মে ২৬, ২০২৫, ০৬:৩৩ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
‘যখনই হামলার খবর শুনলাম, মনে হলো যেন পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। সব অভিভাবক দৌড়ে বাসের দিকে ছুটে গেলেন, কেউই বুঝে উঠতে পারছিলেন না, কী হচ্ছে।’ কথাগুলো বলছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সার্জেন্ট নাসির মাহমুদ।
নাসির ও আমি কোয়েটা শহরে বেলুচিস্তান প্রদেশের সবচেয়ে বড় সামরিক হাসপাতালের বসার কক্ষে অপেক্ষা করছিলাম। তার ১৪ বছর বয়সী ছেলে মোহাম্মদ আহমাদ তাকে বলেছে, খুজদার শহরে সেনাবাহিনীর স্কুলবাসে বোমা বিস্ফোরণের সময় সে ছিটকে পড়েছিল। এখান থেকে গাড়িতে খুজদার যেতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে।
গত বুধবার স্থানীয় সময় সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে বাসটিতে বোমা বিস্ফোরণ হয়। এ সময় বাসে প্রায় ৪০ স্কুলশিক্ষার্থী ছিল।
নাসির বললেন, ‘আমি যখন হাসপাতালে পৌঁছাই, তখন চারদিক থেকে শুধু শিশুদের আর্তচিৎকার শোনা যাচ্ছিল। আমার চোখ হন্যে হয়ে আমার ছেলেকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল।’
এ ঘটনায় যারা সবচেয়ে বেশি গুরুতর আহত হয়েছে, শুধু তাদের উড়োজাহাজে করে সমন্বিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) আনা হয়েছে।
সেনাবাহিনী জানিয়েছে, বাসে বোমা হামলায় নিহত মানুষের সংখ্যা বেড়ে আটজনে পৌঁছেছে। এর মধ্যে ছয়জনই শিশু। এ ঘটনায় আহত হয়েছে বহু মানুষ।
এখনো কোনো গোষ্ঠী এ হামলার দায় স্বীকার করেনি।
পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত বেলুচিস্তান প্রদেশে বিদেশি সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার পাওয়ার ঘটনা খুবই বিরল। তার ওপর সেনাছাউনির মধ্যে কোনো হাসপাতালে প্রবেশ করা তো কল্পনাতীত বিষয়।
সেনাবাহিনী বলেছে, তারা চায় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এ হামলার প্রভাব সম্পর্কে জানুক।
পাকিস্তানের দাবি, এ হামলার সঙ্গে ভারতের যোগসূত্র আছে। যদিও এ দাবির পক্ষে দেশটি কোনো প্রমাণ দেয়নি। অন্যদিকে দিল্লি জোরালোভাবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
ভারত ও পাকিস্তান সম্প্রতি কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সংঘাতে জড়িয়েছিল। দুই সপ্তাহ ধরা চলা সংঘাতের পর দেশ দুটি বর্তমানে যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবে এই যুদ্ধবিরতি অনেকটা ভঙ্গুর বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন।
ওই সংঘাতে উভয় পক্ষই ড্রোন হামলা, ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ এবং কামান থেকে গোলাবর্ষণ করেছে। সংঘাতে বহু মানুষ হতাহত হয়েছে।
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনার মধ্যে এবার স্কুলবাসে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল। সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেলগুলো নিহত শিশুদের ছবি সম্প্রচার করছে, যাদের বেশির ভাগই ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সী। পাশাপাশি ‘ভারতীয় সন্ত্রাসী অভিযান’-এর অভিযোগও তোলা হচ্ছে।
ঘটনাস্থলে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা ধ্বংসাবশেষ, শিশুদের জুতা ও পরিত্যক্ত কাঁধব্যাগের ছবি এই মর্মান্তিক ঘটনার গভীরতা আরও স্পষ্ট করে তুলেছে।
আমরা যখন হাসপাতালটির আইসিইউর ভেতর দিয়ে হাঁটছিলাম, তখন কিছু শিশু অজ্ঞান অবস্থায় বিছানায় পড়ে ছিল। আর কিছু শিশু ব্যথায় কাতরাচ্ছিল।
একটি ছোট্ট মেয়ে বারবার তার মাকে ডাকছিল। নার্সরা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন।
চিকিৎসকেরা আমাদের জানান, অনেক শিশুর অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের মধ্যে কেউ মারাত্মক আঘাত পেয়েছে, কেউ দগ্ধ হয়েছে, আবার কারও হাড় ভেঙে গেছে।
আমরা আসার আগের রাতে আরও একটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার বলেছেন, বেলুচিস্তানে ভারতীয় ছায়াযুদ্ধের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
অন্যদিকে ভারত বলছে, পাকিস্তান বহু বছর ধরে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে হামলা চালানো জঙ্গিদের আশ্রয় দিয়ে আসছে।
গত এপ্রিলে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হন। এদের বেশির ভাগই পর্যটক। এ হামলাকে কেন্দ্র করেই দুই দেশের মধ্যে সর্বশেষ সংঘাতের সূত্রপাত। পাকিস্তান স্বতন্ত্র একটি পক্ষের নেতৃত্বে এ হামলার উন্মুক্ত তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।
তবে আতাউল্লাহ তারার বলেছেন, ‘বেলুচিস্তানের ঘটনায় এমন কোনো তদন্তের প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, পেহেলগামের ঘটনাটি ছিল এককালীন। আর এ ক্ষেত্রে (বাস বিস্ফোরণ) আমরাই ভুক্তভোগী। আমরা ভুগছি। এ ধরনের ঘটনার ইতিহাস রয়েছে। আমাদের প্রমাণ আছে। আমি আর কী বলতে পারি?’
আমরা যখন তাকে জিজ্ঞাসা করি, এ দাবির পক্ষে কী প্রমাণ আছে। তখন তিনি আবারও অতীত হামলার ইতিহাসের দিকে ইঙ্গিত করেন। তবে এ হামলায় ভারতের সম্পৃক্ততা নিয়ে কোনো নির্দিষ্ট তথ্য দেননি আতাউল্লাহ।
অশান্ত প্রদেশ
পরে একজন কর্মকর্তা আমাদের একটি বাসে করে কোয়েটার রাস্তা ঘুরিয়ে দেখান। রাস্তার দুই পাশে অস্ত্র হাতে সৈন্যরা মোতায়েন ছিল।
বেলুচিস্তানে কয়েক দশক ধরে সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটছে। এসব হামলার সঙ্গে জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহের যোগসূত্র রয়েছে।
এই প্রদেশের কয়েকটি গোষ্ঠী সরকারের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক সম্পদ আত্মসাতের অভিযোগ করে আসছে।
গত মার্চে বেলুচিস্তানের প্রত্যন্ত সিবি জেলায় ট্রেন অবরোধের ঘটনায় প্রায় ২১ জন নিহত হন। নিহতদের বেশির ভাগই ছিলেন ছুটিতে থাকা নিরাপত্তাকর্মী।
বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) ওই হামলা চালিয়েছিল।
পাকিস্তান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ বিএলএকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
বিদ্রোহ দমনে সেনাবাহিনী অভিযান চালালে বেলুচিস্তানের অধিকারকর্মীরা পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলেন। তারা বলেন, গত দুই দশকে বেলুচ জাতিগোষ্ঠীর হাজারো মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন। তাঁদের যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই আটক রাখা হয়েছে বলেও অভিযোগ আছে।
পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার আমাদের বলেন, সন্ত্রাসবাদের মামলায় বিচারক ও সরকারি কৌঁসুলিদের পরিচয় গোপন রেখে এ প্রদেশে ‘অজ্ঞাতনামা আদালত’ চালুর প্রয়োজন হতে পারে বলে সরকারের বিশ্বাস।
তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ বলেন, আদালতগুলো প্রায়ই অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত করতে ব্যর্থ হন। কারণ, বিচারক ও সাক্ষীরা জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রতিশোধের আশঙ্কায় থাকেন।
এক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল চৌধুরী বলেন, ‘স্কুলবাসে হামলার সঙ্গে বেলুচ জাতিগোষ্ঠীর কোনো সম্পর্ক নেই। এটি ছিল ভারতের উসকানি।’
সরকার বলছে, তারা বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক মহলে এই বিষয়টি উত্থাপন করছে।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ও সম্ভাব্য শান্তি আলোচনার ওপর এ ঘটনার কী প্রভাব পড়বে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।