আগস্ট ২৪, ২০২২, ০৬:৪০ পিএম
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার সৃষ্টি করেছে। যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে শুধু এই দুই দেশই নয় বরং গোটা বিশ্ব আজ খাদ্য ও অর্থনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত। যুদ্ধের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও থামার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। যুদ্ধের পরই বিশ্বব্যাপী শুরু হয় খাদ্য ও অর্থনৈতিক সংকট। যুদ্ধ চলমান থাকলে এই সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা।
২০২২ এর ২৪ শে ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলার মধ্য দিয়ে রাশিয়া তার ‘সামরিক অভিযান’ শুরু হয়।এর আগে, উত্তর আটলান্টিক নিরাপত্তা জোট ন্যাটোর সদস্যপদের জন্য কয়েক বছর আগে আবেদন করা নিয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এর মধ্যে ন্যাটো ইউক্রেনকে ‘সহযোগী দেশ’ হিসেবে মনোনীত করায় মস্কো-কিয়েভের দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়। ন্যাটোর সদস্যপদের আবেদন প্রত্যাহারে চাপ প্রয়োগ করতে যুদ্ধ শুরুর দুই মাস আগ থেকেই ইউক্রেন সীমান্তে প্রায় দুই লাখ সেনা মোতায়েন রাখে মস্কো।
তবে ওই কৌশল কাজে না আসায় গত ২২ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দুই ভূখণ্ড দনেতস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় রাশিয়া। এর দুদিন পর ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর নির্দেশ দেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এরপর থেকে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ চলছে।
যুদ্ধের প্রথমেই কিয়েভ,খারকিভ ও খারসন আক্রমন করলেও ইউক্রেন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। তবে মার্চ মাসের মধ্যে কিয়েভ বাদে সবই দখলে নিতে সক্ষম হয় রাশিয়া।
এপ্রিলে দনবাস দখল, ক্রিমিয়ার সাথে রাস্তা সংযোগ, ব্লাক সি পোর্ট নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি দক্ষিণ ইউক্রেন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে রাশিয়া। কিন্তু এরপরই যুদ্ধ ভিন্ন পরিস্থিতিতে মোড় নেয়। ইউক্রেন বিভিন্ন দেশ থেকে সামরিক সহায়তা পেয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলে। এই প্রতিরোধের মধ্যেই ২০ মে মারিওপুল নিয়ন্ত্রণে নেয় পুতিন বাহিনী। তবে এরপর কোনো পক্ষই যুদ্ধে সুবিধা করতে পারেনি।
যুদ্ধের হতাহতের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি তবে মার্কিন সামরিক কর্মকর্তারা ধারণা যুদ্ধে প্রায় রাশিয়ার ৭০ হাজার সৈন্য হতাহত হয়েছে।
জাতিসংঘের মতে, ইউক্রেনে ৫ হাজার ৫৮৭ বেসামরিক লোক নিহত এবং ৭ হাজার ৮৯০ জন আহত হয়েছে। যদিও সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছে প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
বৈশ্বিক সংকট
রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ যতটা দুই দেশকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে তারচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে পুরো বিশ্ব। ইউরোপের শস্য ভান্ডার খ্যাত ইউক্রেন থেকে গম ও ভোজ্যতেল রপ্তানি বন্ধ থাকে। যার প্রভাবে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে খাদ্য সংকট ও অত্যাধিক মূলস্ফীতি দেখা দেয়। এই অসন্তোষের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কায় শাসন ব্যবস্থারই পরিবর্তন ঘটে। ইরান,পাকিস্তানসহ বেশ কয়েকটি দেশে ঘটে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে সারকারের বিরুদ্ধে ধর্মঘট আর আন্দোলনের মতো ঘটনা।
অর্থনৈতিক সংকট
ফ্রান্স, জার্মানি, সুইডেন, নরওয়েসহ ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে গ্যাস ও জ্বালানি সরবারহ করে থাকে রাশিয়া। তবে এসব দেশ ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেয়ার পর থেকেই রাশিয়া জ্বালানি সরবারহ নিয়ন্ত্রণ করে রাখে। রাশিয়ার মুদ্রায় লেনদেনসহ নানা শর্তের ফলে ইউরোপের দেশগুলোতে জ্বালানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। বেশ কিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ থাকার পাশাপাশি গণপরিবহন চালনায়ও নিয়ন্ত্রণ আনে ইউরোপিয়ান দেশগুলো।
এমনকি জ্বালানির ভিন্ন বাজার খুঁজতে গিয়ে তা বৈশ্বিক সমস্যার সৃষ্টি করে। যার ফলে গ্যাসের মূল্য ৬ মাসে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। এদিকে শীতকালে রাশিয়ান গ্যাস ছাড়া ইউরোপীয় দেশসমূহ যে বড় সমস্যায় পড়বে তা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
ডলারের উত্থান
যুদ্ধ শুরুর দুই মাস পর ইউরোপের দেশগুলোকে রাশিয়ান মুদ্রা রুবলে লেনদেন করতে বলে পুতিন প্রশাসন। কিন্তু অধিকাংশ দেশের রিজার্ভে রুবল ছিলনা। এর পাশাপাশি জ্বালানি সরবারহ কমিয়ে দেয়ায় ইউরোপিয়ান দেশগুলো ভিন্ন বাজারে খোঁজ নেয়। যা পুরোটাই ডলারের মাধ্যমে লেনদেন হয়। এই বাড়তি চাহিদা যেমন বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট বৃদ্ধি করেছে তেমনি ডলারের মূল্যও বাড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমানে ডলারের অবস্থান অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি।
যুদ্ধের ভবিষৎ কী?
রাশিয়া এখন দখলকৃত অঞ্চলের নিরাপত্তার পাশাপাশি নতুন অঞ্চল দখল করার পরিকল্পনা করছে। এদিকে ইউক্রেন রাশিয়ার সামরিক রসদ যোগানের মাধ্যম যেমন ডিপো, বিমানবন্দর, রাস্তাঘাটে আক্রমন করছে। যেটা এখন অনেকটা ইউক্রেনকে সুবিধা দিচ্ছে। তবে দনবাস নিয়ন্ত্রণের পর রাশিয়া ডিনিপার নদীর দিকে আগাবে। যেটা ইউক্রেনকে অর্ধেক করে দিবে।
তবে বেশ কয়েকবার আলোচনার প্রস্তাব আসলেও পুতিন কিন্তু রাজী হয়নি। সে থেকে বুঝা যায় রাশিয়া পুরো ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়। যদি না নিতে পারে তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়নের মত করে পুর্নগঠন স্বপ্নই থেকে যাবে।
ইউক্রেনে রুশ অভিযানকে কেন্দ্র করে কয়েক মাস ধরে বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা হুমকির মধ্যে ছিল। তবে ইউক্রেন থেকে শস্য রপ্তানির পথ খুলে দিতে গত ২ আগস্ট থেকে রাশিয়ার সঙ্গে দেশটির চুক্তির পর এ নিয়ে স্বস্তি দেখা দিয়েছে। তবে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি না ঘটা পর্যন্ত পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে না বলে ধারণা করছেন অনেক বিশ্লেষক।