পানামা খাল: কেন দখলে নিতে চান ট্রাম্প

সোহেল তারেক

ডিসেম্বর ২৪, ২০২৪, ০৬:৪২ পিএম

পানামা খাল: কেন দখলে নিতে চান ট্রাম্প

ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পানামা খাল ব্যবহারের ফি কমানোর দাবি জানিয়েছেন। নাহলে পানামা খালকে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে নেয়ারও হুমকি দিয়েছেন তিনি।

ট্রাম্পের অভিযোগ, পানামা যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ ও অন্য নৌযান থেকে অতিরিক্ত ফি আদায় করছে। ট্রাম্প পানামা সরকারের উচ্চহারে এই ফি আদায়কে ‘হাস্যকর, একেবারেই অন্যায্য’ বলে উল্লেখ করেছেন।  

এর আগেও ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্টে জানিয়েছিলেন যে, পানামা খাল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ‘গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদ’। ওই পোস্টেও “দ্রুতই সর্বাত্মক ও কোন প্রশ্ন ছাড়াই পানামা খাল ফিরিয়ে নেয়ার দাবি জানানো হবে” বলে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন।

পানামার প্রেসিডেন্টের প্রতিক্রিয়া

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এসব মন্তব্যের জের ধরে দ্রুতই প্রতিক্রিয়া এসেছে পানামার প্রেসিডেন্ট হোসে রাউল মুলিনোর কাছ থেকে। তিনি বলেছেন, ‘এই খাল ও আশেপাশের এলাকার প্রতি ইঞ্চি মাটি তার দেশের, যুক্তরাষ্ট্রের নয়।’ আরও বলেন, পানামার সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীনতা কোন বিতর্কের বিষয় নয়। 

কোন দেশের ভূখণ্ড নিয়ে নেয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোন নেতার এ ধরনের মন্তব্য নজিরবিহীন। এটা এখনো স্পষ্ট নয়, ট্রাম্প কী করে এই খালের নিয়ন্ত্রণ নিতে চান। তবে এটা স্পষ্ট যে, তিনি যদি এই চেষ্টা করেন, তাহলে তা আন্তর্জাতিক আইনের বিরোধী হবে।

এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, পানামা খাল এতো গুরুত্বপূর্ণ কেন? যুক্তরাষ্ট্র কেন এটি দখলে নিতে চায়? এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কেমন? আর কীভাবেই-বা এই খাল তৈরি করা হলো?

বিশ্ববাণিজ্যে পানামা খালের গুরুত্ব   

পানামা খাল বিশ্ব বাণিজ্যে মালামাল পরিবহনের জন্য কৃত্রিমভাবে নির্মিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি জলপথ। বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল জলপথ বলা হয় পানামা খালকে। প্রতিটি বড় জাহাজকে এই পথ পাড়ি দিতে ব্যয় করতে হয় প্রায় ৪ লাখ ডলার করে।

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় সমগ্র বিশ্ব বাণিজ্যের ৫ শতাংশ সংঘটিত হয় এই পথ দিয়ে। আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৫৫ শতাংশ জাহাজ এই পথ দিয়ে চলাচল করে। প্রতি বছর প্রায় ১৪ হাজার জাহাজ এ খাল ব্যবহার করে থাকে। কন্টেইনারবাহী এসব জাহাজ মূলত গাড়ি, প্রাকৃতিক গ্যাস, সামরিক উপকরণসহ বিভিন্ন পণ্য পরিবহন করে থাকে। এটি এশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলের মধ্যে জাহাজ চলাচলে দক্ষিণ আমেরিকার দীর্ঘ ও বিপজ্জনক পথ এড়াতে সহায়তা করে।

পানামা খালের মাধ্যমে দেশটি বছরে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ কোটি মার্কিন ডলার রাজস্ব আয় করে যা পানামার মোট জাতীয় আয়ের এক-তৃতীয়াংশ। পানামা খাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত অর্থবছরে খালটি থেকে প্রায় ৫ বিলিয়ন বা ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের রেকর্ড আয় হয়েছে।

ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব

পানামা লাতিন আমেরিকার একটি দেশ। পানামা খালের কারণে দেশটির রয়েছে বিশাল ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব।

আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরকে একসাথে যুক্ত করেছে এই পানামা খাল। খালটির দৈর্ঘ মাত্র ৫১ মাইল বা ৮২ কিলোমিটার। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৮৫ ফুট উঁচু ভূপৃষ্ঠ অতিক্রম করে পানামা খাল প্রবাহিত হয়েছে এবং অপর পাশের বিশাল জলরাশিকে একত্রিত করেছে। 

খালটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপ, এশিয়া এবং অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ককে এক অন্য রূপ দান করেছে। পানামা খাল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮৫ ফুট উঁচু হওয়ায়- এখানকার পানি ধরে রাখা থেকে জাহাজ চলাচল পর্যন্ত সকল প্রক্রিয়াই কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

পানামা খাল তৈরির ইতিহাস

শতাব্দী প্রাচীন এই খালের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বহু পুরনো।

১৮৬৯ সালে সুয়েজ খাল প্রকল্পে ফরাসিদের সাফল্যের পর আমেরিকা উত্তর আমেরিকার সাথে ইউরোপ, এশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকার দূরত্ব কমাতে বিকল্প একটি জলপথ তৈরির চিন্তা করতে থাকে।

যদিও ফ্রান্সই ১৮৮১ সালে প্রথম খালটি খনন শুরু করে। নির্মাণকাজ শুরুর কয়েক বছর পর নকশার ত্রুটি দেখে তারা এটি বন্ধ করে দেয়। যদিও এই সময়ের মধ্যে প্রায় ২০ হাজারের বেশি শ্রমিক প্রাণ হারায়।

১৮৮৮ সালে প্রকল্পটি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করে দেয় ফ্রান্স। ১৯০৩ সালে তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট পানামা খাল নির্মাণের প্রকল্পটি গ্রহণ করেন।

এই সময় পানামা ছিল কলম্বিয়ার অংশ। কলম্বিয়া সরকারের আপত্তির কারণে সেটি স্থগিত হয়ে যায়। পরে পানামা কলম্বিয়া থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর আমেরিকানরা পানামা খালের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পায়।

এর পর পানামা-যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি সম্পন্ন হলে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ১৯০৪ সালে খালটি পুনরায় খনন শুরু করে। শেষ হয় ১৯১৪ সালে। বলা হয়ে থাকে, যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগেও খালটি নির্মাণ করতে গিয়ে ৫ হাজার ৬০০ শ্রমিক মারা গিয়েছিল। অধিকাংশ মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল পীতজ্বর বা ইয়োলো ফিভার ও ম্যালেরিয়া মহামারি।

নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্র থেকে পানামার হাতে  

পানামা খাল নির্মাণের পর থেকে এর সকল রক্ষণাবেক্ষণের ও শুল্ক উত্তোলন সকল কিছুর দায়িত্ব ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। পানামা খালটি দুইটি অংশে বিভক্ত ছিল একটি অংশের দায়িত্ব পানামার হাতে থাকলেও বাকি অংশের দায়িত্ব ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। কিন্তু কার্যত সম্পূর্ণ নীতিনির্ধারণী দায়িত্বই ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। চুক্তি অনুযায়ী পানামা খালের রাজস্ব পানামার কোষাগারে জমা হওয়ার কথা থাকলেও পানামা তার রাজস্বের সামান্য অংশই পেত। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, পানামা খাল এবং এর আশেপাশের এলাকার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ বিতর্কিত হয়ে ওঠে।

১৯৬০ সালে পানামাতে যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী আন্দোলন দেখা দেয়। ফলে মার্কিনীরা পানামার সাথে চুক্তি করে ১৯৭৯ সালের মধ্যে ৬০ শতাংশ মালিকানা পানামার হাতে হস্তান্তর করার বিষয়ে একমত হয়। একইসাথে ১৯৭৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে পানামা খালকে আন্তর্জাতিক নৌপথ হিসেবে ঘোষণা করা হয় যাতে করে পানামা এই নৌপথের জাহাজ চলাচলের উপর ইচ্ছাকৃত কোন হস্তক্ষেপ করতে না পারে।

১৯৯৯ সাল পর্যন্ত পানামা কমিশনের অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পানামা যৌথভাবে এটি নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু ১৯৯৯ সালে পানামা খালের পূর্ণ মালিকানা পানামার কাছে হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে পানামা খালের একমাত্র মালিক পানামা রাষ্ট্র। 

হাজার হাজার পথ কমিয়ে দিয়েছে পানামা খাল  

এই খাল নির্মিত হওয়ায় সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স। যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব তীর থেকে পশ্চিম তীরে যেতে আগে দক্ষিণ আমেরিকার বিশাল অঞ্চল ঘুরে যেতে হতো। এতে আনুমানিক ১৫ হাজার কিলোমিটার ঘুরতে হতো। খাল খননের পর এই দূরত্ব প্রায় অর্ধেক কমে আসে। উত্তর আমেরিকার এক দিকের উপকূল থেকে দক্ষিণ আমেরিকার অন্যদিকের উপকূলে যেতে সাড়ে ৬ হাজার কিলোমিটার পথ কমিয়ে দিয়েছে। ইউরোপ, পূর্ব এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে যাতায়াতকারী জাহাজগুলোরও প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কিলোমিটার পথ বেঁচে যায়।

আটলান্টিক থেকে পানামা খাল হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করতে একটি জাহাজের সময় লাগে প্রায় ১০ ঘণ্টা। এই দীর্ঘ ও যান্ত্রিক একটি জলপথ পাড়ি দিতে জাহাজগুলোকে উচ্চহারে শুল্ক দিতে হয়। পানামা খালের এই শুল্কহার পৃথিবীর অন্য সব জলপথের শুল্কের তুলনায় সবচেয়ে বেশি। আর এ কারণেই একে বলা হয় সবচেয়ে ব্যয়বহুল জলপথ।

সাম্প্রতিক টানাপোড়েন

লাতিন আমেরিকার দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ ছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সম্পর্কে এক ধরণের টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ২০২৩ সালে যখন চীনের সাথে পানামার অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের আলোচনা শুরু হয় তখন থেকে।

উল্লেখ্য যে, এই খালটিকে বাণিজ্যিক কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। এরপর আছে জাপান, চিলি ও দক্ষিণ কোরিয়া।

Link copied!