ভারতের আসামে ছড়িয়েছে ‘বন্যা জিহাদের’ ভুয়া খবর

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

আগস্ট ৪, ২০২২, ১০:১৬ পিএম

ভারতের আসামে ছড়িয়েছে ‘বন্যা জিহাদের’ ভুয়া খবর

ভারতের আসামে ভয়াবহ বন্যার জন্য স্থানীয় মুসলিমদের দায়ী করে অনলাইনে বেশকিছু ভুয়া খবর ছড়িয়েছে। কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, তারা ‘বন্যা জিহাদ’ করেছে।

বন্যা জিহাদের অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া এক ব্যক্তি বিবিসি-কে শুনিয়েছেন তার দুর্ভাগ্যের কাহিনী:

গত ৩ জুলাই ভোরে নাজির হোসাইন লস্করের বাড়ির দরজায় পুলিশ যখন কড়া নাড়ে তখন তিনি আকাশ থেকে পড়েন। বছরের পর বছর ধরে আসামে একজন নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন নাজির। রাজ্যের বন্যা প্রতিরোধে বাঁধ নির্মাণেও কাজ করেছেন তিনি।

অথচ ৩ জুলাই ভোরে পুলিশ তাকে ‘সরকারি সম্পদ নষ্ট’ করার, আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে শহর রক্ষা বাঁধ ধ্বংস করার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে।

দুঃখের সঙ্গে নাজির বলেন, ‘‘আমি ১৬ বছর ধরে সরকারের হয়ে বাঁধ নির্মাণের কাজ করেছি। কেনো আমি সেগুলোর কোনোটির ক্ষতি করব?”

বিবিসি জানায়, প্রায় ২০ দিন কারাগারে থাকার পর জামিনে বের হন নাজির। তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে তার পক্ষে কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু তারপর থেকে তাকে ঘিরে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে ভুয়া খবরের ঝড় বইছে।

‘আমি ভেবেছিলাম আমার ওপর হামলা হতে পারে'

গত মে ও জুন মাসে আসামে দুইবার বন্যা হয়, মারা যান অন্তত ১৯২ জন। আসামে সাধারণত প্রত্যেক বর্ষা মৌসুমেই কমবেশি বন্যা হয়। কিন্তু এবার সময়ের আগেই বর্ষা শুরু হওয়ায় এবং অস্বাভাবিক ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যা মারাত্মক রূপ নিয়েছিল।

কিন্তু কিছু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী মনে করেন, শুধু ভারি বৃষ্টিপাতই কারণ নয়, বরং এখানে আরও ভয়ঙ্কর কিছু কাজ করেছিল।

তাদের দাবি, এই বন্যা মানুষের সৃষ্টি, বিশেষ করে একদল মুসলমান ইচ্ছা করেই প্রতিবেশী হিন্দু অধ্যুষিত নগরী শিলচরে প্লাবন ঘটিয়েছে। যদিও নিজেদের দাবির পক্ষে তারা কোনও প্রমাণ দেখাতে পারেনি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘বন্যা জিহাদ’ নিয়ে ভুয়া খবরের ঝড় বয়ে যায়। গ্রেপ্তার হন নাজির ছাড়াও আরো তিনজন মুসলমান।

‘বন্যা জিহাদ’ নিয়ে পোস্টগুলো হাজার হাজার বার শেয়ার হয়। এমনকী অনলাইনে বিশিষ্ট প্রভাবশালীরাও নিজেদের ভেরিফাইড একাউন্ট থেকে ওই সব খবর শেয়ার করেন। স্থানীয় কয়েকটি নিউজ চ্যানেল থেকেও একই খবর প্রচার করা হয়।

খবরে নাজিরের নাম উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে ‘বন্যা জিহাদ’ করার অভিযোগ করা হয়। ওই সময়ে কারাগারেই ছিলেন নাজির।

তিনি বলেন, ‘‘খবরটি প্রচারের পর আমি আতঙ্কে ওই রাতে ঘুমাতে পারিনি। কারাগারের অন্যান্য বন্দিরা এ নিয়ে কথা বলছিল। আমি ভেবেছিলাম আমার ওপর হামলা হতে পারে।”

‘বন্যা জিহাদ দাবির পেছনের সত্য’

বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৫০ এর দশক থেকে আসামে বেড়িবাঁধ নির্মাণ শুরু হয়। রাজ্যে চার হাজার কিলোমিটারের বেশি বেড়িবাঁধ রয়েছে এবং অনেকগুলোই এখন ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে এবং যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে।

গত ২৩ মে বরাক নদীর ওপর একটি বাঁধ ভেঙে যায় এবং ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল ও প্রতিবেশী বাংলাদেশে বন্যা দেখা দেয়।

বাঁধের যে অংশ ভেঙে গিয়েছিল সেটি মুসলমান অধ্যুষিত বেথুকান্ডি এলাকায়। হিন্দু অধ্যুষিত শিলচরে যেসব কারণে বন্যা হয়েছিল বেথুকান্ডিতে বাঁধ ভেঙে যাওয়া তার অন্যতম একটি।

শিলচরের পুলিশ সুপার রামানদীপ কৌর বলেন, ‘‘অনেকগুলো কারণের একটি ছিল বাঁধ ভেঙে যাওয়া। কিন্তু শুধুমাত্র সেখান দিয়ে শিলচরে বন্যার পানি ঢোকেনি। আরও কয়েকটি জায়গা দিয়েও ঢুকেছে।”

বিবিসি মনে করে, বেথুকান্ডিতে বাঁধ ভাঙার কারণেই নাজিরসহ চার মুসলমানকে গ্রেপ্তার হতে হয়। পরে আরও একজন গ্রেপ্তার হন। অথচ তাদের কারও বিরুদ্ধে বাঁধ কেটে দেওয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত করায় জড়িত থাকার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

দুর্যোগ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মুম্বাইয়ের অধ্যাপক নির্মলা চৌধুরি বলেন, ‘‘অনেক জায়গায় বাঁধ ভেঙে যাওয়ার কারণ সেগুলো ঠিক মত রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংস্কার কাজ না করা।”

“তবে মাঝেমধ্যে মানুষ ইচ্ছা করেও বাঁধ কেটে দেয়। এক্ষেত্রে দেখা যায়, নিজেদের এলাকা প্লাবিত হওয়া থেকে বাঁচাতে স্থানীয়রা অনেক সময় বাঁধ কেটে দেয় যাতে পানি সরে যায়।”

শিলচর পুলিশও এ অধ্যাপকের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে। পুলিশ সুপার রামানদীপ বলেন, ‘‘সেখানে ‘বন্যা জিহাদ’ বলে কিছু ঘটেনি।

“অতীতে প্রশাসন থেকেও পানি সরিয়ে দিতে বাঁধ কেটে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এ বছর প্রশাসন থেকে তেমন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তাই কিছু মানুষ বিষয়টি নিজেদের হাতে নেয়।”

অধ্যাপক নির্মলা বলেন, ‘‘দায়িত্বে অবহেলা থেকে বাঁচতে ‘বন্যা জিহাদ’ এর মত উদ্ভট কিছু দাবি করা খুব সহজ। এটি অব্যবস্থাপনাজনিত সমস্যা এবং আমার মনে হয় এর বিরুদ্ধে আরও দায়িত্বশীল ও পরিপক্ক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।”

‘আমি মুসলমান তাই আমাকেই দোষ দেওয়া হয়েছে’

ভারতে মুসলমান বিরোধী ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচারের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগে কোভিড-১৯ মহামারী ছড়ানোর জন্যও মুসলমানদের দায়ী করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, তারা ‘কোভিড জিহাদ’ করছে।

সমালোচকরা বলছেন, ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তার হিন্দুত্ববাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশটিতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের লক্ষ্য করে নৃশংসতা, ঘৃণা এবং ভুয়া তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা অনেক বেড়ে গেছে।

যদিও বিজেপি বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিন্তু ভারত জুড়ে যা ঘটছে তাতে বিষয়টি এখন অনেক স্পষ্ট। জামিনে ছাড়া পেলেও আসামের নাজিরের দিন এখনও আতঙ্কে কাটে।

তিনি বলেন, ‘‘আমি এবং আমার পরিবার এখনও বাড়ির বাইরে যেতে ভয় পাই। আমার সন্তানরা ঠিকমত স্কুলে যাচ্ছে না। যদি আমাকে বাড়ির বাইরে যেতেই হয়, তখন আমি চেহারা লুকাতে হেলমেট পরি। আমি সব সময় ভয়ে থাকি, যখন তখন উত্তেজিত জনতা আমার উপর হামলে পড়তে পারে।”

“আমার বিরুদ্ধে বন্যা জিহাদের অভিযোগ আনা হয়েছে, কারণ আমি একজন মুসলমান। এটা মিথ্যা। যারা এসব ছড়াচ্ছে তারা খুবই অন্যায় করছে।”

Link copied!