মুখে পড়তে হচ্ছে।
একই ঘটনায় আইরিশ পার্লামেন্টের বাইরে ডাবলিনে কয়েক শ মানুষ মিছিল করেন। সেখানে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থনকে প্রায়ই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আয়ারল্যান্ডের দীর্ঘ সংগ্রামের সঙ্গে তুলনা করা হয়।
এই বিক্ষোভ মিছিলে উপস্থিত ছিলেন মিরিয়াম ম্যাকন্যালি নামের একজন নারী। তার মেয়ে ওই নৌবহরে আছেন। তিনি বলেন, ‘আমি আমার মেয়ের জন্য ভীষণ চিন্তিত, তবে আমি গর্বিতও। সে মানবতার পক্ষেই দাঁড়িয়েছে।’
ফ্রান্স, ইতালি ও তুরস্কে উত্তাল জনতা
প্যারিসে প্লেস দ্য লা রিপাবলিকে প্রায় এক হাজার মানুষ বিক্ষোভ মিছিল করেন। দক্ষিণ ফ্রান্সের মার্সেই নগরে বিক্ষোভকারীরা অস্ত্র প্রস্তুতকারী একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় অবরোধ করতে গেলে পুলিশ কয়েক শ বিক্ষোভকারীকে আটক করে। অভিযোগ আছে, ওই প্রতিষ্ঠানটি অস্ত্রসহ সামরিক সরঞ্জাম ইসরায়েলের কাছে বিক্রি করে।
এএফপির সংবাদদাতাদের তথ্যমতে, বার্লিন, হেগ, তিউনিস, ব্রাসিলিয়া এবং বুয়েনস এইরেসেও বিক্ষোভ হয়েছে।
ইতালিতে দেশটির প্রধান শ্রমিক ইউনিয়নগুলো নৌবহরের সঙ্গে সংহতি জানাতে আজ শুক্রবার সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমে প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনিকে কর্মীদের পক্ষে দাঁড়ানোরও আহ্বান জানিয়েছে।
রোমের পুলিশ জানিয়েছে, প্রায় ১০ হাজার মানুষ বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দিয়েছেন। এ ছাড়া মিলান, তুরিন, ফ্লোরেন্স ও বোলোনিয়াতেও বিক্ষোভ হয়েছে।
রাজধানীতে বুধবার সন্ধ্যায় হওয়া বিক্ষোভের পর গতকালও কলোসিয়ামের সামনে মানুষ জমায়েত হয়। তারা মিছিল করে ইসরায়েলের পক্ষে কট্টর ডানপন্থী প্রধানমন্ত্রী মেলোনির সমর্থনের নিন্দা জানান।
তুরস্কে ইস্তাম্বুলের ইসরায়েলি দূতাবাস অভিমুখে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। তাদের হাতে ছিল ব্যানার, যাতে লেখা ছিল, ‘দখলদারের ওপর সর্বাত্মক অবরোধ চাই।’
২১ বছর বয়সী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এলিফ বোজকুর্ট বলেন, ‘আমরা সুমুদ নৌবহরের সব বন্দীর মুক্তি চাই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ইসরায়েলের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে।’
জেনেভায় উত্তেজনা, কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় প্রায় তিন হাজার মানুষ ফ্লোটিলার সমর্থনে বিক্ষোভে যোগ দেন। পুলিশ মরিচ স্প্রে, জলকামান ও কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে।
প্রথমে তরুণ বিক্ষোভকারীরা শহরের কেন্দ্রীয় রেলস্টেশনের কাছে আগুন জ্বালিয়ে দেন। পরে তারা শহরের লেক জেনেভার শেষ প্রান্তে মন ব্ল্যাঁ সেতুর দিকে অগ্রসর হন। সেখানে দাঙ্গা পুলিশের মুখোমুখি হলে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় পুলিশ মরিচ স্প্রে, জলকামান ও কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
পুলিশের মুখপাত্র আলেকজান্দ্রে ব্রাহিয়ের বলেন, ‘আমাদের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। এর মধ্যে কাঁদানে গ্যাস ও জলকামান ব্যবহার করতে হয়েছে।’
ব্রাসেলস ও এথেন্সেও প্রতিবাদ
ব্রাসেলসে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ভবনের সামনে প্রায় তিন হাজার মানুষ সমবেত হয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের আহ্বান জানান। তাঁদের হাতে থাকা ব্যানারে লেখা ছিল, ‘অবরোধ ভাঙো।’
আইসিস নামের একজন বিক্ষোভকারী বলেন, ‘বার্তাটা হলো প্রতিটি নৌকাকে সুরক্ষা দিতে হবে। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের আহ্বান জানান ইসরায়েলকে দেওয়া ‘অযৌক্তিক বিপুল অর্থপ্রবাহ’ বন্ধ করতে।
গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে বিক্ষোভকারীরা আতশবাজি ও ফ্লেয়ার জ্বালান। গ্রিসের সংগঠন কিরফার নেতা পেত্রোস কনস্টান্টিনো বলেন, ‘সুমুদ নৌবহরের ওপর হামলা ইসরায়েলি বর্ণবাদী রাষ্ট্রের এক বর্বরোচিত উসকানি। গাজার জন্য মানবিক সাহায্যের পথও তারা খুলতে চায় না।’
মালয়েশিয়ায় ক্ষোভ
মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরেও কয়েক ডজন মানুষ সমবেত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করেন। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রধান মিত্র।
বিক্ষোভে ৪৩ বছর বয়সী ইলি ফারহান বলেন, ‘আমরা ক্ষুব্ধ ও হতাশ। তাঁরা শুধু ত্রাণ আর শিশুখাদ্য নিয়ে আসছিলেন। এই গ্রেপ্তার অন্যায়।’
ইসরায়েল ‘আন্তর্জাতিক জলদস্যুতার কাজ করেছে’
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘আন্তর্জাতিক জলদস্যুতার’ অভিযোগ তুলে ফিলিস্তিনি মানবাধিকার আইনজীবী ডায়ানা বুট্টু বলেছেন, ইসরায়েলের ফ্লোটিলা আটকানোর ঘটনা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ।
আল–জাজিরার সহপ্রকাশনা এজে প্লাসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ডায়ানা বুট্টু বলেন, সব জাহাজই আন্তর্জাতিক জলসীমায় অবস্থান করছিল। সেখানে গিয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর বিদেশি পতাকা বহনকারী জাহাজে ওঠা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।
এই আইনজীবী অভিযোগ করেন, ফ্লোটিলা থেকে যাত্রীদের আটক করে ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যেখানে তাঁদের যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। এরপর তাদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে প্রবেশের মামলা দিয়ে আবার বহিষ্কার করা হচ্ছে।
আটক অধিকারকর্মীদের মুক্তির দাবি পরিবারগুলোর
গাজামুখী ফ্লোটিলার যাত্রীদের মধ্যে যাদের ইসরায়েলি বাহিনী আটক করেছে, তাদের মুক্তির দাবিতে নেদারল্যান্ডসে পরিবার ও স্বজনেরা বিক্ষোভ করেছেন।
ইসরায়েলের কট্টর-ডানপন্থী কয়েকজন কর্মকর্তা প্রস্তাব দিয়েছেন, আটক কর্মীদের উচ্চ নিরাপত্তার কারাগারে রাখা উচিত।