চীনের দূতিয়ালিতে মধ্যপ্রাচ্যে কোণঠাসা যুক্তরাষ্ট্র!

মিজানুর রহমান খান

জুন ২২, ২০২৩, ০৭:৫২ পিএম

চীনের দূতিয়ালিতে মধ্যপ্রাচ্যে কোণঠাসা যুক্তরাষ্ট্র!

সংগৃহীত ছবি

পরাশক্তি আমেরিকা ও রাশিয়া। কেউ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান। তবে অর্থনৈতিক পরাশক্তির দিক দিয়ে মাঝখান থেকে চীন অপ্রতিরোধ্যভাবে এগিয়ে চলছে। গত শতাব্দীতে মধ্যপ্রাচ্যে একক আধিপত্য ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। তারা এই অঞ্চলের মাতব্বর হিসেবে ‘মধ্যস্থতাকারীর’ ভূমিকায় ছিল এতকাল। তবে সেই প্রভাব স্তিমিত হতে চলেছে। চলতি বছরের মার্চে এ অঞ্চলে হঠাৎ প্রভাব বিস্তার করে চীন। বিশ্লেষকদের ধারণা, সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ দেশগুলোতে মার্কিন প্রভাব এখন হারাতে বসেছে চীনে বন্ধুতার দূতিয়ালিতে।

ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি অনেক পুরনো। ইরানের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও বিরোধ চলে আসছিল দীর্ঘদিন ধরে। তবে বেইজিংয়ের মধ্যস্থতায় দীর্ঘদিনের এই বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে শান্তি চুক্তিতে সই করেছে সৌদি আরব ও ইরান। স্বাভাবিকভাবেই ওয়াশিংটনের সাথে তেহরানের কূটনৈতিক সম্পর্ক নড়বড়ে। এখন রিয়াদের সাথেও তাদের সম্পর্ক খারাপ অবস্থায় চলে গেছে।

এদিকে কাতারের সাথে মিশর ও উপসাগরীয় দেশগুলোর বিরোধ মেটাতেও এগিয়ে এসেছে চীন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালে কায়রো, রিয়াদ ও দোহার সাথে সম্পর্ক পুনরায় স্বাভাবিক করেছে। ওই বছর দোহার দূতাবাসে দুই দেশ রাষ্ট্রদূত পুনর্নিযুক্ত করে। গত এপ্রিলে বাহরাইনও কাতারের সাথে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের ঘোষণা দেয়।

যুক্তরাষ্ট্র ওই বিরোধ দীর্ঘদিন ধরে জিইয়ে রাখলেও চীনের দূতিয়ালিতে আরব দেশগুলো একে অন্যের সাথে কূটনীতিক সম্পর্ক জোরদার করে চলেছে। ইরান এবং সৌদি আরবের কূটনীতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পর চীনের মধ্যস্থতায় সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করেছে কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতও। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান আল-সৌদ সম্প্রতি তেহরান সফর করেন। এই সফরের পরই সৌদি আরবের রিয়াদে অবস্থিত রিয়াদের দূতাবাস ফের চালু করে ইরান।

অপরাপর আরব দেশ সিরিয়াকে প্রায় এক দশক পর আরব লীগের সদস্যপদ ফিরিয়ে দিয়েছে। আরও এটাও সম্ভব হয়েছে চীন ও রাশিয়ার মধ্যস্থতার কারণে। ফলে সৌদি আরব, মিশরসহ বেশ কয়েকটি আরব দেশ সিরিয়ার সাথে এক দশকব্যাপী বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটিয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সৌদি আরবের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদারিত্বের মূলে ছিল তেল। তবে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের অবস্থান, ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন যুদ্ধে মার্কিন সহায়তা কমিয়ে আনা এবং ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টায় ওয়াশিংটনের সাথে রিয়াদের সম্পর্কে ফাটল ধরতে শুরু করে। অথচ একই সময়ে চীন পারস্পরিক সুবিধা এবং একে-অপরের প্রতি শ্রদ্ধার ভিত্তিতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন ও গভীর করে চলে। ইরান ও সৌদি আরব দুই দেশই বাণিজ্য ও নিরাপত্তা ব্লক ব্রিকস প্লাস এবং সাংহাই সহযোগিতা সংস্থায় যোগ দিতেও আগ্রহী হয়ে উঠে।

দীর্ঘদিন ধরে পরিবর্তনের সুবিধা নিতে নিজেদের তৈরি করেছে চীন। আফগানিস্তান, ইরাক, ইয়েমেন, আফ্রিকার লিবিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে কয়েক দশক ধরে চলা সংঘাত নিরসণে যুক্তরাষ্ট্র কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। অথচ ওই পথে হাঁটেনি চীন। তারা এসব দেশের চলমান বিরোধ নিরসনে মধ্যস্থতা করেছে। এতে বিশ্ব পরিমণ্ডলে চীনের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হয়েছে।

সৌদি আরব তেল উৎপাদন বাড়ানোর মার্কিন আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করেছে বারবার। পাশাপাশি গত অক্টোবরে ইরান ও রাশিয়ার সাথে ‘ওপেক প্লাসে’ যোগ দেওয়ার পর এর পরিণাম নিয়ে রিয়াদকে সতর্কও করেছিলেন আমেরিকা। ওই সময় রিয়াদ স্পষ্টভাবে ঘোষণা দেয় যে, সৌদি আরব অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার স্বার্থ অনুযায়িই সিদ্ধান্ত নেয়। অন্য কোনো দেশের মত বা কারো আরোপিত মতামতকে সৌদি আরব পাত্তা দেয় না।

শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সৌদি আরবের সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোনও দেশেরই হস্তক্ষেপ করা উচিত নয় বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে রিয়াদ। বলা হয়ে থাকে, সৌদি আরব যে পথে হাঁটে সে পথ অনুসরণ করে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যদেশগুলো। তাইতো কাতার, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, সৌদি আরব আজ নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করছে। আর এর পেছনে ‘উপদেষ্টা’ হিসেবে কাজ করছে চীন। চীনের এমন তৎপরতায় মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন কূটনীতি বা আধিপত্য অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে।

Link copied!