রাশিয়ার মিসাইলের যোগান আমেরিকার !

গোলাম রাব্বানী

ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২৪, ১২:৩৯ এএম

রাশিয়ার মিসাইলের যোগান আমেরিকার !

ইউক্রেনে রাশিয়ার মিসাইল হামলা। ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেনে রাশিয়ান মিসাইল হামলা হলে দ্রুত সেখানে উদ্ধারকর্মীরা উপস্থিত হচ্ছে। তবে শুধু হতাহতদের উদ্ধার কিংবা ধ্বংসাবশেষ চিহ্নিত করার জন্য নয় বরং ভিন্ন একটি লক্ষ্য নিয়ে। যে মিসাইলটি আঘাত করেছে সেটি কোন ধরনের মিসাইল। আর কী কী প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। আর এই কাজ করতে গিয়ে কিছু জটিল কিছু সমীকরণের মিল পেয়েছে দেশটির সরকার। 

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনকে সহায়তার পাশাপাশি রাশিয়ার মাধ্যমেও বিপুল পরিমাণ ব্যবসা করে নিচ্ছে আমেরিকা। প্রশ্ন হতে পারে রাশিয়াকে স্যাংশন দিলেও কিভাবে আমেরিকার প্রতিষ্ঠানগুলো রাশিয়ার অস্ত্রের যোগান দিচ্ছে।

ইউক্রেনে আঘাত হানা পাখাওয়ালা মিসাইলগুলোর বিস্তারিত যদি দেখেন তাহলে একটি লোগো চোখে পড়বে। ভিকর কোম্পানির লোগো যেটি আমেরিকার প্রতিষ্ঠান। রাশিয়ার নিজস্ব প্রযুক্তি নেই সেমি কন্ডাকটর, মাইক্রোচিপ বানানোর। তাহলে কিভাবে মিসাইল প্রস্তুত করে তারা আর কোথা থেকে মালামাল আসে। কেননা পশ্চিমা প্রযুক্তি ছাড়া রাশিয়া এগুলো বানাতে পারে না।

তবে শুধু ভিকর নয় আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের পার্টস রয়েছে। কমিউনিকেশন কন্ট্রোলার হিসেবে রয়েছে জিলগ। যেটির পুরোপুরি আমেরিকান প্রতিষ্ঠান। টেক্সাস ইন্সট্রুমেন্টস থেকে নেয়া হয়েছে মাইক্রোপসেসর। আর সবচেয়ে বড় জিনিস মাইক্রোচিপ যেটাকে মস্তিষ্ক বলা হয় সেটা বানাচ্ছে ইনটেল, আমেরিকার প্রতিষ্ঠান।

ইউক্রেনের সরকার, রয়েল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের (রুসি) মতে রাশিয়ার ৪৫০টি কম্পেনেন্ট দরকার এই ধরনের মিসাইল বানাতে। যেগুলোর অধিকাংশ আমেরিকা,জার্মানির মত প্রতিষ্ঠান সরবারহ করেছে। যেগুলো রাশিয়া নিজে বানাতে পারবে না। তারা পশ্চিমা দেশ থেকে নিয়ে আসে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে স্যাংশন থাকার পরও কিভাবে কী করছে। ২০২২ সালে ৫ হাজার ড্রোন হামলা করে রাশিয়া কিন্তু ২০২৩ সালে স্যাংশনের ফলে এই হামলা কমার কথা ছিল বরং হয়েছে উল্টো।

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে দেখতে হবে কিভাবে পণ্যগুলো রপ্তানি ও আমদানি করা হচ্ছে। প্রথমত নিউইয়র্কের ব্রুকলিনের দুটি বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান কোটি কোটি ডলারের পণ্য বিভিন্ন দেশে পাঠিয়েছে। সেই রপ্তানির সূত্র ধরে দেখা যাচ্ছে যেগুলো সিংগাপুরের একটি প্রতিষ্ঠান হঠাৎ আড়াই লাখ ডলারের মাইক্রোচিপ কিনছে আমেরিকা থেকে যেগুলো রাশিয়াতে পাঠানো হয়েছে।

আর রাশিয়ার যে যে কোম্পানিতে পাঠানো হয়েছে তারা মাইক্রোচিপ নিয়ে কাজ করে না। রবিন ট্রেড নামে প্রতিষ্ঠানটি সেগুলো কিনে আবার সরবারহ করছে সেরিনা ইঞ্জিনিয়ার্সের কাছে। যেটা রাশিয়ান  গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে কাজ করছে।

স্যাংশন হবার পর থেকে রাশিয়া এমন সব দেশগুলো থেকে পণ্য কিনছে যেসব দেশের সাথে তাদের সম্পর্ক ভালো। অথবা যে দেশগুলো রাজনৈতিক পরাশক্তির চেয়ে ব্যবসা নিয়ে বেশি ব্যস্ত।

জার্মানি স্যাংশন দিলেও দেখা যাচ্ছে তাদের প্রস্তুতকৃত মাইক্রোচচিপ তুরস্কে যাচ্ছে। তুরস্কে কোন প্রতিষ্ঠান মাইক্রেচিপ নিয়ে কাজ করেনা। কিন্তু যা রাশিয়ায় কাছে তারা ঠিকই প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার ইলেক্ট্রনিক্স পার্টস বিক্রি করেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো যুদ্ধ শুরুর আগে কখনও ট্রেড করেনি।

এমনকি মালদ্বীপ যারা পর্যটন ব্যবসা করতো তাদের সেমি কন্ডাকটর ও মাইক্রোচিপের ব্যবসা প্রসার ঘটতে শুরু করে। কাগজে কলমে যদিও। তাদের সমুদ্র বন্দরে আমেরিকা থেকে পণ্য এসে তা রাশিয়ায় দ্রুত যাচ্ছে। যে পণ্যগুলো এসেছে হংকংয়ের রেজিস্টার করা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠান। যার মালিকানা সিংগাপুরের একটি প্রতিষ্ঠানের কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রেশন সিসেলিজ দ্বীপে। রয়টার্সের প্রতিবেদক হংকংয়ে সেই অফিসে গিয়ে দেখে পুরো ফাঁকা। যেখানে বক্স ও কিছু কাগজ আছে। আর একজন স্প্যানিশ অফিসার।

এদিকে ২০০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য যেগুলোর মধ্যে ৫ লাখ ডলারের মাইক্রেচিপ রয়েছে সেগুলো ভারত থেকে কিনছে চিনের কিং পাই নামে একটি প্রতিষ্ঠান। ভারত আমেরিকা,জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্যগুলো ক্রয় করেছিল। কিং পাই সেগুলো রাশিয়ার কাছে বিক্রি করে। এই বিষয় জানতে পেরে আমেরিকা কিং পাই প্রতিষ্ঠানের ওপর স্যাংশন দিয়েছে।

কিন্তু তখনই একই মালিকাধিন থ্রিএইচসি নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলে আবার ব্যবসা শুরু করে। রাশিয়ার প্রতিবেশি দেশ কাজাখাস্তান রহস্যজনক ভাবে মাইক্রোচিপ কিনতে শুরু করেছে। যেগুলো চোরাচালানের মাধ্যমে রাশিয়ায় প্রবেশ করছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই ধরনের বেনামি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ভুয়া কাগজের মাধ্যমে প্রস্তুত করা যাচ্ছে। তাই এই পদ্ধতিতে রাশিয়ার কাছে অস্ত্রের মালামাল সরবারহ কিভাবে কমানো যায়। রয়েল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের (রুসি) পরিচালক জেমস বাইরেন বলেন, এই সাপ্লাই চেইন দমানোর জন্য তাৎক্ষণিক কোন পরিকল্পনা নেই। তবে যেসব প্রতিষ্ঠানগুলো কিনছে তাদের জন্য বেশি দাম রাখা যেতে পারে। বন্দরগুলোতে নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি বিভিন্ন বেনামী প্রতিষ্ঠানকে জেরা করা যেতে পারে।

টিভেন স্পিলবার্গের দ্য সিন্ডার্স লিস্ট সিনেমাতে একটি ডায়লগ ছিল। সাফল্যের মূল কারিগর কি। সেখানে সিন্ডার্স বলেছিল যুদ্ধ। রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধ অনেক দেশের ব্যবসার প্রসার বাড়িয়ে দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো একধারে ইউক্রেনকে সহায়তা করছে আবার পরোক্ষভাবেই বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে রাশিয়ার অস্ত্র নির্মাণের সাথেও জড়িয়ে আছে। 

Link copied!