মার্চ ৩০, ২০২৪, ০৮:৪৪ এএম
সালটা ১৯৯৬। ইসরাইলে একটি নতুন বাছুর জন্ম নিলে তা নিয়ে পুরো বিশ্ব আলোচনা করতে থাকে। মেলডি নামে সেই বাছুরটি সম্পূর্ণ লাল রঙের ছিল। তখন ইসরাইলের ধর্মগুরুরা (র্যাবাই) বলে ইহুদিদের‘ থার্ড টেম্পল’ (তৃতীয় মন্দির) নির্মাণের জন্য এই মেলডি নামের বাছুরটিকে প্রস্তুত করা হবে। কিন্তু বেশ কয়েক বছরে একাধিক বার এই লাল গরু উৎসর্গের বিষয়টি সামনে এসেছে। সম্প্রতি এই ইস্যু নিয়ে আবারও আলোচিত হচ্ছে। তবে কি এবার উৎসর্গ হবে নাকি আগের বছরের মতই ফান্ডিং বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়ে এটি সীমাবদ্ধ থাকবে।
লাল গরুই কেন
তবে প্রশ্ন থেকে যায় এই লাল গরুর সঙ্গে ইহুদিদের উৎসর্গের কি সম্পর্ক? আর কেন তা পুরো বিশ্ব ধ্বংস হয় যাবার ইঙ্গিত দেওয়া হয়।
মুসলিমদের জন্য তৃতীয় পবিত্রতম স্থান মসজিদে আল আকসা। আর খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে যিশু ক্রুশবিদ্ধ হবার পর এখন থেকেই তার দেহ স্বর্গে গেছে। আর ইহুদিদের বিশ্বাস এই আল আকসা কম্পাউন্ডের মধ্যেই ডোম অব রকেই অবস্থান তাদের টেম্পল মাউন্ট। আর এই টেম্পল মাউন্ট গড়তেই ভাঙতে হবে আল আকসা কম্পাউন্ড। কিন্তু এই কম্পাউন্ড গড়তে লাল গরুর কি সম্পর্ক?
ইহুদিদের পবিত্র গ্রন্থ তালমুদের মতে কিয়ামতের আগে একজন মসিহ বা ত্রাণকর্তার আবির্ভাব হবে। মসিহ আগমনের আগে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে। বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ইহুদী একত্রিত হবে, সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করতে হবে, আর সোলায়মান (আ.) যে টেম্পল প্রতিষ্ঠা করেছিল সেখানে নতুন থার্ড টেম্পল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর এই টেম্পল গড়তে ভাঙতে হবে আল আকসা কম্পাউন্ড। তবে টেম্পল গড়ার আগে ইহুদিদের হতে হবে পবিত্র। লাল বাছুর ৩ বছর বয়স হলে টেম্পলের সামনে উৎসর্গ করা হবে। পরে সেই গাভীটি পুড়িয়ে সেটার ছাই দিয়ে গড়া পানিতেই শুধু পবিত্র হওয়া যাবে। পবিত্র হবার পরই কাজ শুরু করা যাবে থার্ড টেম্পলের (তৃতীয় মন্দির)।
তবে মুসলিম ও খ্রিস্টধর্মের বিশ্বাস পুরোপুরি ভিন্ন। মুসলিমদের মতে ইহুদিদের এই মসিহ হচ্ছে দাজ্জাল। খ্রীস্টানদের মতে এন্টি ক্রাইস্ট। যা কিনা একটি অশুভ শক্তি।
থার্ড টেম্পল নিয়ে কেন বিতর্ক
ইহুদিদের জন্য টেম্পল গড়াটা এতটাই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল যে টেম্পল ইন্সটিউট নামে একটি সংগঠন ১৯৮৭ সালে গঠিত হয়। যারা এই লাল গরু উৎসর্গ করে সেটি পুড়িয়ে ছাই দিয়ে গোসলের মাধ্যমে অপবিত্র ইহুদিদের পবিত্র করবে। আর সেই পবিত্র ইহুদিরা করবে থার্ড টেম্পলের নির্মাণের কাজ। কিন্তু বিপত্তি একটাই তারা থার্ড টেম্পল যেখানে নির্মাণ করতে চাচ্ছে সেখানেই রয়েছে মুসলিমদের মসজিদ ডোম অব রক। যেটি কিনা আল আকসা কম্পাউন্ডে অবস্থিত। যেটিও মুসলিম ও খ্রিস্টানদের জন্য পবিত্রও বটে।
বারবার লাল গরু অর্থ সংগ্রহের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে
এদিকে প্রশ্ন থেকে যায় এই লাল গরু কি আগে কখনও পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেলে তখন কেন এই ধরনের উৎসর্গ করা যায়নি। ১৯৯৬ সালে জন্ম নেয়া মেলডিকে পরে উৎসর্গ করা হয়নি। তবে ইসরায়েলের কট্টর ইহুদিদের একাধিক গোষ্ঠী মসিহের আগমনের শর্ত পূরণ করতে বহু বছর ধরে আল-আকসা মসজিদ ভেঙে সেই জায়গায় ‘থার্ড টেম্পল’ নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে।
এই টেম্পল নির্মাণের লক্ষ্য সামনে রেখে সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে প্রভাবশালী যে সংগঠন দাঁড়িয়ে গেছে, সেটির নাম টেম্পল ইনস্টিটিউট। ‘আল্ট্রা-অর্থোডক্স’ বা ‘চরম কট্টরপন্থী’ ইহুদিরা ১৯৮৭ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেন।
সেই টেম্পল ইনস্টিটিউট থেকে ২০০৭ সঙ্গে দাবি করা হয় তাদের কাজে গোপনে এই লাল গরু রয়েছে। যেটি কিনা উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত। এরপর ২০১১ সালে র্যাবাই চিয়াম রিচম্যান বলেন তাদের কাছে উৎসর্গ করার জন্য লাল গরু প্রস্তুত রয়েছে। তবে টেম্পল বানানোর জন্য তাদের ফান্ডের প্রয়োজন। এছাড়া তারা একটি লাল গরুর খামারও করেছে।
২০১৮ সালে তারা আবারও ভিডিও ছেড়ে সেখানে উল্লেখ করে ইসরাইলে আরও একটি লাল গরু জন্ম নিয়েছে। যদিও তখন উৎসর্গের কথা থাকলেও সেগুলোকে আর উৎসর্গ করা হয়নি।
তিনদফা এই লাল গরু নিয়ে উত্তেজনা থাকলেও সেখানে সংগঠনটি এখনও পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। বরং তাদের আরও বেশি ফান্ডিং প্রয়োজন বলে উল্লেখ করে। তবে এত এত লাল গরুর উৎসর্গ করার কথা থাকলেও ঠিক এখন কেন এটি নিয়ে বেশি প্রশ্ন উঠছে।
প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে আগে থেকেই
লাল গরু উৎসর্গ করার জন্যও তালমুদে বেশ কিছু নির্দেশনা রয়েছে। লাল গরু উৎসর্গ করার স্থানটি যেন টেম্পলের সামনেই অবস্থান করে। যেখান থেকে জলপাই গাছের কাছে এটি উৎসর্গ করা হবে। আর র্যাবাই ইয়াসহাক মামো নামে এক ব্যক্তি ২০১১ সালেই মাউন্ড অব অলিভসে এমন জমি কিনে রেখেছে। যেখান থেকেই উৎসর্গ করা যাবে। সিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ইয়াসহাক মামোর মতে, ‘সবকিছু প্রস্তুত করা হয়েছে। সঠিক সময়েই এই উৎসর্গের কাজ সম্পন্ন হবে।’
এদিকে উৎসর্গের ক্ষেত্রে আরেকটি নির্দেশনা ছিল যে উৎসর্গকারী ব্যক্তি হতে হবে সম্পূর্ণ পবিত্র। যে কখনও কোনো মৃত ব্যক্তি স্পর্শ করেনি। টেম্পল ইনস্টিউটের মতে এমন ৯ জন ধর্মীয় নেতা এখন রয়েছে। যারা কখনও হাসপাতাল, কবরস্থানে পর্যন্ত যায়নি।
এদিকে ২০২১ সালেই টেক্সাস থেকে পাঁচটি বাছুর ইসরাইলে নিয়ে আসা হয়। কোনো এক গোপন স্থানে এগুলো পরিচর্যার পর সেগুলো এখন প্রস্তুত উৎসর্গের জন্য। বোনেহ ইসরাইল নামে এক সংগঠনের মতে ২৮-২৯ এপ্রিল সেটা উৎসর্গ করবে। এরপর অপবিত্র ইহুদিরা পবিত্র হবে। আল আকসা ভেঙে সেই জায়গায় থার্ড টেম্পল বানানোর জন্য কাজ করে যাওয়া আরেকটি সংগঠনের নাম ‘বোনেহ ইসরায়েল’। আরেকটি প্রতিষ্ঠানের নাম ‘রিটার্নিং টু দ্য মাউন্ট’। সংগঠনটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে তারা তাদের ওয়েবসাইটে বলেছে, ‘টেম্পল মাউন্টের ওপর পূর্ণ ইসরায়েলি সার্বভৌমত্বের আদায় ও প্রয়োগ।’
কোরআনে বর্ণিত গরুর কথা
মুসলিমদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনে গরুর সাথে ইহুদি জাতির সম্পর্কও উল্লেখ আছে। হযরত মুসা আলাইহিস সাল্লামের জাতির গরু প্রীতি নিয়ে পবিত্র কোরআনে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, যখন মুসা আলাইহিস সাল্লাম তার সম্প্রদায়কে বললেন, ‘আল্লাহ তোমাদের একটি গরু জবাই করতে বলেছেন। তারা বলল, তুমি কি আমাদের সাথে উপহাস করছ?’
মুসা আলাইহিস সাল্লাম বললেন, মুর্খদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে আমি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি। তারা বলল, তুমি তোমার পালনকর্তার কাছে আমাদের জন্য প্রার্থনা কর, যেন সেটির রূপ বিশ্লেষণ করা হয়। মুসা আলাইহিস সাল্লাম বললেন, তিনি বলছেন, সেটা হবে একটা গাভী, যা বৃদ্ধ নয় এবং কুমারীও নয়- বার্ধক্য ও যৌবনের মাঝামাঝি বয়সের। এখন আদিষ্ট কাজ করে ফেল। তারা বলল, তোমার পালনকর্তার কাছে আমাদের জন্য প্রার্থনা কর যে, তার রং কিরূপ হবে? মুসা আলাইহিস সাল্লাম বললেন, তিনি বলেছেন যে, গাঢ় পীতবর্ণের গাভী- যা দর্শকদের চমৎকৃত করবে। তারা বলল, আপনি প্রভুর কাছে প্রার্থনা করুন- তিনি বলে দিন যে, সেটা কীরূপ?
কেননা গরু আমাদের কাছে সাদৃশ্যশীল মনে হয়। ইনশাআল্লাহ এবার আমরা অবশ্যই পথপ্রাপ্ত হব। মুসা (আ.) বললেন, তিনি বলেন যে, এ গাভী ভূকর্ষণ ও জল সেচনের শ্রমে অভ্যস্ত নয়- হবে নিষ্কলঙ্ক, নিখুঁত। তারা বলল, এবার সঠিক তথ্য এনেছ। অতঃপর তারা সেটা জবাই করল, অথচ জবাই করবে বলে মনে হচ্ছিল না। (সূরা আল বাকারা: ৬৭-৭১)
বাইবেলে বর্ণিত গরুর ধরনের সঙ্গে কোরআনে বর্ণিত গরুর বেশ কিছু মিল আছে, যেমন, গাভী হতে হবে, মাঝারি বয়সের হতে হবে, কোনো চাষাবাদ বা অন্য কাজে ব্যবহৃত হয়নি এমন হতে হবে, নিখুঁত ও কলঙ্কবিহীন হতে হবে, তাদের ধর্মগ্রন্থে আছে, ‘হাইকলের জমি আমাদের হাতে আসামাত্রই আল্লাহ লাল গাভীকে আদেশ করবেন, সে হাম্বা ধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠবে তারপর আমরা শুরু করবো হাইকল নির্মাণ। বনী ইসরাইলের নবীরা এই ভবিষ্যৎবাণী করে গেছেন’ (আখবারুশ-শারক ১৩/০৫/১৯৯৭)।
লাল গরু সম্পর্কে তাওরাতে যা আছে
তাওরাতের গণনা পুস্তকের ১৯ অনুচ্ছেদের ১-১৭ তম শ্লোকে গাভিটির বৈশিষ্ট্য ও শুদ্ধিকরণ পানি প্রস্তুতের বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে। সেখানে বলা আছে: ‘সদাপ্রভু মোজেস (মুসা আ.) ও হারোনকে (মুসা আলাইহিস সাল্লামের ভাই হারুন আলাইহিস সাল্লাম) বললেন, ‘এটি একটি বিধি যেটি অনুযায়ী আমি আদেশ করছি: ইসরায়েলের সন্তানদের (বনী ইসরায়েলদের) বলে দাও, তারা যেন গায়ে কোনো খুঁত নেই এবং কাঁধে জোয়াল টানেনি এমন একটি লাল গরু নিয়ে আসে।
তোমরা এলিয়েজার যাজককে (ইসলামে যিনি ইলিয়াস আলাইহিস সাল্লাম) সেই গরু দেবে। তারপর গরুটাকে শিবিরের বাইরে নিয়ে যাবে এবং এলিয়েজারের সামনে সেটিকে বলি দেবে। এরপর এলিয়েজার যাজক সেই বলি দেওয়া গরুর রক্ত আঙুলে মাখিয়ে তা শিবিরে জড়ো হওয়া সবার সামনে সাতবার ছিটিয়ে দেবে। তার সামনেই সেই বলি দেওয়া গরু পোড়ানো হবে; সেটির গোবরসহ চামড়া, মাংস ও রক্ত পোড়ানো হবে। যাজক তখন দারুবৃক্ষ, হাইসোপ (এক ধরনের তৃণবিশেষ) পুড়তে থাকা গরুর ওপর ফেলে দেবে। তখন যাজক তার পোশাক ধোবে ও শরীর জলে ধোবে। পরে শিবিরে ঢুকতে পারবে যদিও যাজক সন্ধ্যা পর্যন্ত অশুচি থাকবে’ (তাওরাত, অনুচ্ছেদ ১৯, শ্লোক ২-৮)।
লাল গরুকে কেন্দ্র করে হামাসের হামলা
ইসরায়েলে হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলা এসব কারণকে কেন্দ্র করেই হয়েছিল বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। ৪ নভেম্বর মিডল ইস্ট আইয়ের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হামাসের কাছে সুনির্দিষ্টভাবে খবর ছিল, আগামী বছরের ২০২৪ সালের এপ্রিলে যে পাসওভার বা পেসাখ উৎসব হবে, সে সময়ই আল আকসার নিকটস্থ মাউন্ট অলিভ এলাকায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা লাল গরুগুলো বলি দেওয়া হবে। সেই গরুর দেহ পোড়ানো ছাই দিয়ে শুচিকরণ পানি প্রস্তুত করে ইহুদি যাজকদের পবিত্র করা হবে। সেটি করা হয়ে গেলে থার্ড টেম্পল নির্মাণের পথে ধর্মীয় কোনো বাধা থাকবে না। তাই আল আকসাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতেই হামাস ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, হামাস মনে করে, ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস পশ্চিমা এবং ইসরায়েলের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে গদিতে আছেন। তিনি বা তার দল ইহুদিদের থার্ড টেম্পল নির্মাণে বাধা দেবে না। কিন্তু হামাস বসে থাকতে পারে না। এ কারণে তারা বহু প্রাণহানি হবে জেনেও আল আকসাকে রক্ষা করতে ৭ অক্টোবর হামলা চালিয়েছে। আর হামাসকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে আল আকসা দখল নির্বিঘ্ন করতে ইসরায়েল গাজায় এখন গণহত্যা চালাচ্ছে।
মিডল ইস্ট আইয়ের ওই প্রতিবেদনে একটি সূত্রের বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, আল আকসাকে এর মধ্যেই কার্যত দুই ভাগ করে ফেলা হয়েছে। মুসলিমরা সেখানে যেমন নামাজ আদায় করে, তেমনি বসতি স্থাপনকারী ইহুদিরা ওই কম্পাউন্ডে ‘সবজি বলি’ দিয়ে থাকে।
সূত্র বলেছে, থার্ড টেম্পল নির্মাণের আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা লাল গরু বলি দেওয়াই শুধু বাকি আছে। তারা যদি এটি করতে পারে, তাহলে সেটি হবে থার্ড টেম্পল পুনর্নির্মাণের সবুজ সংকেত।