‘সংখ্যালঘু নির্যাতন’ ও মাহফুজ আলমের পোস্ট নিয়ে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যা বলল ভারত

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ডিসেম্বর ২১, ২০২৪, ০৫:৪১ পিএম

‘সংখ্যালঘু নির্যাতন’ ও মাহফুজ আলমের পোস্ট নিয়ে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যা বলল ভারত

ছবি: সংগৃহীত

একই দিনে বাংলাদেশের দুটি বিষয়ে মন্তব্য করেছে ভারত। একদিকে ভারতের সংসদে বাংলাদেশে ‘সংখ্যালঘু নির্যাতন’ নিয়ে কিছু পরিসংখ্যান পেশ করা হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের একটি ‍‍`মুছে ফেলা‍‍` পোস্ট নিয়ে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে বলে জানিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

লোকসভায় একটি প্রশ্নের লিখিত জবাবে শুক্রবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কীর্তি বর্ধন সিং জানিয়েছেন যে এবছরের আটই ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের হিন্দু এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপরে ২২০০টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ওই জবাবে পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের ওপরে কতগুলি সহিংসতার ঘটনা হয়েছে, সেই পরিসংখ্যানও দেওয়া হয়েছে।

বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে আজ এসব কথা বলা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে পরিসংখ্যান পেশ করা হয়েছে ভারতীয় সংসদের নিম্ন-কক্ষ লোকসভায় সেটি নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে পরিবেশিত সংবাদকে ‘বিভ্রান্তিকর এবং অতিরঞ্জিত’ বলে মন্তব্য করেছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপরে ‘নির্যাতন’ ও ‘সহিংসতার’ যেসব ঘটনা ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তার অনেকগুলিই যে ভুয়া খবর, সেটা খতিয়ে দেখেছে বিবিসি ভেরিফাইসহ ভুয়া তথ্য যাচাইয়ের নানা প্ল্যাটফর্ম। ওইসব ভুয়া তথ্য যাচাইয়ের প্ল্যাটফর্মগুলি বাংলাদেশ আর ভারত– দুই দেশেরই।

একই দিনে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বাংলাদেশের উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের একটি ‘মুছে ফেলা’ পোস্টের ব্যাপারে বলেছেন যে “জনসমক্ষে মন্তব্য করার সময়ে সংশ্লিষ্ট সকলের সতর্ক হওয়া উচিত।”  

ভারতের দেওয়া ‘সংখ্যালঘু নির্যাতনের’ পরিসংখ্যান

বিজেপির সংসদ সদস্য অরভিন্দ ধরমপুরীর করা একটি প্রশ্নের লিখিত জবাবে শুক্রবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কীর্তি বর্ধন সিং বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া সংখ্যালঘুদের ওপরে সহিংসতার একটা তুলনামূলক পরিসংখ্যান পেশ করেছেন।

সেখানে বলা হয়েছে যে ২০২৪ সালের আটই ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ২২০০টি এবং এবছরের অক্টোবর পর্যন্ত পাকিস্তানে ১১২টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে হিন্দু এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপরে।

ওই একই পরিসংখ্যানে বিগত দুই বছরের হিসাবও দেওয়া হয়েছে।

সিংয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ৩০২টি এবং পাকিস্তানে ১০৩টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছিল। আবার তার আগের বছর বাংলাদেশে ৪৭টি ও পাকিস্তানে ২৪১টি এ ধরনের ঘটনা হয়েছে।

এইসব তথ্য বিভিন্ন সংখ্যালঘু সংগঠন এবং মানবাধিকার সংগঠনের থেকে পাওয়া গেছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

ওই জবাবে এটাও বলা হয়েছে যে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ছাড়া ভারতের অন্য কোনও প্রতিবেশী দেশে হিন্দু এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপরে সহিংসতার কোনও ঘটনা ঘটেনি।

এর আগে বৃহস্পতিবার ভারতীয় সংসদের উচ্চ-কক্ষ রাজ্যসভাতেও বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপরে সহিংসতা সংক্রান্ত চারটি পৃথক প্রশ্ন এসেছিল সংসদ সদস্যদের কাছ থেকে।

সেই সবগুলির পৃথক উত্তরও দিয়েছিলেন কীর্তি বর্ধন সিং। সবগুলি উত্তরেই উল্লেখ করা হয়েছে যে ওই সব ঘটনায় ‍‍`বাংলাদেশ সরকার কথিতভাবে ৭০ জনকে গ্রেফতার করেছে এবং ৮৮টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।‍‍`

ভারতের ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ

লোকসভা ও রাজ্যসভায় দুদিন ধরে প্রতিবেশী দুই দেশে ‘সংখ্যালঘু নির্যাতন’ সংক্রান্ত যেসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে, সেখানে এই কথাও বলা হয়েছে যে ওইসব ‍‍`ঘটনাগুলি‍‍` নিয়ে ভারত সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে।

বাংলাদেশের ব্যাপারে প্রতিমন্ত্রী কীর্তি বর্ধন সিং জানিয়েছেন, “সরকার গুরুত্ব সহকারে ঘটনাগুলি দেখেছে এবং বাংলাদেশ সরকারের কাছে তার উদ্বেগ তুলে ধরেছে। ভারত আশা করে যে হিন্দু এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা এবং কল্যাণ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে বাংলাদেশ সরকার।”

ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের বাংলাদেশ সফরের সময়ে আবারও একইভাবে বিষয়গুলির উল্লেখ করা হয়েছে বলেও জানানো হয়েছে সংসদে পেশ করা উত্তরে।

পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের ওপরে সহিংসতার ঘটনাগুলো কূটনৈতিকদের মাধ্যমে তুলে ধরা হয় বলে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। পাকিস্তান সরকারের কাছে “ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং পরিকল্পনা মাফিক নির্যাতন”-এর ঘটনাগুলি বন্ধ করার আবেদনও জানানো হয়েছে।

“পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের দুরবস্থার বিষয়গুলি আন্তর্জাতিক ফোরামগুলিতে তুলে ধরা চালিয়ে যাবে ভারত,” এই মন্তব্যও করা হয়েছে ভারতের এই প্রতিমন্ত্রীর জবাবে।

বাংলাদেশের জবাব

ভারতের সংসদে ‘সংখ্যালঘু নির্যাতন’ নিয়ে যে পরিসংখ্যান পেশ করা হয়েছে এবং তার ভিত্তিতে ভারতের বেশকিছু গণমাধ্যমে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সেটির প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়েছে যে ওই “তথ্যটি বিভ্রান্তিকর এবং অতিরঞ্জিত।”

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “স্বাধীন মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মতে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংস ঘটনার সংখ্যা ১৩৮টি, যাতে ৩৬৮টি বাড়ি ঘরে হামলা হয়েছে এবং ৮২ জন আহত হয়েছে।

“বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিটি ঘটনার তদন্ত করছে এবং দোষীদের আইনের আওতায় আনতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ৪ আগস্ট থেকে ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে অন্তত ৯৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার অভিযোগে ৭৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে,” জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।

তার এটাও বলেছে যে “এসব ঘটনার বেশিরভাগই ৫ আগস্ট থেকে ৮ আগস্টের মধ্যে ঘটেছে, যখন দেশে কোনো সরকার ছিল না। এসব হামলার বেশিরভাগই ঘটেছে রাজনৈতিক কারণে।”  

মাহফুজ আলমের পোস্ট নিয়ে যা বলল ভারত

গত ১৬ই ডিসেম্বর রাতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম একটি ফেসবুক পোস্ট করেছিলেন, যেখানে বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সহ উত্তরপূর্ব ভারতে কয়েকটি রাজ্যকে জুড়ে একটি মানচিত্রের ছবি ছিল।

যদিও কয়েক ঘণ্টা পর পোস্টটি মুছে দেন তিনি।

শুক্রবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালকে এক সাংবাদিক বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন।

জবাবে জয়সওয়াল বলেন যে বিষয়টি নিয়ে ঢাকার কাছে “কড়া প্রতিবাদ” জানিয়েছে দিল্লি।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র কোথাও অবশ্য মাহফুজ আলমের নাম উল্লেখ করেননি।

তার কথায়, “একজন সিনিয়র বাংলাদেশি নেতার মন্তব্যটি নিয়ে যে প্রশ্ন করেছেন, তার জবাবে বলি বিষয়টি আমরা বাংলাদেশ সরকারের কাছে তুলে ধরেছি। বস্তুত আমরা কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছি।”

“পোস্টটি যদিও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তবে আমরা মনে করিয়ে দিতে চাই যে জনসমক্ষে কোনও মন্তব্য করার ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত সংশ্লিষ্ট সকলের। যখন বাংলাদেশের জনগণ ও অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে বার বার আগ্রহ দেখিয়েছে ভারত, তখন জনসমক্ষে এ ধরনের মন্তব্য করার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল হওয়া উচিত,” জানিয়েছেন রণধীর জয়সওয়াল।

Link copied!