বিশ্বের প্রায় অর্ধেক ব্যবহারকারী হারাতে চলেছে ভিডিওভিত্তিক জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম টিকটক। চলতি সপ্তাহের বুধবার যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধের বিলে স্বাক্ষর করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এর আগে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও টিকটক নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু কেন টিকটক নিষিদ্ধ করতে চান মার্কিন প্রেসিডেন্টরা? বিশেষ করে জো বাইডেন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে ভূ-রাজনৈতিকভাবে চীনকে মোকাবেলা করাই এর উদ্দেশ্য।
দীর্ঘ সময় ধরে পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তা লঙ্ঘনের কারণেই যুক্তরাষ্ট্রে চীনা অ্যাপ টিকটক নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। ব্যবহারকারীদের বহু ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে সামাজিক এই প্ল্যাটফর্মটির বিরুদ্ধে।
এছাড়াও আরও যেসব কারণ থাকতে পারে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো চীনের সঙ্গে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বাণিজ্য যুদ্ধ। প্রায় সময় দেখা যায় এই দুই দেশ একে অপরের বিরুদ্ধে কড়া সমালোচনা করছে। দুই দেশের প্রেসিডেন্টই তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত। বাণিজ্য কিংবা ভূ-রাজনৈতিক- উভয় কারণেই বিশ্ব রাজনীতিতে এই দুই দেশের মধ্যে বনিবনা একেবারেই অসম্ভব।
‘৯০ দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বজুড়ে একচেঁটিয়া কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না বললেই চলে। তবে প্রতিদ্বন্দ্বী যে ছিল না সেটা বলা যাবে না। কারণ ওই সময় চীন, উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলোর সঙ্গে বড় আঙ্গিকে ভূ-রাজনৈতিক লড়াই তথা বাগযুদ্ধ চালিয়ে আসছিল।
নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধ
গত বছর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশন সামনে রেখে মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধ শুরুর ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তখন গুতেরেস বলেছিলেন, ‘আমাদের যেকোনো মূল্যে স্নায়ুযুদ্ধ এড়াতে হবে। নতুন করে এ যুদ্ধ বাধলে তা হবে আগেরটি থেকে আলাদা। সম্ভবত তা হবে আরও বিপজ্জনক এবং সেটি থামানোও হবে বেশি কঠিন।’
এছাড়া ২০২০ সালের মে মাসে এর ইঙ্গিত দেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। তিনি বলেছিলেন, চীনের সঙ্গে চলমান সম্পর্ককে নতুন স্নায়ুযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রাজনৈতিক শক্তিকে দোষারোপ করেন ওয়াং ই। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রাজনৈতিক শক্তি চীন-মার্কিন সম্পর্ককে জিম্মি করছে এবং এই দুই দেশকে নতুন স্নায়ুযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। এদিকে আমাদের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়েছে।’
২০২১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নতুন করে অকাস চুক্তি হয়। এই চুক্তিকে একবিংশ শতাব্দীর স্নায়ুযুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
বলা হচ্ছে, অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ভাগাভাগি করে চীনকে মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার বিশেষ এই নিরাপত্তা চুক্তি চীনের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সেই সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধের জটিল সমীকরণেও ফেলে দিয়েছে এসব দেশকে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার এই পদক্ষেপের সঙ্গে ১৯৫৬ সালের সুয়েজ খাল সংকট, ১৯৭২ সালের রিচার্ড নিক্সনের চীন সফর বা ১৯৮৯ সালের বার্লিন দেয়ালের পতনের পূর্বাপর তুলনীয় হতে পারে। এই প্রতিটি ঘটনাই গোটা বিশ্বের ভূরাজনৈতিক সমীকরণ বদলে দিয়েছিল।
বাড়ল কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব
টিকটক নিষিদ্ধে সম্প্রতি পাস হওয়া একটি বিলে সই করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এর আগে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও টিকটক নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের প্রতি আক্রোশ থেকেই টিকটক নিষিদ্ধের পক্ষপাতী যুক্তরাষ্ট্র।
গত ১৩ মার্চ বুধবার মার্কিন নিম্নকক্ষে টিকটক নিষিদ্ধে বিল পাস হয়। এরপর ২৩ এপ্রিল সিনেটে অনুমোদনের পর ২৪ এপ্রিল জো বাইডেন বিলটিতে সই করেন। এর মধ্য দিয়ে বিলটি আইনে পরিণত হয়।
২০১২ সাল থেকে টিকটকের মালিকানায় রয়েছে বাইটড্যান্স। বেইজিংভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি কেম্যান দ্বীপপুঞ্জে নিবন্ধিত। যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা ইউরোপেই তাদের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধের বিলে সই করার পর চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব আরও ব্যাপক হলো। আগে থেকেই আশঙ্কা করা হয়ে আসছিল যে যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধ হলে চীনের সঙ্গে টানাপোড়েন আরও বাড়তে পারে।